স্মার্ট পুরুষ ঘরের কাজও করে

রান্নাবান্না কি ছেলেদের কা জ?’
‘আমি টাকা রোজগার করি, ঘরের কাজটাজ কিছু করতে পারব না’ কিংবা ‘বাচ্চাদের পড়ালেখার খোঁজ রাখার দায়িত্ব আমার না, আমাকে অফিস করতে হয়, হাজারটা মানুষের কথা ভাবতে হয়’।
এ রকম বেশ গর্বের সঙ্গেই বলেন অনেক পুরুষ। মনের মধ্যে একটা বিশ্বাস তাঁরা সযত্নে লালন করেন ঘরের কাজ করা তাঁর ‘পুরুষ’ পরিচয়ের জন্য অবমাননাকর—ঘরের কাজের সব দায়িত্ব বাড়ির নারীর। তা সেই নারী স্ত্রী, মা-বোন বা কন্যা যা–ই হোক না কেন।
এদিকে সেই স্ত্রী, মা, বোন বা কন্যা কর্মজীবী হলেও পুরুষদের সে ধারণা কিন্তু পাল্টায় না! কর্মজীবী হয়েও ঘরের কাজ করতে হবে নারীকেই। এই ধারণা, বিশ্বাস আর আচরণ বংশপরম্পরায় অনেক পুরুষই লালন করে থাকেন।
পুরুষেরা মনে করেন অর্থ উপার্জন করেই তাঁরা পরিবারে যে অবদান রাখছেন, সেটাই যথেষ্ট। ঘরের কাজ? সেটা করবে বাড়ির মেয়ে-বউরা। কিন্তু নোবেল বিজয়ী মার্কিন অর্থনীতিবিদ গ্যারি বেকার বিয়ের অর্থনৈতিক উৎকর্ষ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দেখিয়েছেন ঘরে-বাইরে দুই জায়গাতেই স্বামী-স্ত্রীর কাজগুলো সহযোগিতামূলক হলে বিয়ে একটি উৎপাদনশীল বাজার হিসেবে পরিগণিত হতে পারে। গবেষণায় তিনি পরিষ্কার উল্লেখ করেছেন যে বাইরের কাজ (অর্থের জন্য কাজ) আর ঘরের কাজ (বিনা অর্থে কাজ) দুই–ই বিয়েকে অর্থনৈতিকভাবে সফল করতে পারে! ফলে বাইরের কাজে অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে একক আধিপত্য প্রকাশের সুযোগ পুরুষের নেই।

অপর দিকে দাম্পত্য সম্পর্ক, সামাজিক দক্ষতা আর সন্তান লালন–পালনের প্রশ্নেও ঘরের কাজে পুরুষের অংশগ্রহণ জরুরি। কোনো কোনো সময় বিষয়টি আবার শুধু পুরুষ সঙ্গীর ওপর নির্ভর করে না। বাড়ির নারী নিজেও একটা ভ্রান্তির মধ্যে থাকেন এবং বিশ্বাস করেন যে ঘরের কাজে পুরুষ একবারেই অপাঙ্ক্তেয়। এটাও কিন্তু একধরনের ‘অবজারভেশনাল লার্নিং’। পরিবারে বিষয়টির চর্চা না থাকায় পুরুষদের যে ঘরের কাজ করতে হবে এবং করাটাই যে আধুনিকতা, সেই বোধটি তৈরি হয় না।

পাশ্চাত্যের একজন লেখক মন্তব্য করেছেন ‘রান্নাঘরের সিংক দিয়েই ব্রেইন-ড্রেইন ঘটে থাকে’ অর্থাৎ এককভাবে একজন নারী ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকতে থাকতে তাঁর অন্যান্য কর্মদক্ষতা হারিয়ে ফেলে। মার্কিন ইতিহাসবিদ সুসান স্ট্রেসার তাঁর নেভার ডান: আ হিস্ট্রি অব আমেরিকান হাউসওয়ার্ক বইতে দেখিয়েছেন সত্তরের দশকে নারীরা যখন কর্মমুখী হওয়া শুরু করলেন, সেই সময় যুক্তরাষ্ট্রে ফাস্ট ফুডের চর্চা বেড়ে যায়। অর্থাৎ বাড়িতে রান্না করার হার কমে যায় বলেই ফাস্ট ফুডের প্রসার ঘটে। সেই সময়ের আরেক গবেষণায় দেখা যায় কানাডায় নারীরা ঘরের কাজে নিজেদের সময়কে কমিয়ে দিচ্ছে আর পুরুষেরা ঘরের কাজে নিজেদের অংশগ্রহণ বাড়াচ্ছেন বিশেষ করে সন্তান পালনে পুরুষেরা আগের চেয়ে দ্বিগুণ সময় দেওয়া শুরু করে। এতে করে সংসারে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বাড়তে থাকে।

দাম্পত্যে ভারসাম্য আনতে পরিবারে দুজনের কর্মবণ্টন সুষম হতে হবে। পরস্পরের সম্পর্কের মধ্যে পারস্পরিক সম্মানবোধ থাকতে হবে। কাজের বেলায় ‘পুরুষের কাজ’ বা ‘নারীর কাজ’ বলে ভাগ করা চলবে না। এতে দাম্পত্য সম্পর্ক জোরালো হয়। আধুনিক যুগে একজন স্মার্ট মানুষ তিনি পুরুষ হন বা নারীই—তিনি কোনো কাজকেই হেয় মনে করবেন না ভয় পাবেন না। স্মার্ট নারী যেমন রকেট চালাতে পারদর্শী হবেন তেমনি একজন স্মার্ট পুরুষ রান্নাঘরের বাসন-পাতিল পরিষ্কার করতে সক্ষম হবেন। একজন পুরুষ তাঁর পেশাগত কাজের পাশাপাশি ঘরের কাজও তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে ভাগ করে নেবেন। রান্না করা, ঘর পরিষ্কার করা আর সন্তান লালন-পালনে অংশ নেওয়া থেকে শুরু করে ঘরের প্রতিটি কাজ করবেন। কথাটি কিন্তু এমন নয় যে ঘরের কাজে নারীকে পুরুষ সহায়তা করবেন—কথাটি হচ্ছে ঘরের কাজ নারী-পুরুষ দুজনেই ভাগ করে নেবেন। এতে করে দাম্পত্য সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়, এমনটিই প্রমাণিত হয়েছে রুয়ান্ডায় পরিচালিত একটি গবেষণায়। ‘বান্দেবেরেহো’ শীর্ষক ওই প্রকল্পের গবেষণায় দেখানো হয়েছে ঘরের কাজে পুরুষের অংশগ্রহণ দাম্পত্য সহিংসতাকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমিয়ে দিয়েছে।

এ ছাড়া ঘরের কাজে যদি বাবা-মাকে একসঙ্গে কাজ করতে দেখে তখন শিশুর বিকাশ অনেক সুষম হয়—তার কগনিটিভি ডেভেলপমেন্ট সফলভাবে ঘটতে থাকে। এবং তার মধ্যে অপরের প্রতি সম্মানবোধ তৈরি হয়। সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধি হয় এবং পরিণত বয়সে সে–ও পরিবারের কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করে। নিজেকে নতুন শতকের যোগ্য স্মার্ট পুরুষ হিসেবে প্রমাণ করতে হলে নিজেকে ঘরের কাজে পারদর্শী করে তুলুন, নারীর সঙ্গে সমানতালে ঘরের কাজ করুন।

কীভাবে ঘরের কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করবেন
* এলোমেলোভাবে হঠাৎ করে বেশি বেশি ঘরের কাজ করতে অতি উৎসাহী না হয়ে পরিবারের নারীদের সঙ্গে আলোচনা করে ঘরের কোন কাজটি কতটুকু করবেন, সেটি ঠিক করুন।
* পরিবারের শিশুদেরও ঘরের কাজে অংশ নিতে উৎসাহিত করুন।
* কখনোই মনে করবেন না যে আপনি ঘরের কাজ করে আপনার পরিবারের নারী সদস্যকে সাহায্য করছেন; বরং এটা ভাবুন যে আপনাদের ঘরের কাজগুলো আপনারা দুজনেই করছেন।
* ঘরের কাজ করাকে একটি নৈমিত্তিক বিষয় হিসেবে মনে করুন। একদিন ঘরের কাজে অংশ নিয়েই ফলাও করে প্রচারের কিছু নেই।
* কতটুকু কাজ করলেন, এটি নিয়ে হিসাব–নিকাশ করবেন না।
* গৃহস্থালির কাজকে উপেক্ষা বা হেয় করবেন না। আপনার কোনো বন্ধু বা স্বজন এ ধরনের কাজ করতে থাকলে তাঁকে বিদ্রূপ করবেন না।
* ঘরের কাজগুলোকে সহজভাবে করতে হলে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করুন—উন্নত চুলা, ঘর পরিষ্কারক ইত্যাদির ব্যবহার বাড়িয়ে দিন।
* বাড়িতে গৃহস্থালির কাজগুলো করতে গিয়ে অগ্নিকাণ্ডসহ সব ধরনের নিরাপত্তাব্যবস্থার দিকে মনোযোগী হোন।
* আপনি পুরুষ বা নারী যে–ই হোন না কেন, ঘরের কাজের জন্য আপনার কর্মক্ষেত্রকে অজুহাত হিসেবে নেবেন না।
* কর্মক্ষেত্রে আপনি যতটুকু দক্ষতা দেখাচ্ছেন, ঘরের কাজেও সেই পরিমাণের দক্ষতা দেখাতে চেষ্টা করুন। ঘরে-বাইরে সমানভাবে স্মার্ট হোন।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)