দুখিনী কবি ‘চন্দ্রাবতী’
“ধারাস্রোতে ফুলেশ্বরী নদী বহি যায়/ বসতি যাদবানন্দ করেন তথায়।। ভট্টাচার্য্য বংশে জন্ম অঞ্জনা ঘরণী/ বাঁশের পাল্লায় তাল-পাতার ছাউনী।। বাড়াতে দারিদ্র-জ্বালা কষ্টের কাহিনী/ তার ঘরে জন্ম নিলা চন্দ্রা অভাগিনী।। সদাই মনসা-পদ পূজি ভক্তিভরে/ চাল-কড়ি কিছু পাই মনসার বরে।। শিব-শিবা বন্দি গাই ফুলেশ্বরী নদী/ যার জলে তৃষ্ণা দূর করি নিরবধি।। বিধিমতে প্রণাম করি সকলের পায়/ পিতার আদেশে চন্দ্রা রামায়ণ গায়।।” স্বরচিত রামায়ণের ভূমিকায় চন্দ্রাবতী নিজের আত্মপরিচয় দিয়েছেন এভাবেই। কাব্যের কথা নয়। চন্দ্রাবতী আসলেই অভাগিনী। তার জীবনে যে বেদনাবিধুরতা এসেছে, যে সকরুণতা এসেছে, তা খুব কম মানুষের জীবনেই এসে থাকে। অত্যন্ত করুণভাবে তরুণ বয়সেই সমাপ্তি ঘটেছে এই কবির জীবনের। নাটকীয়তায় পরিপূর্ণ করুণ জীবনের কারণে পালা রচয়িতা থেকে নিজেই হয়ে উঠেছেন পালাগানের করুণরসে সিক্ত শোকাচ্ছাদিত নায়িকা।
চন্দ্রাবতী মধ্যযুগের উল্লেখযোগ্য কবিদের মধ্যে অন্যতম এবং বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম বাঙালি নারী কবি৷ এই বিদূষী নারী অন্যান্য কাব্য ছাড়াও পিতার আদেশে বাংলা ভাষায় রামায়ণ রচনা করেছিলেন। তার নিবাস ছিল বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ জেলার অন্তর্গত পাঠবাড়ী বা পাতুয়ারী গ্রামে। তাঁর পিতা মনসা মঙ্গল কাব্যের অন্যতম রচয়িতা বংশীদাস ভট্টাচার্য এবং মাতার নাম সুলোচনা। চন্দ্রাবতী অজস্র লোকগীতি রচনা করেন। নৌকার মাঝির কণ্ঠে, ব্রতে, বিয়েতে এবং প্রতিদিনের গার্হস্থ্য জীবনে আজও শোনা যায় চন্দ্রাবতীর গান। ষোল শতকের সামাজিক-আর্থনীতিক অবস্থার স্বরূপ প্রতিফলিত হয়েছে তার রচনায়। চন্দ্রাবতীর স্মৃতি, রচনা, জীবন ও সাহিত্য আজও বহমান স্রোতোধারার মতো গবেষক ও পর্যটককে আকর্ষণ করে।
চন্দ্রাবতীর রচিত কাব্যগুলি হলো-মলুয়া, দস্যু কেনারামের পালা (মনসার ভাসান, রচনাকাল: ১৫৭৫ শকাব্দ), রামায়ণ। ড. দীনেশচন্দ্র সেন ১৯৩২ সালে চন্দ্রাবতীর রামায়ণ প্রকাশ করেন। লৌকিক মানবিক ও কিছু মৌলিক উপাদান সংযোগের ফলে এই রামায়ণ কাব্যটি বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে। দীনেশচন্দ্রের মতে, মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর মেঘনাদবধ কাব্যের সীতা-সরমার কথোপকথনের অংশটি ‘চন্দ্রাবতীর রামায়ণ’ থেকে গ্রহণ করেছিলেন। মৈমনসিংহ গীতিকায় তার নিজের রচিত ‘মলুয়া’ গীতিকাব্যে এবং তার জীবনী অবলম্বনে পরবর্তী সময়কার কবি নয়ানচাঁদ ঘোষ রচিত ‘চন্দ্রাবতী’ পালায় তার কথা পাওয়া যায়৷ তার জীবনের ট্র্যাজেডি নিয়ে রচিত লোকগাঁথা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অবিভক্ত ময়মনসিংহ জেলার মানুষের মুখে মুখে ফিরে এসেছে। তার রচিত রামায়ণ কিছুকাল আগেও ময়মনসিংহ অঞ্চলের মেয়েরা বিয়ে উপলক্ষে গান করত। চন্দ্রাবতী নিজের কাব্য ছাড়াও পিতা বংশীদাসের মনসামঙ্গল কাব্যের অনেকাংশ রচনা করেছিলেন।
চন্দ্রাবতীর গান ময়মনসিংহে সুপরিচিত এবং সুপ্রচারিত। চন্দ্রকুমার দে বলেছেন, ‘শ্রাবণের মেঘভরা আকাশতলে ভরা নদীতে যখন পাইকগণ সাঁজের নৌকা সারি দিয়া বাহিয়া যায়, তখন শুনি সেই চন্দ্রাবতীর গান, বিবাহে কুলকামিনীগণ নববরবধূকে স্নান করাইতে জলভরণে যাইতেছে, সেই চন্দ্রাবতীর গান, তারপর স্নানের সঙ্গীত, ক্ষৌরকার বরকে কামাইবে তাহার সঙ্গীত, বরবধূর পাশাখেলা, তার সঙ্গীত সে কত রকম।’ চন্দ্রাবতীর লেখা পাশাখেলার একটা সঙ্গীত-
কি আনন্দ হইল সইগো রস বৃন্দাবনে,
শ্যামনাগরে খেলায় পাশা মনমোহিনীর সনে।
আজি কি আনন্দ
উপরে চান্দোয়া টাঙ্গান নীচে শীতলপাটি,
তার নীচে খেলায় পাশা জমিদারের বেটি
আজি কি আনন্দ
চন্দ্রাবতী কহে পাশা খেলায় বিনোদিনী
পাশাতে এবার হারিল শ্যামগুণমণি!
আজি কি আনন্দ
চন্দ্রাবতীর জীবনের ইতিহাসটি অনেক করুণ। পরমা সুন্দরী ছিলেন তিনি। বাল্যকাল থেকেই বাবার দেখাদেখি কবিতা লেখা শুরু করেন। গানও লিখতেন। শুধু লিখতেনই না, নিজেও গাইতেন। এত সব গুণের কারণে বহু সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিই চন্দ্রাবতীকে পাবার জন্য উৎসুক ছিলেন। কিন্তু চন্দ্রাবতীর এ বিষয়ে কোনো আগ্রহই ছিল না। তাঁর নিজের খেয়াতরী তখন জয়ানন্দের ঘাটে বাঁধা। মৃদু মৃদু বসন্ত বাতাসে তা দোদ্যুল্যমান।
জয়ানন্দ ছিলেন চন্দ্রাবতীর জনম জনমের সাথী। বাল্যকাল থেকেই পরিচয় তাঁদের। দুজনেই এক সাথে পড়ালেখা করতেন, খেলা করতেন। বেড়ে উঠার সাথে সাথে ভালবাসার রঙ চড়ায় দুজনের মনে। কবিতার ভাষায় প্রকাশ ঘটে তার। দু’জন দুজনকে কবিতা লিখে ভালবাসা জানাতেন। আর এভাবেই এক সময় অন্য বিষয় নিয়েও কবিতা রচনা শুরু করেন তাঁরা। কবি দ্বিজবংশীর পদ্মপুরাণে চন্দ্রাবতী এবং জয়ানন্দ, দুজনেরই কবিতা রয়েছে। দিনে দিনে দুজনের ভালবাসা প্রণয় গাঢ় হতে থাকে। চন্দ্রাবতী প্রাণ-মন সব উজাড় করে দেয় জয়ানন্দের কাছে। তাদের দুজনের বিয়ের কথাবার্তা প্রায় পাকাপাকি। ঠিক এরকম সময়েই ভিমরতিতে ধরে জয়ানন্দকে। এক মুসলমান মেয়ের প্রেমে পড়ে যায় সে। শুধু প্রেমে পড়েই খান্ত হয় না, নিজে মুসলমান হয়ে ওই মেয়েকে বিয়ে করে ফেলে জয়ানন্দ।
জয়ানন্দের এই হঠকারী আচরণ বিশাল এক আঘাত হয়ে আসে চন্দ্রাবতীর জন্য। অল্প বয়সের কোমল হৃদয় ভেঙে খান খান হয়ে যায় তাঁর। এই আঘাত সামলাতে শিবপূজায় নিজেকে উজাড় করে দেন তিনি। বাবার কাছে দুটো প্রার্থনা জানান তিনি। ফুলেশ্বরী নদীর তীরে একটি শিবমন্দির গড়ে দেওয়া এবং আজীবন কুমারী থাকার বাসনা। কন্যাবতসল পিতা আদরের কন্যার দু’টো আবদারই মেনে নেন। চন্দ্রাবতী নিজেকে উজাড় করে দিয়ে শিববন্দনা করতেন। এর পরে যেটুকু অবসর সময় থাকতো, সেই সময়ে রামায়ণ লিখতেন। চন্দ্রাবতীর এই রামায়ণ এখনও ময়মনসিংহের কোনো কোনো অঞ্চলে মুখে মুখে গীত হয়ে থাকে। দীনেশ্চন্দ্র সেন তাঁর পূর্ববঙ্গ গীতিকায় চন্দ্রাবতীর এই রামায়ণকে লিপিবদ্ধ করেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য চন্দ্রাবতী এই রামায়ণ শেষ করতে পারেন নাই। সীতার বনবাস পর্যন্ত গিয়ে থেমে গেছেন। থেমে গেছেন বলার চেয়ে থেমে যেতে বাধ্য হয়েছেন বলা উচিত।
জয়ানন্দের কাছ থেকে চিঠি এলো। দেখা করতে চায় চন্দ্রাবতীর সাথে। চন্দ্রাবতী পিতাকে সব জানালেন। পিতা অসম্মতি জানালেন। তাঁর ভাষ্য হচ্ছে, তুমি যে দেবতার পূজোয় মন দিয়েছো, তাঁরই পূজো করো। চন্দ্রাবতী জয়ানন্দকে পালটা জবাব দিয়ে জানালেন যে, দেখা করা সম্ভব না। তুমি বরং শিবের চরণে মনপ্রাণ সমর্পণ করো। তিনি সর্ব দুঃখহারী। চিঠি পেয়ে উলটো ঘটনা ঘটলো। অনুতপ্ত জয়ানন্দ ছুটে এলো শিবমন্দিরের দিকে। চন্দ্রাবতী তখন শিবপূজায় বিভোর। মন্দিরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। চন্দ্রাবতীকে ডাকার সাহস হলো না জয়ানন্দের। আঙিনার ভিতর সন্ধ্যামালতীর ফুল ফুটেছিল। তা দিয়েই কপাটের উপরে চারছত্র কবিতা লিখে বিদায় নেয় জয়ানন্দ। পূজো শেষ করে দরজা খুলে বের হলেন চন্দ্রাবতী। চোখে পড়লো জয়ানন্দের লেখা কবিতা দরজার কপাটে। কবিতা পড়ে বুঝলেন দেবমন্দির কলংকিত হয়েছে। চন্দ্রাবতী জল আনতে ফুলিয়ার (ফুলেশ্বরী) ঘাটে গেলেন। গিয়ে বুঝলেন সব শেষ হয়ে গেছে। অনুতপ্ত জয়ানন্দ ফুলিয়ার স্রোতধারায় নিজের জীবনস্রোত বিলীন করে দিয়েছে। এই ভয়াবহ শোকে পাথর হয়ে যান চন্দ্রাবতী। এর পরে আর কোনো কবিতা লেখেন নাই তিনি। যে কারণে রামায়ন অসমাপ্ত থেকে যায়। তারপর একদিন শিবপূজার সময় নিজেও বিদায় নেন এই ধরিত্রী থেকে।
চন্দ্রাবতীর মৃত্যু নিয়ে সবাই অবশ্য একমত নন। নয়ানচাঁদ নিজেও তার চন্দ্রাবতী পালাগানে চন্দ্রাবতীর মৃত্যু নিয়ে কিছু বলেন নাই। কারো কারো মতে নদীর ঘাটে মৃত অবস্থায় জলে জয়ানন্দের লাশ ভাসতে দেখে তীব্র অনুশোচনায় চন্দ্রাবতীও পরবর্তীতে ফুলেশ্বরী নদীর জলে ঝাঁপিয়ে জয়ানন্দের মত অনুগামী হন। আবার কারো মতে, জয়ানন্দের জলে ডুবে আত্মহত্যা বা মৃত্যুর কিছুদিন পরপরই শোকাবিভূত চন্দ্রাবতী মর্মান্তিক আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন। দীনেশ্চন্দ্র সেন মৈমনসিংহ-গীতিকার ভূমিকায় লিখেছেন, ‘প্রবাদ এই যে, প্রেমাহতা চন্দ্রা জয়চন্দ্রের শব দর্শন করার অল্পকাল পরেই হৃদরোগে লীলা সংবরণ করেন।’ ব্রজেন্দ্রকুমার দে তার মঞ্চনাটক ‘কবি চন্দ্রাবতী- তে দেখিয়েছেন যে, শোক এবং অপমান থেকে বাঁচার জন্য চন্দ্রাবতী নিজেই গিয়েই ফুলেশ্বরীর বুকে ঝাপিয়ে পড়ে আত্মাহুতি দিয়েছেন।
তবে যেভাবেই হোক না, গভীর হৃদয়ে গভীর আঘাত নিয়ে তীব্র মনোযাতনায়, অসামান্য প্রতিভাবান বাংলার এই প্রথম নারী কবির মৃত্যু হয়েছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তার মত অভাগিনী বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিরল। নিজেকে ধুপের মত পুড়িয়ে তিনি যে কাব্য সৌরভ পরিবেশন করে গিয়েছেন অনাগত সময়ের জন্য তার খবর শহরে মানুষেরা রাখে নি। কিন্তু পল্লীর মানুষেরা তা ভোলে নি। তাদের মুখে গীত হয়ে দুখিনী কবি চন্দ্রাবতী আজো বেঁচে আছেন।