সরকারের ব্যাংক নির্ভরতায় চাপে পড়বে বেসরকারি বিনিয়োগ

নগদ অর্থের টান চলছে ব্যাংকগুলোতে। নানা সংকটে সময়মতো ঋণ দিতে পারছে না তারা। ফলে ধারাবাহিক কমছে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি। এরই মধ্যে বাজেট ঘাটতির অর্থায়নে সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা করেছে। সরকারের এ ব্যাংক নির্ভরতায় বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ চাপে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ব্যাংকার, ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে ব্যাংকিং খাত তারল্য নিয়ে কিছুটা চাপে আছে। ফলে ঋণের চাহিদা মেটাতে অনেক ব্যাংক হিমশিম খাচ্ছে। এর মধ্যে সরকার বাজেট ঘাটতি মেটাতে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে অধিক হারে ঋণ নিলে তারল্য সংকট আরও বাড়বে। ফলে কাঙ্ক্ষিত ঋণ থেকে বঞ্চিত হবে বেসরকারি খাত। যার কারণে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ব্যাংক ঋণের সুদ হারেও।

‘সমৃদ্ধির সোপানে বাংলাদেশ, সময় এখন আমাদের’ শিরোনামে ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। বিশাল অঙ্কের এ বাজেটের ঘাটতি ধরা হয়েছে এক লাখ ৪৫ লাখ ৩৮০ কোটি টাকা। আর ঘাটতির অর্থায়নে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায়। এটি কার্যকর হলে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে মন্তব্য করেছেন ব্যাংকাররা।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, অনেক ব্যাংক এখন তারল্য সংকটে রয়েছে। সরকার ব্যাংক থেকে যে পরিমাণ ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা করেছে তা বাস্তবায়ন করলে এ সংকট আরও বাড়বে।

দেবপ্রিয় বলেন, সরকার ব্যাংক খাত থেকে এই বিশাল অঙ্কের ঋণ নিলে ব্যক্তি বিনিয়োগকারীরা টাকা কোথা থেকে পাবে? এতে করে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহ আরও বাধাগ্রস্ত হবে বলে জানান তিনি।

ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ব্যাংকগুলোতে এখন নগদ অর্থের সংকট রয়েছে। এর মধ্যে সরকার এ খাত থেকে যদি বেশি ঋণ নেয় তাহলে আরও চাপে পড়বে। এ অবস্থায় বাজেট ঘাটতির অর্থায়ন করা কঠিন হবে। আর এটি করা হলে ব্যাংক ঋণের সুদহারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

এদিকে চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৪২ হাজার ২৯ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল। সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৩০ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা করা হয়। এর মধ্যে গত ২৯ মে পর্যন্ত সরকার ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিয়েছে ১৮ হাজার ৬৩৯ কোটি টাকা।

ঘাটতি অর্থায়নের আরেকটি বড় উৎস হচ্ছে সঞ্চয়পত্র। ব্যাংক আমানতের সুদের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি মুনাফা হওয়ায় সঞ্চয়পত্র বিক্রি ধারাবাহিক ভাবেই বাড়ছে। চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকার। কিন্তু অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসেই (জুলাই-মার্চ) এ খাত থেকে নেট বিনিয়োগ এসেছে ৩৯ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকা। যা অর্থবছরের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার দেড়গুণ। তবে সংশোধিত বাজেটে সঞ্চয়পত্রের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এটিও ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন এ খাত সংশ্লিষ্টরা। আসন্ন ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে ২৭ হাজার কোটি টাকা।

এদিকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকটের কারণে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিক কমেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, চলতি বছরের এপ্রিল শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক শূন্য ৭ এক শতাংশ। ঋণের এ হার গত ৫৭ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর পরও যদি বাজেট ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ উৎস হিসেবে সরকার ব্যাংক খাতকে বেছে নেয় তাহলে আরও সংকটে পড়বে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংক নির্ভরতা বেসরকারি বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করবে।

তিনি বলেন, ব্যাংকগুলো তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী ঋণ বিতরণ করে। এর মধ্যে সরকার ব্যাংক থেকে যদি বেশি ঋণ নেয় তাহলে বেসরকারি খাতে ঋণ কমে যাবে এটাই স্বাভাবিক। এতে করে বেসরকরি খাতে বিনিয়োগ কমে যাবে। তাই নতুন বাজেটে ঘাটতি পূরণে ব্যাংক খাতের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে বৈদেশিক উৎস, ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফান্ড, ইনফ্রাস্ট্রাকচার বন্ড ও অন্যান্য ফিন্যান্সিয়াল টুলসের ওপর জোর দেয়ার দাবি জানান ব্যবসায়ীদের এ শীর্ষ নেতা।

এদিকে ব্যাংক খাত নিয়ে বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি উদ্বেগ প্রকাশ করছেন সরকারের খোদ অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল নিজেও। সর্বশেষ বাজেট বক্তৃতায় তিনি ব্যাংকিং খাতের সংস্কারে ৬ দফা প্রস্তাব তুলে ধরে বলেন, ‘ব্যাংক ও আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা সুদৃঢ় করার জন্য একটি ব্যাংক কমিশন প্রতিষ্ঠার কথা আমরা দীর্ঘদিন ধরে শুনে আসছি। বিষয়টি নিয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করব।’

ব্যাংক খাতের সংকটের একটি ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, এ খাতের গুরুত্বপূর্ণ কিছু জায়গায় এ পর্যন্ত কোনো সংস্কার হয়নি। ঋণ শোধে ব্যর্থ হলে সেই চক্র থেকে ঋণগ্রহীতার বেরিয়ে আসার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। আমরা এবার কার্যকর ইনসলভেন্সি আইন ও দেউলিয়া আইনের হাত ধরে ঋণ গ্রহিতাদের এক্সিটের ব্যবস্থা নিচ্ছি। পাশাপাশি আর্থিক খাতের সংস্কারে পর্যায়ক্রমে ব্যাংকের মূলধনের পরিমাণ বাড়ানো, ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা এবং বন্ড মার্কেটকে গতিশীল করার পদক্ষেপ নেয়া হবে।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)