সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের সেবার মান উন্নত করতে ১২ কোটি টাকার যন্ত্রাংশ গায়েব
সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে সেবার মান উন্নত করতে বরাদ্দের ১২ কোটি টাকার পুরাটাই হজম হয়ে গেছে! সাতক্ষীরা থেকে ইতোমধ্যে বিল পরিশোধ হলেও যন্ত্র আসেনি একটাও। এমনকি ভারী এসব যন্ত্রাংশ সদর হাসপাতালের যেসব কর্মকর্তা (সার্ভে কমিটি) গ্রহণ করেছেন তারাও জানেননা। তাদের স্বাক্ষর নকল করে এসব যন্ত্র চলমান অবস্থায় বুঝে পেয়েছেন বলে লিখেও দেয়া হয়েছে। মঙ্গলবার সকালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব হাছান মাহমুদসহ ৩ সদস্যের একটি টিম আকর্ষিক ঢাকা থেকে সাতক্ষীরায় এসে বরাদ্দকৃত টাকার এসব ভারী যন্ত্র দেখতে চাইলে থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়ে।
সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন ডা. রফিকুল ইসলামের সাথে এব্যাপারে কথা বললে তিনি জানান, মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে আমি হাসপাতালে আসার পর আমার সেল ফোন বাজতে থাকে। রিসিভ করতেই আমাকে জানানো হয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ৩ সদস্যের একটি টিম আসছে আপনি হাসপাতালে থাকেন। কথা বলতে হবে।
তিনি আসার আহব্বান জানানোর ৫ থেকে ৭ মিনিটের মধ্যে টিম হাসপাতালে ঢুকে পড়েন এবং জানতে চান বিগত ১৭-১৮ অর্থ বছরে ১২ কোটি টাকা বরাদ্দের উপর ভারী যন্ত্রাংশ সরবরাহের জন্য টেন্ডার আহবান করা হয়। সেই টেন্ডার অনুযায়ী ঢাকার মার্কেন্টাইল ট্রেড কো: লি: এসব মালামাল সরবরাহের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। যথারীতি তারা ১২ কোটি টাকার স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন মালামাল সরবরাহ করেছেন এবং তা আপনারা বুঝে পেয়েছেন মর্মে লিখেও দিয়েছেন। পরিদর্শনে আসা কর্মকর্তারা এসব মালামাল কোথায় আছে দেখতে চান।
তাদের প্রশ্ন শুনে সিভিল সার্জন ডা. রফিকুল ইসলাম হতবাক। তিনি বলেন, ওই সময়ে আমি সিভিল সার্জনের দায়িত্বে ছিলাম না। কে ছিল খুঁজতে গিয়ে নাম আসে ডা. তৌহিদুর রহমানের। ১৩.০৩.১৭ থেকে ১১.১১.১৮ পর্যন্ত ডা. তৌহিদুর রহমান সাতক্ষীরায় সিভিল সার্জনের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনিই বলতে পারবেন। পরে সাবেক সিভিল সার্জন ডা. তৌহিদুর রহমান, সিভিল সার্জন অফিসের হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন, স্টোর কিপার এ কে ফজলুল হক চলে আসেন সিভিল সার্জনের রুমে।
সেখানে আরও ডাকা হয় এসব পণ্য বুঝে নেয়া সার্ভে কমিটির সদস্য ডা. ফরহাদ জামিল, ডা. আসাদুজ্জামান মেডিসিন ও ডা. শরিফুল ইসলাম সার্জনকে। তাদেরকে দেখানো হয়, আপনারা ভারী এসব যন্ত্রাংশ চলমান অবস্থায় বুঝে পেয়েছেন লিখে স্বাক্ষর করে দিয়েছেন। কোথায় সেসব যন্ত্রাংশ। তারা ৩জনই ব্যাপারটি জানেন না বলে পরিদর্শন কমিটিকে জানান। একই সাথে তাদের স্বাক্ষর দেখে নকল বলে ৩জনই দাবী করেছেন।
সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন অফিসের স্টোর অফিসার ডা. জয়ন্ত সরকার জানান, আমি স্টোর অফিসার সমস্ত মালামাল আমি সার্ভে কমিটির নিকট থেকে গ্রহণ করবো, তারপর স্টোর কিপার ফজলুল হক তা বিভিন্ন দপ্তরে সিভিল সার্জনের অনুমতি সাপেক্ষে প্রেরণ করবেন। অথচ আমি জানিনা বা এধরণের কোন যন্ত্রাংশ আমি গ্রহণ করিনি। তিনি আরও বলেন, তৎকালীন সিভিল সার্জন ডা. তৌহিদুর রহমান ও স্টোর কিপার ফজলুল হক এসব যন্ত্রাংশ গ্রহণ করেছেন মর্মে অডিট টিম আমাদেরকে জানিয়েছেন। তবে এখন কিছু কার্টুন এসেছে তার মধ্যে কি আছে, কোন যন্ত্রাংশ না ইট ভরা বাক্স তাও জানিনা। যেটি আমরা কেউ রিসিভ করেনি।
সিভিল সার্জন অফিসের হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন বলেন, ১৭ ১৮ অর্থ বছরে সিভিল সার্জন ডা. তৌহিদুর রহমানের সময়ে উক্ত টাকার টেন্ডার আহবান করা হয়। সে অনুযায়ী ঢাকার মার্কেন টাইল ট্রেড কো. আমাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন। তারা সরবরাহ করেছেন পোর্ট এ্যাবল এক্স-রে মেশিন ৪টি যার প্রতিটির মূল্য ২৩ লাখ টাকা। আল্ট্রাসনোগ্রাফি মেশিন ৪টি, সিলিং ওটি যন্ত্রাংশ এক সেট, নেবু লাইজার মেশিন ১৮টা, স্টীল ল্যাম্প ১টা, চোখ পরীক্ষার মেশিন ১টা যা প্রায় ৮৫ হাজার টাকা দাম, রেটিনোস্কপ ১টা, ডেন্টাল যন্ত্রাংশ এক সেট, সাকশান ইউনিট ১টা ও ওয়াটার বাথ রয়েছে। এসব পণ্য চলতি অর্থ বছরের বিভিন্ন সময়ে হাসপাতালে এসেছে।
কোন যন্ত্রাংশই এখানে আসেনি, ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ করা হয়েছে এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সম্প্রতি আসা কিছু মেশিনপত্র বারান্দায় পড়ে আছে। এখন আসবে কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিদেশ থেকে আনতে হয় তাই দেরি হয়েছে। তাহলে যন্ত্রাংশ সরবরাহের আগে বিল পরিশোধ হল কিভাবে?
এদিকে এসব যন্ত্রাংশ বুঝে নেয়া সার্ভে কমিটির আহবায়ক ডা. আসাদুজ্জামান (মেডিসিন) জানান, এবিষয় সম্পর্কে আমি বা আমরা কেউ কিছুই জানিনা। কবে কমিটি হয়েছে আর কারা করেছে, কি করেছে, তা বলতে পারবো না। তবে ঢাকা থেকে অডিট টিম আসার পর জানতে পেরে বৃহস্পতিবার সিভিল সার্জন বরাবর লিখিত অভিযোগ করে বিষয়টি প্রতিকার দাবী করেছি। ঘটনার সাথে যারা সংশ্লিষ্ট তাদেরকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার জন্য বলা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কমিটির দায়িত্ব পালন করা কালীন সেই সব স্বাক্ষর বা সিল নকল করা বা স্ক্যানিং করে বসানো হয়েছে বলে মনে করছি।
কমিটির সদস্য সদর হাসপাতালের সাবেক আরএমও ডা. ফরহাদ জামিল জানান, ঘটনা সবই শুনেছেন আমরা কিছুই জানিনা। এটাতে আমাদেরকে ব্যবহার করে কেউ কেউ ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে। তবে আপনার সাথে সরাসরি বসে কথা বলবো বলে জানান তিনি। এছাড়াও কমিটির আরেক সদস্য ডা. শরিফুল ইসলামকে রাতে ফোন দেয়া হলে তার ফোনটি অন্য কেউ রিসিভ করে বলেন, স্যার এখন অপারেশনে আছেন, এক ঘণ্টা পরে কথা বলেন।
সাবেক সিভিল সার্জন ডা. তৌহিদুর রহমানের সাথে কথা হলে তিনি সেলফোনে জানান, বিধি মোতাবেক টেন্ডারের মাধ্যমে ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে। যথাযথ ভাবে মালামাল এসেছে এবং বুঝে নেয়া হয়েছে। পার্ট পার্ট বিলও পরিশোধ হয়েছে। এখানে কোন দুর্নীতি বা অনিয়মের আশ্রয় নেয়া হয়নি। তিনি আরও বলেন, আমি ২ মাস অসুস্থ, এখন ঢাকায় আছি চিকিৎসার জন্য। স্বাক্ষর জালিয়াতির বিষয়ে তিনি শুনে বলেন, আমি ঢাকায় আছি। ফিরে এসে দেখছি কি করা যায়।
সিভিল সার্জন ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, এই ঘটনাটি যখন ঘটেছে তখন আমি দায়িত্বে ছিলাম না। সুতরাং কি হয়েছে আর কি করেছে আর কারা করেছে তার কিছুই বলতে পারবো না। তবে ঘটনাটি ক্ষতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে পারেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, এখানে অনেক হাত লম্বা মানুষ-জন রয়েছে, আমার কিছুই করার নেই।
তিনি অপর এক প্রশ্নের জবাবে আরও জানান, যে সার্ভে কমিটির নাম ও স্বাক্ষর দেখানো হয়েছে, তারা সকলে মিলে একটি অভিযোগ দিয়েছেন আমার কাছে। আমি তদন্ত টিম গঠন করে রিপোর্ট আসলে তখন দেখবো কি করা যায়। পাশাপাশি দিন দুপুরে এত বড় দুর্নীতি সদর হাসপাতালসহ আশেপাশের মানুষ জানার পর বেশ হতবাক হয়েছেন।