সিগারেটের শুরু যেভাবে হয়
‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’ এই কথাটি জেনেই তামাকসেবীরা হামেশাই ধূমপান করে থাকেন। সম্প্রতি সিগারেটের উপর শুল্ক বৃদ্ধি এবং সিগারেটের দাম বাড়া নিয়ে অনেকেই হয়তো চিন্তিত। আবার যারা সিগারেট বা তামাকে আসক্ত নয় তারা আসক্ত প্রিয়জনদের স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তিত। কিন্তু যে পণ্যটি নিয়ে এত চিন্তা করছেন, জানেন কি সেই পন্যের শুরুটা কোথায়? মানব ইতিহাসের সবথেকে বেশি আসক্তি সৃষ্টিকারী উপাদান তামাক থেকেই সিগারেটের উৎপত্তি। শত শত বছর ধরে মানুষ সিগারেটের অপকারিতা জানলেও প্রতিনিয়তই নতুন মানুষ সিগারেটের প্রতি আসক্ত হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী প্রচারণা, দাম বৃদ্ধি এমনকি তামাকজাত পণ্য নিষিদ্ধ করেও থামানো যাচ্ছে না সিগারেটের আসক্তি। কিন্তু কেন? কোথায় বা কীভাবে শুরু হয়েছিল সিগারেট আসক্তির?
সিগারেটের উৎপত্তি নিয়ে অনেক ধারণাই প্রচলিত। সিগারেট বা তামাকজাত পণ্যের উৎপত্তি হয়েছিল চীনে। তবে সিগারেটের শুরু চীন থেকে অনেক দূরে হয়েছিল। প্রায় ৮ হাজার বছর পূর্বে মধ্য আমেরিকার মানুষ তামাক গাছ আবিষ্কার করে। কিন্তু তখনো এই পন্যের কোন ব্যবহার ছিল না। এর প্রায় ৭ হাজার বছর পরে খৃষ্টপূর্ব ১ হাজার অব্দে মধ্য আমেরিকার মায়ানরা তামাক চাষ শুরু করে। মায়ানদের ধারণা ছিল তামাক একটি ব্যথানাশক। তারা তামাকের মাধ্যমে অসুস্থ এবং আহতদের চিকিৎসা করতেন। এছাড়াও মায়ান পুরোহিতদের কাছে তামাক একটি পবিত্র পন্য ছিল। তারা মনে করতেন তামাক সেবনের মাধ্যমে তারা আত্মাদের সাথে যোগসূত্র স্থাপন করতে পারতেন। তবে তখনো তামাক গাছ এবং তামাকজাত পন্য সবকিছুই আমেরিকায় সীমাবদ্ধ ছিল। তাহলে পুরো বিশ্বব্যাপী তামাক ছড়িয়ে পড়ল কীভাবে?
তামাকের ব্যবহার শুরুর পর প্রায় ২৪০০ বছর পর্যন্ত এই পন্য শুধুমাত্র আমেরিকায়ই সীমাবদ্ধ থাকে। মায়ান সভত্যার কাছ থেকে এই পন্য রেড ইন্ডিয়ানদের কাছে পৌছায়। ১৪৪২ সালে কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করলে রেড ইন্ডিয়ানরা কলম্বাসকে দেবদূত মনে করেন এবং উপহার হিসেবে অন্যান্য পন্যের সাথে তামাক পাতাও দেন। তবে কলম্বাস তা গ্রহন করেনা। কিন্তু আরেক স্প্যানিশ নাবিক রদ্রিগো দে জেরজো তামাক গ্রহণ করে এবং প্রথম কোনো ইউরোপীয় হিসেবে ধূমপান করেন। তিনি স্পেনে ফিরে গিয়েই প্রথম প্রকাশ্যে ধূমপান শুরু করেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ তার নাক মুখ থেকে ধোঁয়া বের হওয়া দেখে তাকে শয়তানের রূপ মনে করে ও ৭ বছরের জন্য কারাগারে প্রেরণ করে।
কারাগারেই রদ্রিগো এর কাছ থেকে অন্যান্য আসামীরা ধূমপানে আসক্ত হয়। খুব কম সময়ের মধ্যেই এসকল আসামীদের কাছ থেকে ধূমপান সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি তামাক আসক্ত স্প্যানিশ ডাক্তার মোনার্দেস ঘোষণা দেন তামাক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারি এবং তামাকের মাধ্যমে ৩৬ রকমের রোগ নিরাময় সম্ভব। যা রাতারাতি তামাককে পুরো ইউরোপব্যাপী জনপ্রিয় করে তুলে এবং স্প্যানিশ রাজ পরিবার এর সুযোগ নিয়ে এক চটিয়া তামাক ব্যবসা শুরু করে। কারণ শুধুমাত্র মধ্য আমেরিকায় তামাকের চাষ হত এবং তা ছিল স্পেনের কলোনি। এমনকি স্প্যানিশ সরকার তামাকের বীজ অন্য কোথাও বপন বা চুরির শাস্তি মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করেন।
তবে ১৬০০ সালে স্যার ওয়াল্টার রিলি ভার্জিনিয়ার এক গভর্নরের মাধ্যমে একটি পাইপ লাভ করেন এবং তা ইংল্যান্ডের রানীকে উপহার হিসেবে দেয়। রানীর পছন্দ না হলেও রাজা প্রথম জেমস তামাককে একটি লাভজনক পণ্য হিসেবে দেখেন এবং সদ্য প্রতিষ্ঠিত কলোনি ভার্জিনিয়ায় এর চাষ শুরু করার নির্দেশ দেন। মধ্য আমেরিকা থেকে চুরি করা তামাক বীজ থেকে ভার্জিনিয়ায় শুরু হয় সবথেকে বড় আকারে তামাকের চাষ। কিছুদিনের মধ্যেই উপকারি পণ্য হিসেবে পুরো ব্রিটেন জুড়ে শুরু হয় তামাক সেবন। তামাক শুধুমাত্র ব্রিটেনেই থেমে থাকেনা বরং চলে যায় সকল ব্রিটিশ কলোনিতে। এভাবেই তামাক এশিয়ার বাজারে প্রবেশ করে। কিন্তু পাইপ থেকে সিগারেটে রুপান্তরিত হয় কীভাবে?
পাইপ ব্যবহার কিছুটা কষ্টকর ছিল এবং তৈরি করতেও অনেকটা সময় ব্যয় হত। তাই মার্কিন কিছু ব্যবসায়ী একটি বিশেষ পেপারের মধ্যে তামাক ঢুকিয়ে অন্য পাশে ফোমের ফিল্টার তৈরি করে বিক্রি শুরু করে। তবে এগুলো হাতে প্রস্তুত ছিল এবং অনেক ব্যায়বহুল ও ছিল। যে কারণে শুধুমাত্র ধনী আমেরিকান এবং ব্রিটিশরাই সিগারেট সেবন করতে পারত। তবে ১৮৮৫ সালে জেমস ব্যানসন সিগারেট তৈরির একটি যন্ত্র আবিষ্কার করে। যা প্রতিদিন এক হাজার সিগারেট প্রস্তুতে সক্ষম ছিল। তিনি মার্কিন টোবাকো নামক একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। রাতারাতিই এটি সাধারণ জনগণের কাছে সর্বোচ্চ সংখ্যক সিগারেট পৌঁছে দেয়।
জনগণ ধনীর পণ্য হিসেবে পরিচিত সিগারেটকে সল্প মূল্যে পাওয়ার কারণে খুব সহজেই গ্রহণ করেন এবং সিগারেটকে উপকারি পণ্য হিসেবে ব্যবহার শুরু করে। যার ফলে ১৯০০ সালের পূর্বেই পুরো পৃথিবীতে সিগারেট ছড়িয়ে পড়ে। পৃথিবীর প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ মানুষ সিগারেটের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। তামাকজাত পণ্য বা সিগারেটের আবিষ্কার ৮ হাজার বছর আগে হলেও ১৮৯২ সাল পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা নিকোটিন এর পিওর ফর্ম জানত না। নিকোটিন এর পিওর ফর্ম আবিষ্কার এর পরই বিজ্ঞানীরা তামাকের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে ধারণা লাভ করে। কিন্তু তখন সিগারেট এর প্রচার এতটাই ছিল যে এই আবিষ্কার চাপা পড়ে যায়।
তবে ১৯৪০ সালে নাৎসী বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন সিগারেট লাংস এর ক্যান্সার এর জন্য দায়ী। পুরো জার্মানি জুড়ে ব্যাপক প্রচারণা চালান। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে আমেরিকা এবং ইউরোপীয় বিজ্ঞানীরাও একই তথ্য আবিষ্কার করে। ১৯৬০ সাল নাগাত আমেরিকা এবং ব্রিটেনে রেডিও, টেলিভিশন এমনকি বিলবোর্ডও সিগারেটের প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়। সেই থেকেই পুরো বিশ্বে সিগারেটের প্রচার এবং নিষিদ্ধ করার জন্য প্রচেষ্টা চলে আসছে।