১০৭ বছর পর টাইটানিকের আতঙ্ক ফিরল নরওয়েতে
টাইটানিক ছবির ভয়ংকর সেই দৃশ্যটি মনে আছে নিশ্চয়। জাহাজটি সাঁই সাঁই গতিতে এগিয়ে চলেছে। যাত্রীরা যে যার মতো করে উপভোগ করছেন দৈত্য জাহাজের ভেতর। কেউ সমুদ্রের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে কেউবা খাওয়া-দাওয়ায় ব্যস্ত। ঠিক এমনই মুহূর্তে একটা বিশাল বরফের চলমান পাহাড় জাহাজটিকে ধাক্কা দেয়। ছিদ্র হয়ে যায় জাহাজে।
একপর্যায়ে দু’টুকরো হয়ে যায় জাহাজটি। এর পরই সেই ভয়ংকর দৃশ্যের অবতারণা। জাহাজ থেকে সমুদ্রের হিমশীতল পানিতে পড়ে যাওয়ার পর বেঁচে থাকার আকুতি। মৃত্যু পথযাত্রীদের আহাজারে সমুদ্রের গোটা এলাকার আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে যায়।
টাইটানিকের সেই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটল নরওয়ের পশ্চিম উপকূলে। এমভি ভাইকিং স্কাই জাহাজের ভেতর তখন বেশিরভাগ মানুষ মধ্যাহ্নভোজে ব্যস্ত। ঠিক তখনই প্রচণ্ডভাবে এদিক ওদিক দুলতে থাকে প্রকাণ্ড সেই জাহাজ। ১০ মিটারেরও বেশি উচ্চতার উত্তাল ঢেউয়ের নিচে বারবার যেন হারিয়ে যাচ্ছিল জাহাজটি। কয়েক তলাবিশিষ্ট ওই জাহাজের জানালার কাঁচ ভেঙে ভেতরে আছড়ে পড়তে থাকে লোনা পানি। ঐতিহাসিক টাইটানিক ডুবে যাওয়ার আগে যখন দিখণ্ডিত হয়ে যায়, দু’খণ্ড যখন খাঁড়া হয়ে ডুবে যেতে থাকে এবং মানুষগুলো, আসবাবপত্রগুলো যেভাবে মেঝের ওপর এপাশ ওপাশ গড়িয়ে যেতে থাকে- ঠিক তেমনি এই জাহাজের ভেতরকার অবস্থা দাঁড়ায়।
শনিবার ভয়াবহ এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। এ সময় চারদিকে ভয়াবহ এক আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। আরেকটি টাইটানিক দৃশ্য চোখের ওপর ভাসতে থাকে সবার। প্রকাশিত ভিডিওতে এ দৃশ্য ফুটে উঠেছে। এমন এক বিপদসঙ্কুল অবস্থায় জাহাজের ইঞ্জিন যায় বিকল হয়ে। প্রচণ্ড বাতাসের ধাক্কায় একবার এদিক, আবার ওদিক ঘুরে যেতে থাকে এমভি ভাইকিং স্কাই।
আর ভেতরে তখন বাঁচার করুণ আকুতি। দিশাহারা হয়ে পড়েন নাবিক ও যাত্রীরা। কেউ প্রার্থনা শুরু করে দেন। কেউ আর্তচিৎকারে শূন্য সমুদ্রের বাতাস ভারি করে তোলেন। মৃত্যুর এক ভয়ঙ্কর বিভীষিকা যেন তাদের সামনে হানা দেয়। ঠিক এমন অবস্থায় বিপদ সংকেত পাঠানো হয়। যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব উদ্ধার অভিযান শুরু করা হয়।
উদ্ধার অভিযানে নামে ৫টি হেলিকপ্টার। কয়েকটি জাহাজ। এর মধ্যে আবার উদ্ধারকাজে নামানো দুটি ফ্রেইটার জাহাজের ইঞ্জিন যায় বিকল হয়ে। প্রচণ্ড বাতাসের ধাক্কায় উদ্ধার অভিযান ব্যাহত হতে থাকে। দুটি উদ্ধারকারী হেলিকপ্টারের গতিপথ বাধ্য হয়ে পরিবর্তন করে দেয়া হয়।
অবস্থার বর্ণনা দিয়ে নরওয়ের মোরে ওগ রোমসডাল কাউন্টির পুলিশ বলেছে, এমভি ভাইকিং স্কাই জাহাজের ইঞ্জিন বিকল হয়ে গিয়েছিল। এতে তখন প্রায় দেড় হাজার ছিলেন। ক্যাপ্টেন বিপদসংকেত পাঠানোর পর উদ্ধার অভিযান শুরু হয়েছে। উদ্ধার কাজে অংশ নেয়া একটি ফ্রেইট- হ্যাগল্যান্ড ক্যাপ্টেনের ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। প্রচণ্ড বাতাস আর উত্তাল ঢেউয়ের কারণে এমনটা ঘটেছে। একই কারণে এমভি ভাইকিং স্কাইয়ের যাত্রীদের উদ্ধারে নামানো দুটি হেলিকপ্টারকে তাৎক্ষণিকভাবে হ্যাগল্যান্ড ক্যাপ্টেনের নাবিকদের উদ্ধারে গতিপথ পাল্টে দেয়া হয়।
নরওয়ের স্থানীয় সময় বিকেল ২টার দিকে এমভি ভাইকিং স্কাই থেকে বিপদসঙ্কেত পাঠানো হয়। বলা হয়, এর ইঞ্জিন বিকল হয়ে গেছে। এতে জাহাজটি বিক্ষিপ্তভাবে ঢেউয়ের ওপর দুলছিল কলার খোসার মতো। তবে যাত্রীদের সৌভাগ্য যে, এ সময় জাহাজটি ডুবে যায়নি। তাহলে সত্যি সত্যি আরেকটি টাইটানিক ট্র্যাজেডির সৃষ্টি হতো নরওয়ের পশ্চিম উপকূলে।
অনেকটা পরে এমভি ভাইকিং স্কাইয়ের একটি ইঞ্জিন সচল হয়। ফলে তা খুব ধীরগতিতে উপকূলের কিছুটা কাছাকাছি আসতে সক্ষম হয়। সেখানে উদ্ধার কাজ চলছিল। ওই জাহাজে ছিলেন জন কারি নামে এক ব্যক্তি। তাকে হেলিকপ্টারে উদ্ধারের পর এনআরকে টেলিভিশনকে তিনি বলেছেন, ‘তখন আমরা মধ্যাহ্নভোজে ছিলাম। অকস্মাৎ দুলতে শুরু করল জাহাজ। জানালার কাঁচ ভেঙে গেল। তার ভেতর দিকে প্রচণ্ড বাতাসের সঙ্গে জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রবেশ করতে শুরু করল পানি। আর চারদিকে তখন এক ভয়ংকর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। মানুষ জীবনের মায়ায় চারদিকে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। ভয়ে বুক শুকিয়ে যায় সবার।’
হেলিকপ্টারে উদ্ধার করা হয়েছে জ্যানেট জ্যাকব নামে একজনকে। তিনি বলেছেন, ‘আমার জীবনে এত ভয়াবহতার মুখোমুখী কখনো হইনি। আমি তো প্রার্থনা শুরু করেছিলাম। প্রার্থনা করছিলাম জাহাজে থাকা প্রতিজন মানুষের নিরাপত্তার জন্য। এর মধ্যে হেলিকপ্টার এলো উদ্ধার করতে। তাতে যখন তোলা হলো সেই ট্রিপও ছিল ভয়াবহ।’
গণমাধ্যমের প্রকাশিত খবরে জানা যায়, এমভি ভাইকিং স্কাই যখন এমন বিপদে পড়ে তখন এর কাছেই ছিল মাছধরা বোট। জান এরিক নামে একজন জেলে তার বোট নিয়ে প্রথম উদ্ধার অভিযান শুরু করেন। তিনি আফটেনপোস্টেন পত্রিকাকে বলেছেন, ‘সৌভাগ্য সবার। ভয়াবহ এক পরিণতি থেকে রক্ষা পেয়েছেন জাহাজের মানুষগুলো। যদি ইঞ্জিন সচল না হতো তাহলে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই তা পাথরের ওপর আছড়ে পড়তো। আর তাতে ঘটে যেতো সেই টাইটানিকের মতো হৃদয়বিদারক ঘটনা।’
স্থানীয় সময় রাত ১০টা ৪০ মিনিট নাগাদ জাহাজটি থেকে ১৫৫ জনকে উদ্ধার করে তীরে আনা হয়েছে। এর মধ্যে আটজন আহত হয়েছেন। তার মধ্যে তিন জনের অবস্থা গুরুতর। জাহাজটির যাত্রীদের বেশিরভাগই বৃটিশ ও আমেরিকান।
সমুদ্র উদ্ধারবিষয়ক সার্ভিসগুলো বলেছে, জাহাজটি বিপদমুক্ত আছে এবং উদ্ধার অভিযান চলছে। নরওয়ের আবহাওয়াবিষয়ক ইনস্টিটিউট বলেছে, ১০ মিটারের চেয়েও উঁচু ঢেউ ঘটনার সময় ওই সমুদ্রে উত্তাল মৃত্যুকূপ তৈরি করে।