চীনের মানুষরূপী সাদা সাপ
মৃত থেকে জীবন্ত হয়ে শু শিয়ান ও তার মানুষরূপী সাপ স্ত্রী বাই সু ঝেন সুখে শান্তিতেই বসবাস করছিলেন। (এই শিরোনামের প্রথম পর্বে শু শিয়ান ও তার স্ত্রী বাই সু ঝেন সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। আজ এর শেষ পর্বে তুলে ধরা হলো পরের অংশটি।) এমন সময় শিয়ান একটি আমন্ত্রণ পত্র পেলেন। জিন শান মন্দিরের উদ্বোধন উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পান শু শিয়ান। কিন্তু তার স্ত্রী বাই সু ঝেন সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তাকে নিষেধ করলেন।
বাই সু ঝেন স্বামীকে বোঝালেন, তিনি মানুষের রূপধারী এক স্বর্গীয় সাপ হওয়ার কারণে অনধিকার চর্চাকারী সন্ন্যাসীরা তাদের সংসার ভাঙার জন্য বদ্ধপরিকর। তবে শু শিয়ান ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ বৌদ্ধ। তাই মন্দিরের উদ্বোধনে নিজের উপস্থিতি নিশ্চিত করাকে তিনি পবিত্র দায়িত্ব বলে মনে করছিলেন। শু শিয়ান ও বাই সু ঝেন দম্পতি জানতেন না, ওই আমন্ত্রণ এসেছিল ফা হাইয়ের তরফ থেকে। যিনি একবার তাদের সংসার ভাঙার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন এবং শু শিয়ানের জীবনকে সংকটময় করে তুলেছিলেন।
যাই হোক, যখন শু শিয়ান ফা হাইয়ের মুখোমুখি হলে সে তাকে মন্দিরে প্রবেশের অনুমতি দিলেন না। তাকে বলা হলো সে না-কি এক ‘অশুভ প্রেতাত্মা’র সঙ্গে সংসার করে। এজন্য তাকে সন্ন্যাসীদের আশ্রমে গিয়ে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে মন্দিরে প্রবেশ করতে হবে! শু শিয়ান সঙ্গে সঙ্গে এর প্রতিবাদ করলেন এবং ফা হাইকে শক্ত কণ্ঠে বললেন, তার স্ত্রী মোটেই কোনো অশুভ প্রেতাত্মা নন। কিন্তু ফা হাই সহজে ছাড়ার পাত্র ছিলেন না। এদিকে বাড়িতে বসে বাই সু ঝেন দুশ্চিন্তায় অস্থির হচ্ছিলেন। তার গর্ভে তখন নতুন সন্তান এসেছে, অথচ তার স্বামী শু শিয়ান আমন্ত্রণপত্র পেয়ে এত দ্রুত গৃহত্যাগ করেছেন যে তিনি তাকে এই সুখবর দেয়ার সুযোগই পাননি! বাই সু ঝেনের মন বলছিল, তার সঙ্গে খারাপ কিছু একটা হতে চলেছে। অথচ তার স্বামী এখন তার থেকে অনেক দূরে!
চিন্তায় অস্থির হয়ে বাই সু ঝেন স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে সেই মন্দিরের দিকে যাত্রা করলেন। তবে মন্দিরে যাওয়ার আগে ফা হাই ঠিকই তার পথ আটকে দাঁড়ালো। ক্রোধের বসে সে তার প্রার্থনার কাজে ব্যবহৃত মাদুরটি বাই সু ঝেনের দিকে ছুঁড়ে মারল। ফা হাই ভেবেছিল পবিত্র এই মাদুরের কল্যাণে হয়তো সু ঝেনের অশুভ আত্মা পরাভূত হবে। কিন্তু তা না হয়ে তার মাদুরটি জ্বলে পুড়ে ছাড়খার হয়ে গেল। ফা হাইয়ের আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে বাই সু ঝেন সন্ন্যাসীটির পেছনে একদল চিংড়ি ও কাঁকড়া সেনা লাগিয়ে দিলেন। সেই সঙ্গে ওই এলাকায় বন্যা ডেকে আনলেন, যাতে ফা হাই আর সু ঝেন ও শু শিয়ানের সংসার ভাঙতে না আসেন। তবে বন্যায় ফা হাই ছাড়াও ওই এলাকার সাধারণ মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত হলো। এই প্রথমবারের মতো বাই সু ঝেনের হাতে মানুষের ক্ষতি হলো। বাই সু ঝেন ঈশ্বরের আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হলেন।
এই সুযোগে ফা হাই তার জাদুকরী ভিক্ষার পাত্রের মধ্যে বাই সু ঝেনকে বন্দি করতে চাইলেন। কিন্তু তখনই বাই সু ঝেনের পেট থেকে বেরিয়ে এলো অসম্ভব উজ্জ্বল এক আলো। সেই আলোর কল্যাণেই ফা হাইয়ের কবল থেকে রক্ষা পেলেন বাই সু ঝেন। নিষ্কৃতি পেয়ে বাই সু ঝেন ও শু শিয়ান দম্পতি বাড়িতে এলেন। তাদের ঘর আলো করে এলো একটি পুত্র সন্তান। শু শিয়ান ছেলের নাম রাখলেন শু শি লিন। তবে পুত্র সন্তান জন্মের আনন্দের মাঝেও শু শিয়ানের মনে একটা খচখচানি রয়েই গেলো। স্ত্রীর বিধ্বংসী ক্ষমতা শু শিয়ানকে বেশ চিন্তিত করে তুললো। তিনি ভাবলেন, সংসারে অশান্তি বয়ে আনতে পারে তার স্ত্রীর ওই অতিমানবীয় ক্ষমতা।
এমতাবস্থায় শু শিয়ানের দরজায় আবার কূটকৌশল নিয়ে হাজির হলেন সন্ন্যাসী ফা হাই। তিনি শু শিয়ানকে তার ভিক্ষার জাদুকরী পাত্রটি দান করে বললেন, এটাই তোমার সংসারে শান্তি নিয়ে আসতে সাহায্য করবে। যদিও শু শিয়ান এবার আর ফা হাইকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তারপরও স্ত্রী বাই সু ঝেনের বিধ্বংসী ক্ষমতার কথা মনে করে সন্ন্যাসীর দেয়া উপহার গ্রহণ করলেন। ভিক্ষার পাত্রটি নিয়ে ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই সেটি আপনা-আপনি বাই সু ঝেনের মাথায় উড়ে গিয়ে বসে গেলো এবং সঙ্গে সঙ্গে তিনি সাদা সাপ হয়ে পাত্রটিতে আটকা পড়ে গেলেন। এই অঘটনের পর শু শিয়ান দৌড়ে গেলেন ফা হাইয়ের কাছে। বাই সু ঝেনকে বন্দি করতে পারার আনন্দে আত্মহারা হলেন সন্ন্যাসী। তিনি ভিক্ষার পাত্রটিকে লেই ফেং প্যাগোডার কাছে লোহার তৈরি একটি বৃক্ষের পাদদেশে সমাহিত করে রাখলেন, যদিও এতে শু শিয়ানের মত ছিল না।
শু শিয়ান স্ত্রীকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য ফা হাইয়ের কাছে কাতর আকুতি জানালেন। কিন্তু সদম্ভে ফা হাই ঘোষণা করলেন, বাই সু ঝেন ফিরবে, যদি লোহার গাছে ফুল ফোটে। নিজের দোষে স্ত্রীকে হারানোর পরিতাপে শু শিয়ান তার সন্তানকে বোনের কাছে রেখে এক সন্ন্যাসী আশ্রমে আশ্রয় নিলেন। তবে একটি বিষয় সম্পর্কে কেউই অবগত ছিলেন না। জ্ঞানের দেবতা ওয়েন শু শিংই পৃথিবীতে পুনর্জন্ম নিয়ে এসেছিলেন বাই সু ঝেন ও শু শিয়ান দম্পতির পুত্রসন্তান হিসেবে। শু শিয়ানের ত্যাগের পুরস্কারস্বরুপ দেবতা ওয়েন শু শিংকে তার সন্তান হিসেবে পাঠানো হয়েছিল। শু শিংয়ের আধ্যাত্মিক ক্ষমতাই তার মা বাই সু ঝেনকে মন্দিরে ফা হাইয়ের আক্রমণ থেকে বাঁচিয়েছিলো।
ছোট্ট শি লিন যতই বড় হয়ে উঠতে লাগলো, তার জ্ঞান ততই বাড়তে লাগল। ১৯ বছর বয়সে সে রাজধানীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করলো দেশব্যাপী রাজকীয় পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য। রাজ্যের মধ্যে সেই সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হলো। সম্রাট নিজেই শি লিনকে পুরস্কার দিলেন, মণি-মুক্তা বসানো ও ফুলে ফুলে সজ্জিত একটি সুন্দর টুপি। খুশি মনে ঘরের দিকে যাত্রা শুরু করলেও শু শিংয়ের বার বার মনে পড়ছিল বাবা-মা ও তাদের দুর্ভাগ্যের কথা।
নিজের ভালো ফলাফলের খবর দিয়ে শি লিন তার বাবা শু শিয়ানকে সন্তুষ্ট করলেন ও তাকে আশ্রম থেকে ফিরিয়ে আনলেন। দু’জন মিলে গেলেন লেই ফেং প্যাগোডায় সু ঝেনের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে। শি লিন তার পুরস্কার পাওয়া মাথার টুপিটাকে সেই লোহার গাছের ওপর রেখে মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করলো। এমন সময় হঠাত মাটি ফুঁড়ে বাই সু ঝেনের আবির্ভাব হলো।
শি লিন যেহেতু আদতে একজন দেবতা ও তার মাথার টুপিতে ছিলো তাজা ফুল। এ কারণেই ফা হাইয়ের দেয়া শর্ত পূরণ হয়ে গেল। লোহার বৃক্ষে ফুল দেখা দিলো। শি লিন ফিরে পেল তার বাবা-মাকে। বাই সু ঝেন তার সব অভিশাপ কাটিয়ে একজন মরণশীল মানুষ হয়ে ফিরে আসলেন। সন্তানকে নিয়ে সু ঝেন ও শু শিয়ান দম্পতি সুখে শান্তিতে বাস করতে লাগলেন।
সূত্রঃ চৈনিক পৌরাণিক কাহিনী