সংসদে ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেট
২০১৯-২০ অর্থবছেরের বাজেট অধিবেশন হয়েছে জাতীয় সংসদে। এটি দেশের ৪৮তম এবং বর্তমান সরকারের তৃতীয় মেয়াদের প্রথম বাজেট। ‘সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ : সময় এখন আমাদের, সময় এখন বাংলাদেশের’ শিরোনামে প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। দেশের ৪৮ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাজেট এটি।
বৃহস্পতিবার বেলা ৩টায় স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অধিবেশন শুরু হয়। বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। নতুন অর্থমন্ত্রী হিসেবে এটি তার প্রথম বাজেট। যদিও গত সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে অনেক বাজেট প্রণয়নে পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন তিনি।
শুরুতে দাঁড়িয়ে বাজেট বক্তৃতা শুরু করলেও পরবর্তীতে স্পিকারের অনুমতি নিয়ে অর্থমন্ত্রী নিজ আসনে বসে প্রস্তাবিত ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন।
প্রস্তাবিত বাজেট পাস হবে আগামী ৩০ জুন। ১ জুলাই থেকে শুরু হবে নতুন অর্থবছর।
এর আগে মন্ত্রিসভা ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের অনুমোদন দেয়। বাজেট ঘোষণার আগে দুপুর ১টার একটু পর জাতীয় সংসদ ভবনে বিশেষ বৈঠকে মন্ত্রিসভা এ অনুমোদন দেয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় সংসদ ভবনে মন্ত্রিসভার এ বিশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
অসুস্থ থাকার কারণে আসতে দেরি হওয়ায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে ছাড়াই মন্ত্রিসভার বৈঠক শুরু হয়। পরে অর্থমন্ত্রী অ্যাপোলো হাসপাতাল থেকে সরাসরি বৈঠকে যোগ দেন।
চলতি অর্থবছরে মূল বাজেটের আকার দাঁড়ায় চার লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। তবে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, রাজস্ব আদায় করতে না পারা এবং উন্নয়ন প্রকল্পে পরিকল্পনা অনুযায়ী অর্থখরচ করতে না পারায় চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের আকার নির্ধারণ করা হয় চার লাখ ৪২ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা। অর্থাৎ আগামী বাজেটের আকার সংশোধিত বাজেট থেকে ৮০ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা বেশি।
প্রস্তাবিত বাজেটে মোট আয়
আসছে অর্থবছরে মোট রাজস্ব আয় তিন লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। এটি পরবর্তীতে বাড়তে কিংবা কমতে পারে। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এটি ছিল তিন লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা এবং সংশোধিত বাজেটে ছিল তিন লাখ ১৬ হাজার ৬১২ কোটি টাকা।
রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) অধীন আয় তিন লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এনবিআর-বহির্ভূত কর ব্যবস্থা থেকে ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এছাড়া সরকারের বিভিন্ন সেবার ফি, হাসপাতালের টিকিট মূল্য, সেতুর টোলসহ বিভিন্ন খাত থেকে ৩৭ হাজার ৭১০ কোটি টাকা আদায়ের পরিকল্পনা রয়েছে।
অভ্যন্তরীণ আয়ের বাইরে আগামী অর্থবছরে বিদেশ থেকে চার হাজার ১৬৮ কোটি টাকা অনুদান পাওয়ার আশা করছে সরকার। অনুদান যেহেতু ফেরত দিতে হয় না, তাই এ পরিমাণ অর্থ পাওয়া গেলে মোট আয় দাঁড়াবে তিন লাখ ৮১ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে চার হাজার ৫১ কোটি টাকা অনুদানের আশা করলেও বাজেট সংশোধনকালে তা কমিয়ে তিন হাজার ৭৮৭ কোটিতে নামিয়ে আনা হয়।
ব্যয়ের খাত
পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার মধ্যে নতুন অর্থবছরের পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে তিন লাখ ১০ হাজার ২৬২ কোটি টাকা, যা আগে অনুন্নয়ন ব্যয় হিসেবে উল্লেখ করা হতো। এর মধ্যে সরকারের আবর্তক ব্যয় দুই কোটি ৭৭ লাখ ৯৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধে ৫২ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে চার হাজার ২৭৩ কোটি টাকা ব্যয় হবে। এছাড়া সরকারের মূলধন খাতে ৩২ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।
নতুন অর্থবছরে উন্নয়ন খাতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে দুই লাখ ১১ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা। সেখান থেকে এরইমধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাবদ দুই লাখ দুই হাজার ৭২১ কোটি টাকা ব্যয় প্রস্তাব অনুমোদন করেছে জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিল (এনইসি)। এছাড়া এডিপিবহির্ভূত বিশেষ প্রকল্প, স্কিম ও কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিতে বাকি অর্থ ব্যয়ের প্রস্তাব করবেন অর্থমন্ত্রী।
সাধারণত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান ও গ্রামীণ অবকাঠামোর সংস্কার কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে সরকার। এ খাতে নতুন অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হয়েছে দুই হাজার ১৮৪ কোটি টাকা।
ঘাটতি অর্থায়ন
অনুদান না পেলে নতুন বাজেটে ঘাটতি দাঁড়াবে এক লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। এটি মোট দেশজ উৎপাদনের পাঁচ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবে, কোনো দেশের বাজেট ঘাটতি পাঁচ শতাংশের মধ্যে থাকলে তা ঝূঁকিপূর্ণ নয়। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এক লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকার ঘাটতি ধরা হয়েছিল, যা ছিল জিডিপির ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। রাজস্ব আয় কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় অর্জন না হওয়ায় সংশোধিত বাজেটে ঘাটতি বাড়িয়ে এক লাখ ২৫ হাজার ৯২৯ কোটি টাকা ধরা হয়, যা জিডিপির পাঁচ শতাংশ। তবে বিদেশি অনুদান পাওয়া গেলে নতুন অর্থবছরে ঘাটতি দাঁড়াবে এক লাখ ৪১ হাজার ২১২ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৪ দশমিক ৮ শতাংশ।
এ ঘাটতি মেটাতে বিদেশ থেকে ৭৫ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। সেখান থেকে বিদেশি ঋণ পরিশোধে ব্যয় হবে ১১ হাজার ৫৪২ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে নিট বৈদেশিক ঋণ নেয়া হবে ৬৩ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা। বাকি ৭৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা দেশের ভেতর থেকে ঋণ নেয়া হবে, যার মধ্যে তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংক খাত থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
চলতি অর্থবছর ব্যাংক খাত থেকে ৪২ হাজার ২৯ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৩০ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।
এছাড়া ব্যাংক-বহির্ভূত খাত থেকে নিট ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়া হবে, যার মধ্যে সঞ্চয়পত্র থেকে ২৭ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাত থেকে তিন হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য থাকলেও উচ্চ সুদহারের কারণে মানুষ এ খাতে বেশি বিনিয়োগ করেছে। ফলে সংশোধিত বাজেটে লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ৪৫ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়।
জিডিপির প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি
আসছে বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৮ দশমিক ২০ শতাংশ। চলতি অর্থবছর ধরা হয় ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। তবে এ প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে বলে প্রত্যাশা করেন অর্থমন্ত্রী। নতুন অর্থবছরের জন্য আকার প্রাক্কলন করা হচ্ছে ২৮ লাখ ৮৫ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। এছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের দাম কম থাকবে। ফলে অন্যান্য পণ্যের দাম কিছুটা নিম্নমুখী থাকবে। এদিক বিবেচনায় নতুন বাজেটে মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।