সাতক্ষীরার ঐতিহ্যবাহী লোকসংস্কৃতির একটি চৈত্রসংক্রান্তির ‘দেলনাচ’
সাতক্ষীরার মানুষের জীবন এ অঞ্চলের জল, মাটি, আবহাওয়াকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে । আর এর সাথে সাথে এখানকার লোকসংস্কৃতির ও বিকাশ ঘটেছে । লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন অনুসঙ্গের মধ্যে লোকনৃত্য ‘দেলনাচ’ অন্যতম।
‘কোন ব্যাকরণিক অর্থ ছাড়াই লোক মানুষের অংশগ্রহণে তাদের জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নাকে কেন্দ্র করে সমাজে যে নৃত্য পরিবেশিত হয় তাই লোকনৃত্য। ’
সময়ের সঙ্গে লোকনৃত্যের আংশিক পরিমার্জিত হয়ে সমাজ জীবনে তা কখনো উৎসব আবার কখনো ধর্মাচরণের অঙ্গ হয়ে উঠেছে। চৈত্র সংক্রান্তি তথা বর্ষবরণ উৎসবের মধ্যদিয়ে লোকনৃত্যের বিভিন্ন ধারার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ লক্ষ্য করা যায় দেশেরবিভিন্ন অঞ্চলে।
ভৌগলিক অবস্থান ভেদে বর্ষ বিদায়-বরণের চৈত্রসংক্রান্তি ভিন্ন ভিন্ন নামে বিভিন্ন অঞ্চেলে পরিচিত।
যেমন উত্তরাঞ্চলে চৈত্র সংক্রান্তিকে বলে বিষুয়া, চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিউ বা বিহু, বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে সংগ্রাইন বা মাস পইলা পূজা, ময়মনসিংহ অঞ্চলে সাক্রাইন বা হাক্রাইন, ফরিদপুরে চত্তির পূজা আর খুলনা তথা সাতক্ষীরায় দেউল বা দেল।
বিভিন্ন অঞ্চলে বর্ষবরণ উৎসবের যে সকল লোকনৃত্য আমরা দেখতে পায় তার ভিতরে সাতক্ষীরায় দেউলের নাচ উল্লেখযোগ্য।
সাতক্ষীরায় চৈত্র সংক্রান্তিকে কেন্দ্র করে দেল বা দেউল নাচ হয়ে থাকে পাড়া মহল্লায়। ‘দেল’ হলো মহাদেবের অর্ধশায়িত ভঙ্গির মূর্তি। যোগীরা শিবপূজায় শিবের পাঁচালি পাঠ করে। পাঁচালি পাঠ করা হতো গানের মতো সুরে সুরে। পাঁচালি গায়কদের পায়ে নূপুর থাকত, নূপুর পায়ে তারা নেচে নেচে শিবের গান করত। পাঁচালি গায়কদের বলা হতো ‘বালা’ এবং সে গানকে বলা হতো ‘বালাকি গান’।
চৈত্র সংক্রান্তিতে সাতক্ষীরার এ দেলনাচ নড়াইল, যশোর ও খুলনার কোনো কোনো এলাকায় শিবের গাজন হিসেবে প্রচলিত আছে। গাজন হলো, গা অর্থ গ্রাম আর জন অর্থ মানুষ। গাজন অর্থ গ্রামের মানুষের উৎসব। সন্ন্যাসীরা চৈত্র মাস ধরে গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে গাজনের দল নিয়ে গাজন নাচ পরিবেশন করে। এ সময় শিব পূজা বা চড়ক উপলক্ষে চতুর্থাশ্রম বা সন্ন্যাসীরা ঢাক ও কাঁসর বাজিয়ে নৃত্যসহ সম্মিলিত কণ্ঠে শিবের গাজন পরিবেশন করে। গাজনের দলের একজনকে জটাধারী শিব আবার কোন কোন দলে গৌরী বা পার্বতীও সাজিয়ে নিয়ে বেড়ায়। দলের অন্যদেরও থাকে বিচিত্র ঢঙের সাজ এবং বহুরূপী নাচও পরিবেশন করে। লোকনাট্যের আঙ্গিকে সে গান চৈত্রের দিনগুলোতে লোকমানুষের মাঝে বিনোদনের খরাক মিটায়।
মানুষ বর্ষ বিদায় ও বর্ষবরণ উৎসবের সন্ধিকাল চৈত্রসংক্রান্তি পালন করে আসছে নানা আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। বিগত বছরের গ্লানি মুছে দিয়ে, নতুন সম্ভাবনাময় বছরের প্রত্যাশায় পালন করে আসছে এসব লোকাচার। এসব লোকাচারের বিভিন্ন অনুসঙ্গের মত লোকনৃত্যগুলো দীর্ঘ পরিভ্রমণ ও পর্যবেক্ষণের মধ্যদিয়ে ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনের মাধ্যমে পালিত হচ্ছে নাগরিক জীবনেও। লোকনৃত্যগুলো কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে সকলের প্রিয় হয়ে উঠেছে ।
সাতক্ষীরা জেলা পূজা উদযাপন কমিটির সহ সভাপতি অনিত মূখার্জী দৈনিক সাতক্ষীরাকে বলেন , শিবের ভক্তরা সারদিন উপবাস থেকে পড়া মহল্লায় দেলনাচ করে থাকে । যার মাধ্যমে ধর্মীয় বিভিন্ন কাহিনীর চিত্র ফুটে ওঠে ।
সাতক্ষীরা জেলা শিল্পকলার সদস্য সচিব মুশফিকুর রহমান মিল্টন বলেন , সাতক্ষীরা অঞ্চলে যে সকল লোক নৃত্য আছে তার মধ্যে দেলনাচ অন্যতম । আমরা সরকারি বেসরকারি ভাবে এ সকল লোক নৃত্যে পৃষ্ঠ পোষকতা করে আসছি ।