বিলুপ্তির পথে মাটির দেয়ালে গাঁথা বাংলাঘর
মাটির দেয়ালে গাঁথা জোড় বাংলাঘর এখন আর দেখা মেলে না। দেখা মেলে না গোলপাতায় কিম্বা খড়ে ছাওয়া মাটিরঘর। বাড়ির সামনে সেই বৈঠকখানা বা দহলুজঘরও এখন বিলুপ্ত। চিরচেনা গ্রামও এখন অচেনা লাগে। শান্তির নীড় মাটির ঘরের স্থান দখল করেছে ইট-পাথরের দালান। গরীবের এসি মাটির দেয়ালে গাঁথা বাংলাঘর এখন বিলুপ্তির পথে। সাতচালা কিম্বা আটচালা মাটির বাংলাঘর এখন আর নজরে পড়ে না। গ্রামে সম্ভ্রান্ত পরিবারের সেই দহলুজঘরও এখন দেখা যায় না। অথচ এই দহলুজ ঘরে এক সময় বসতো গ্রামের মানুষের আড্ডা। বিনোদন আর গল্পের আসর বসতো বৈঠকখানায়। গ্রামের সাধারণ মানুষ তাদের সুখ, দু:খ, হাসি, কান্না, মান-অভিমান, আনন্দ-বেদনা প্রকাশ করতো এ দহলুজ ঘরে বসে। হুকোয় টান দিয়ে জমিয়ে আড্ডা দিতেন মোড়ল কিম্বা মাতব্বরের দহলুজে। সেই হুকাও নেই, সেই দহলুজও নেই।
আধুনিকতার ছোঁয়া আর কালের আবর্তে গ্রামের ঐতিহ্যবাহী মাটির ঘর এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। ঝড়-বৃষ্টি থেকে বাঁচার পাশাপাশি তীব্র গরম ও কনকনে শীতে আদর্শ বসবাস-উপযোগী মাটির তৈরি এসব ঘর আগের মতো এখন আর তেমন একটা নজরে পড়ে না।জানা যায়, আশির দশকেও গ্রামে কাচা ঘরবাড়ি দেখা যেত। নব্বইয়ের দশকেও অতীতের সাক্ষী হিসেবে গ্রামে দেখা যেত জোড় বাংলাঘর।
জেলার ৭৮টি ইউনিয়নের প্রত্যেক গ্রামে মাটির তৈরি ঘর ছিল গরীবের এসি। ইট-পাথরের তৈরি পাকা দালানের সংখ্যা ছিল গ্রামে হাতেগোনা। সেই দিন বদলে গেছে। এখন হাতেগোনা দু’একটি মাটিরঘর দেখা যায়। অধিকাংশ বাড়ি এখন ইট পাথরের তৈরি।
জানা যায়, এঁটেল মাটি কাদায় পরিণত করে দুই-তিন ফুট চওড়া করে দেয়াল তৈরি করা হত। ১০-১৫ ফুট উঁচু দেয়ালের উপর কাঠ বা বাঁশের চাল তৈরি করে খড়-কুটা, গোলপাতা, টালী, অথবা ঢেউটিন দিয়ে ছাওয়া হতো। মাটি কুপিয়ে ও পানি দিয়ে কাদায় পরিণত করার পদ্ধতিকে জাব বলা হয়। জাব কেটে তা সুচারুভাবে গেঁথে ভাজে ভাজে তৈরি করতে হয় দেয়াল। দেয়ালের একেকটি ভাজে লুকানো একেকটি পরিবারের সুখ-দু:খের কাহিনী। দেয়ালের একেকটি ভাজের পুরত্ব তিন থেকে চার ফুট। এভাবে পাঁচ থেকে ছয়টি ভাজ শেষ হবার পর দেয়ালের উচ্চতা দাঁড়ায় ১৫-১৮ ফুট। যিনি মাটির চাপ গেঁথে দেয়াল ও বাঁশ দিয়ে চাল তৈরি করেন তাকে ঘরামি বলা হয়। ঘরের বারান্দা ও চালের ধরণের উপর ভিত্তি করে ঘরকে বিভিন্নভাবে হয়। চারিপাশে বারান্দা বিশিষ্ট ঘরকে আটচালা এবং তিনপাশে বারান্দা বিশিষ্ট ঘরকে সাতচালা ঘর বলা হয়। গৃহিণীরা মাটির দেয়ালে বিভিন্ন রকমের আলপনা একে ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতেন। শৈল্পিক আলপনায় ফুটে উঠতো নিপুন কারুকার্য।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বর্ষা মৌসুমে মাটির ঘরের ক্ষতি হয় বলে ইট-সিমেন্টের ঘর নির্মাণে এখন উৎসাহী হচ্ছে মানুষ। এক সময় সাতক্ষীরার বিভিন্ন গ্রামে অনেক পরিবার মাটির ঘরে বাস করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করলেও প্রবল বর্ষণে মাটির ঘরের ক্ষতি হয় বলে এখন কাচা ঘর ফেলে পাকাঘর নির্মাণে ঝুকছেন বেশি।
ভূমিকম্প বা বন্যা না হলে একটি মাটির ঘর শত বছরেরও বেশি স্থায়ী হয়। কিন্তু কালের আবর্তে দালান-কোঠা আর অট্টালিকার কাছে হার মানছে মাটির ঘর।