ব্যাংকে ঢুকছে প্রযুক্তি
কয়েক দশক ধরে মানুষের জীবন ও অর্থনীতিতে ডিজিটাল সেবা ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে। হাতের মুঠোয় থাকা ডিভাইসে একটা ছোট্ট ক্লিক করে পেয়ে যাচ্ছি নানা ধরনের সেবা। বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান উঠে আসছে, আবার এদের প্রতিযোগীও তৈরি হচ্ছে।
তবে একটা খাত কিন্তু এখনো নিজের আমলাতান্ত্রিক ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। বলছি ব্যাংকিং খাতের কথা। এখনো ধনী দেশেও নাগরিকেরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা, চেক দিয়ে লেনদেন করা, এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে স্বাক্ষরের জন্য ফাইল যাওয়া—ব্যাংকের এমন ধারায় অভ্যস্ত।
দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, অবশেষে ব্যাংক খাতকেও প্রযুক্তি নাড়া দিতে পারছে। এশিয়াতে প্রায় এক বিলিয়ন মানুষ লেনদেনে অ্যাপস ব্যবহার করছেন। পশ্চিমা বিশ্বে তো মোবাইল ব্যাংকিং ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে। ৪৯ শতাংশ মার্কিন নাগরিকের ফোনই যেন এক একটা ব্যাংক। এই প্রযুক্তিতে আরও নতুন নতুন বিষয় যোগ করছে টেক জায়ান্ট কোম্পানিগুলো। চলতি বছরের ২৫ মার্চ নিজস্ব ক্রেডিট কার্ড এনেছে প্রযুক্তি জায়ান্ট মার্কিন প্রতিষ্ঠান অ্যাপল। ক্রেডিট কার্ড বানাতে গোল্ডম্যান স্যাকসের সঙ্গে অংশীদারত্ব করেছে তারা। অন্যদিকে, বিভিন্ন ধরনের টিকিট কিনতে ও বিল সেবা দিতে পেমেন্ট সার্ভিস চালু করার প্রস্তাব এনেছে ফেসবুক।
আসলে ব্যাংকের জন্য প্রযুক্তির এই ছোঁয়ার গুরুত্ব ব্যাপক, কারণ ব্যাংক কোনো সাধারণ প্রতিষ্ঠান নয়। সারা বিশ্বে ব্যাংকে মোট সম্পত্তির পরিমাণ ১০০ ট্রিলিয়ন ডলার। ব্যাংক খাতের সংকট অর্থনীতিতেও সংকট তৈরি করে। ২০০৮-০৯ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায় সময় যা বেশ ভালোভাবেই বুঝেছে বিশ্ব। আসলে ব্যাংক–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ও রাজনীতিবিদেরা সব সময়ই প্রযুক্তিগত পরিবর্তন থেকে ব্যাংককে দূরে রাখতে চেয়েছেন। তবে এটা ঠিক নয়। এতে প্রযুক্তির কারণে আর্থিক ব্যবস্থার উন্মুক্ততা সহজেই ঝুঁকি অতিক্রম করতে পারে।
আসলে স্মার্টফোনের যুগে ব্যাংক বেশ ধীরেই প্রবেশ করেছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিধিনিষেধের কারণেই তা সম্ভব হয়নি। তবে ‘দেরি হওয়া’ ‘একেবারে না হওয়ার’ চেয়ে ভালো। নতুন নতুন ব্যবসায়িক মডেল তৈরি হচ্ছে। এশিয়াতে ই-কমার্সের সঙ্গে পেমেন্ট অ্যাপস যুক্ত হয়েছে। আলিবাবা টেনসেন্টের মতো কোম্পানিগুলো দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার বাজারকে দখল করে নিচ্ছে। এই নেটওয়ার্কগুলো ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত, তবে গ্রাহকের সঙ্গে বেশি সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করে তারা।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ব্যাংকগুলো এখন গ্রাহকদের ডিজিটাল পণ্য অফার করছে। পাঁচ মিনিটে আমানত হিসাব খুলে দেয় জেপি মরগ্যান। পশ্চিমা ব্যাংগুলোর সঙ্গে কাজ করছে পেপ্যাল। পেপ্যাল একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান, যারা অর্থের স্থানান্তর বা হাতবদল ইন্টারনেটের মাধ্যমে করা সহায়তা দিয়ে থাকে। নতুন প্রযুক্তি সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করছে তরুণসমাজকে। বাবা–মায়েরা যেসব ব্যাংক পছন্দ করতেন, তরুণেরা এখন তা পছন্দ করেন না। তাঁরা নির্ভর করেন ১০০ ভাগ ডিজিটাল ব্যাংকের (নিওব্যাংক) ওপর। ১৮ থেকে ২৩ বছর বয়সী ১৫ শতাংশ মানুষ ডিজিটাল ব্যাংকের ওপর নির্ভর করেন। আর তাই বড় ব্যাংকগুলো তাদের পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনছে। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় চারটি ব্যাংক গ্রাহকের আবেদনপত্র আরও নিখুঁত করার জন্য বছরে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে।
প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সুবিধা ব্যাপক। ব্যয় কমে, কমে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। বিশ্বের তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলো যদি এক-তৃতীয়াংশ খরচ কমিয়ে ফেলে, তাহলে ব্যক্তিপ্রতি বছরে সঞ্চয় হবে ৮০ ডলার। ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় নেদারল্যান্ডসের ব্যাংকের শাখা বেশি ছিল। এখন তা যুক্তরাষ্ট্রের এক-তৃতীয়াংশ। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির কারণে বিশ্বে প্রথাগত ব্যাংকিং মাধ্যমের লেনদেনকে ছাড়িয়ে গেছে অনলাইনভিত্তিক লেনদেন। এর ফলে ব্যাংক খাতের সামগ্রিক কর্মদক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়ছে, অন্যদিকে খাতটির মুনাফা বৃদ্ধিতে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। নির্ভুল লেনদেনের মাধ্যমে গ্রাহকের সন্তুষ্টিও বাড়ছে। ব্যাংকের লেনদেনের চেয়ে আসলে এখন অ্যাপস ব্যবহারকারী বন্ধুর কাছে টাকা যাওয়া সহজ। ঝুঁকিও কম।
অবশ্য পরিবর্তন সব সময় ঝুঁকিমুক্ত—এমনটা বলা যাবে না। আর্থিক ব্যবস্থার গুরুত্ব অর্থনীতিতে প্রকট তাই নতুন উদ্ভাবন অনেক সময় হাঙ্গামাও সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯৫০ সালে ক্রেডিট কার্ড আসার পর থেকে কেনাকাটায় একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে ঠিকই, সে সঙ্গে গ্রাহকের মধ্যে একটা ঋণ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। আবার হ্যাকারদের ডিজিটাল প্রতারণার ফাঁদে পড়ছে ব্যাংকিং খাত। এতে ব্যাংক খাতে নতুন নতুন ডিজিটাল ঝুঁকির সৃষ্টি হচ্ছে।
তবে ব্যাংকের হীন যে গোপন বিষয়, এর মধ্যে রয়েছে পশ্চাদপসরণতা, অদক্ষতা ও লুকোছাপা ভাব। কিন্তু ব্যাংকব্যবস্থাকে দুর্বল ও অনুন্নত রেখে শক্তিশালী অর্থনীতির আশা করা যায় না কোনোভাবেই। এ অবস্থায় অর্থনৈতিক গতি বাড়াতে স্মার্টফোন নতুন বিপ্লব এনেছে।