নাগরিক সাংবাদিকতা, ফেসবুক ও মূলধারার সাংবাদিকতা

ইদানীং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন অনেক জরুরি খবর চলে আসছে আগেই ।আগেই বলতে, আমাদের সক্রিয় পত্রিকা রেডিও ও টেলিভিশনে প্রচারের আগে। আগেও এমন হয়েছে । তবে গত এক দেড় দু’বছরে বিষয়টি খুব চোখে পড়ছে। গ্রামগঞ্জের মানুষের হাতে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছানোর পর আমাদের দেশে তথ্য দেয়া নেয়ার ক্ষেত্রে এসেছে এই বিশেষ বদল। এখন এক নাগরিক অন্য নাগরিককে জানিয়ে দিচ্ছেন শেষ মুহূর্তের তথ্য।

যদিও নানাভাবে নাগরিকেরা তথ্য দেয়া নেয়া চালু করেছিলেন গণমাধ্যম চালু হওয়ার শুরুতেই। এখন ইন্টারনেটের গতি বিষয়টিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। যে কারণে আলোচনাও করতে হচ্ছে নতুন করে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতেও এক নাগরিক থেকে অন্য নাগরিকে তথ্য দেয়ার এই সংস্কৃতি রয়েছে। সেখান থেকেই এই সংস্কৃতি পরিচিত পেয়েছে সিটিজেন জার্নালিজম বা নাগরিক সাংবাদিকতা নামে।আমরাও শুরু থেকে একে তাই বলছি।

আলোচনার সুবিধার জন্যে আমরা নাগরিক সাংবাদিকতার সাম্প্রতিক কয়েকটি উদাহরণ দেখে নিতে পারি। যেমন, বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি নানা ভাবে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে প্রথম প্রকাশ হয়। তার পর পত্রিকাগুলো তথ্য উপাত্ত যোগাড় করে খবর প্রচার করে । কাছাকাছি সময়ে সিলেটের শিশু সামিউল এবং খুলনার রাজনের ওপর অত্যাচারের বিষয়টিও প্রথম আসে ফেসবুকে। আর সব শেষে বলতে হয় কুমিল্লার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী তনু ধর্ষণ ও হত্যার খবর
প্রকাশ এবং পরে দেশময় প্রতিবাদের গল্প।

সাংবাদিকতার দিক থেকে যদি দেখতে চাই তাহলে বলতে হয়, নাগরিক সাংবাদিকতা, মূল ধারার সাংবাদিকতার ঠিক আগের ধাপ। একথা বলার সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চই প্রশ্ন উঠবে গণমাধ্যমের পাশাপাশি এত দিনতো নাগরিক সাংবাদিকতা চলছিল, তাহলে এখন এনিয়ে নতুন করে আলোচনার দরকার পড়ছে কেন ? খুব সহজ উত্তর, কারণ হচ্ছে বর্তমান সময় । এই সময়ে গণমাধ্যমের কিছু অগ্রগামী পাঠক অথবা দর্শকের পুরনো আগ্রহের সঙ্গে মিলেছে ইন্টারনেট। সব শেষ যোগ হয়েছে ফেসবুক। সব মিলিয়ে নাগরিক সাংবাদিকতা মূলসাংবাদিকতার গতিও বাড়িয়ে দিচ্ছে ।

এখন গণমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত যে কেউ বলবেন দেশের মূলসাংবাদিকতা চর্চায় নাগরিক সাংবাদিকতার প্রভাব বাড়ছে। আমি নিজে একজন গণমাধ্যম কর্মী হওয়ার বোধ থেকে বলতে পারি, অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি পাঠক বা দর্শক এখন সাংবাদিকতায় যুক্ত হচ্ছেন ।যুক্ত হতেন আগেও। আমাদের পত্রিকাগুলোতে চিঠিপত্র কলাম ছাপার রেওয়াজ দীর্ঘ দিনের। নাগরিক সাংবাদিকতা নামের আলাদা বিভাগও চালু করেছে কোন কোন গণমাধ্যম। শুধু পাঠকের লেখা দিয়েও দিনের পর দিন জনপ্রিয় পত্রিকা প্রকাশ করার নজির আছে আমাদের দেশেই। দেশের বাইরে গেলে আরো চকচকে উদাহরণ দেয়া যাবে।

নাগরিক সাংবাদিকতা নিয়ে আলোচনার এই পর্যায়ে যদি খুব সহজ করে এর সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে চাই তাহলে বলতে পারি, কোন নাগরিকের দেয়া তথ্য যদি আরো জানার আগ্রহ তৈরি করে তাহলে সেটি নাগরিক সাংবাদিকতা হয়ে ওঠে। কিন্তু আমি ‍নিশ্চিত জানি, এই সংজ্ঞা মানার আগে অন্তত ‍দু’টি প্রশ্ন উঠবে। সেই দুই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে তার পর নাগরিক সাংবাদিকতার সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে হবে।

প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, যে কেউ যে কোন তথ্য দিলেই কী সেটা নাগরিক সাংবাদিকতা হয়ে উঠবে ? আর বর্তমান প্রেক্ষাপটের কারণে প্রশ্ন উঠবে, তথ্য দেয়ার মাধ্যমটি কী হবে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম না যে কোন গণমাধ্যম ? প্রথম প্রশ্নের জবাব দেয়ার আগে বলতে হয় মত প্রকাশের পদ্ধতি যেখানে নিয়ন্ত্রণহীন, সেখানে নানা মত আসতেই পারে। যে কেউ চাইলে এর অপব্যবহারের সুযোগও নিতে পারেন। আর এতে অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে।

মানবতা বিরোধী অপরাধী সাঈদিকে চাঁদে দেখার গুজবের কথা নিশ্চই ভোলার নয়। এমন গুজব প্রায়ই দেখা যায় ফেসবুকে। আর তখনই মূল ধারার সাংবাদিকদের মাঠে নামতে হয় এর সত্যতা যাচাইয়ের জন্যে । সুতরাং আমরা বলতে পারছি না যে কোথাও কোন তথ্য প্রচার হলেই সেটা নাগরিক সাংবাদিকতা হয়ে উঠবে। কারণ কোন গুজব বা মিথ্যাকে তো আর সাংবাদিকতা বলার সুযোগ নেই। তাই বলতেই হচ্ছে নাগরিক সাংবাদিকতায় প্রচারিত তথ্যের ন্যূনতম বস্তুনিষ্টতা থাকতে হবে।

আসি দ্বিতীয় প্রশ্নের কাছে । কোন মাধ্যমে তথ্য প্রচার হলে তাকে নাগরিক সাংবাদিকতা বলা হবে। আমার মনে হয় এই প্রশ্নের উত্তর এই লেখায় আগেই দেয়া হয়েছে । তবু আবার বলছি পৃথিবীর এমন বহু পত্রিকা আছে যাদের প্রধান লেখক পাঠক। ইদানীং টেলিভিশনেও দর্শকের তোলা ছবি প্রচার হচ্ছে । কোন কোন খবরের প্রধান ছবিই হয়ে উঠছে দর্শকের তোলা ছবি। এখন আমরা নাগরিক সাংবাদিকতার সংজ্ঞা হিসাবে বলতে পারি, কোন নাগরিক, যখন যে কোন মাধ্যমে সত্য তথ্য বা ছবি প্রচারের জন্যে দিচ্ছেন এবং সেই সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে আরো জানার আগ্রহ তৈরি হচ্ছে , তখন সেটি নাগরিক সাংবাদিকতা হয়ে উঠছে।

এতক্ষণ নাগরিক সাংবাদিকতা কী ? এ নিয়ে এত আলোচনা যে করলাম তার একটি কারণ আছে। সেটি হচ্ছে, আমাদের দেশে কমিউনিটি সাংবাদিকতা, নগর সাংবাদিকতা, গ্রাম সাংবাদিকতাসহ নানা নামে সাংবাদিকতার চর্চা আছে। যার বেশিরভাগ কাঠামোগত প্রকাশ নাগরিক সাংবাদিকতার কাছাকাছি। কিন্তু মৌলিক দিক থেকে একেবারেই আলাদা। তবু আলোচনা করতে গেলে একটির সঙ্গে আরেকটি গুলিয়ে যায়।

সাংবাদিক হিসাবে আমি মনে করি, নাগরিক সাংবাদিকতার সঙ্গে অন্যান্য সাংবাদিকতার প্রথম পার্থক্য পেশাদারিত্বের। নাগরিক সাংবাদিক বলে কোন পেশাজীবী নেই। আছে সাংবাদিক। পেশাজীবী সাংবাদিক কমিউনিটি সাংবাদিক হতে পারেন। আবার গ্রাম সাংবাদিকও হতে পারেন । হতে পারেন অন্য যে কোন শাখার। কিন্তু তিনি নাগরিক সাংবাদিক নন। কারণ নাগরিক সাংবাদিকতা আসলে নাগরিক দায়িত্ব থেকে দেখার সাংবাদিকতা। তিনি যা দেখেন তাই বলেন, লেখেন অথবা ছবি তোলেন।

এতো গেলো যিনি নাগরিক সাংবাদিকতা করেন তার দিকের কথা। যদি সাংবাদিকতার মূল ধারার দিকে থেকে চিন্তা করি, তাহলে অন্যান্য সাংবাদিকতার সঙ্গে এর পার্থক্য আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কারণ প্রতিদিন যত খবর হয়, তার অর্ধেকেরও বেশি ঘটনা সাংবাদিকের সামনে ঘটে না। ঘটে কিছু নাগরিকের সামনে। তারা যে কোন পেশাজীবী হতে পারেন। তারাই সাংবাদিকদের তথ্যটি জানান।

কিন্তু সাংবাদিক অন্তত আরো দু’জনের কাছে ঘটনার বিবরণ শোনেন । তার পর যাচাই করে খবর লিখতে শুরু করেন পাঠকের জন্যে।কিন্তু এরই মধ্যে ঘটনা দেখেই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে খবর দিয়ে দেন কোন দায়িত্ববান নাগরিক। তিনি কোন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ বা পেছনের খবরে যান না। কিন্তু এতে তার খবররে মান বা বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না। তিনি যতটুকু চাইবেন ততটুকু খবর দেবেন। কারণ তার কোন পেশাগত দায় নেই।

মোদ্দা কথা, একটি ঘটনা একজন পেশাজীবীকে নাগরিক সাংবাদিক তৈরি করে। ঘটনা শেষ, তার সাংবাদিক পরিচয়েরও ইতি। তাঁকে সাংবাদিক হওয়ার জন্যে আবারো কোন একটি ঘটনার মুখোমুখি হওয়ার অপেক্ষা করতে হবে।

পেশাদারিত্বের কথা যখন উঠলোই তখন বলে রাখা ভাল, এখনো নাগরিক সাংবাদিকতায় প্রাপ্তিযোগের প্রচলন হয়নি বলে আমরা বলছি নাগরিক সাংবাদিকতা পেশাদারী সাংবাদিকতা নয়। কিন্তু কোন প্রতিষ্ঠান যদি নতুন কোন তথ্য বা ছবি পাওয়ার বিনিময়ে কোন নাগরিকের সঙ্গে অর্থের বিনিময় করেন তাহলে তো নিশ্চই দোষের হবে না? বরং ভালই হবে। কোন প্রাপ্তিযোগের সম্ভাবনা থাকলে যিনি কাজটি করবেন তিনি নিশ্চই সেটি বিক্রিযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করবেন। অর্থাৎ আরো মনোযোগ দিয়ে ঘটনা পর্যবেক্ষণ করবেন। ছবি তুললে চেষ্টা করবেন একটি ভাল ফ্রেম ধরার। তবে আবারো বলতে হচ্ছে, শুধু নাগরিক সাংবাদিকতা কারো সার্বক্ষণিক পেশা হওয়ার সুযোগ নেই। এমন কী এর জন্যে তিনি টাকা পেলেও নেই । কারণ প্রতিদিন অর্থবহ ঘটনা তার সামনে ঘটবে না। ঘটনার জন্যে তাঁকে অপেক্ষা করতেই হবে।

লেখার শুরুতে বলেছিলাম, আমাদের নাগরিক জীবনে নাগরিক সাংবাদিকতার প্রভাব অনেক বেশি। তার চেয়ে বড় কথা আমাদের দেশে মূলধারার যে সাংবাদিকতা, তার ওপর নাগরিক সাংবাদিকতার প্রভাব ক্রমশ বাড়ছে। যে কারণে এই চর্চাটির একটি সুষ্ঠু কাঠামো সৃষ্টির দরকার হচ্ছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, এখন কী এই ধারা সুষ্ঠু নয় ? উত্তর, নিশ্চই সুষ্ঠু । কিন্তু কাঠামোবদ্ধ নয়। এর একটা নিয়ম দরকার। কারণ চর্চা যত অবাধ হবে এর মধ্যে দুষ্ট চর্চা ঢুকে পড়ার আশংকা বাড়বে।
আবারো নাগরিক সাংবাদিকতার অপচর্চার কিছু উদাহরণ দিতে হচ্ছে। কাছাকাছি সময়ের তিনটি সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের কথা আমরা জানি । রামু বৌদ্ধ বিহারে সহিংসতা, পাবনার বেড়ায় সহিংসতা এবং কুমিল্লার সহিংসতা। তিনটি ঘটনার শুরুই ফেসবুক এবং ধর্মীয় অবমাননা সংক্রান্ত। খোঁজ খবর নিয়ে শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে যাদের নামে তথ্য প্রচার হয়েছে তারা বিষয়টি জানেনই না। প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রমাণ হয়েছে কেউ একজন বা কোন গোষ্ঠী নাগরিক সাংবাদিকতার সুযোগ ব্যবহার করেছেন সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্যে।

এই তো কিছু দিন আগে এরকম খারাপ অবস্থা সৃষ্টির আশংকায় টানা ২২দিন বন্ধ করে রাখা হয়েছিল সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম। হয়তো দরকার ছিল। হয়তো এতে অনেক বাজে পরিস্থিতি এড়ানো গেছে। কিন্তু এওতো ঠিক যে ২২দিনে অন্তত ২২টি জরুরি জন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সঙ্গে মানুষ যুক্ত থাকতে পারে নি। নাগরিক সাংবাদিকতার বড় মঞ্চ বন্ধের সুযোগে কতজন কত অনিয়ম করে ফেলেছেন তার হিসাব আমরা কেউ কী রাখি ?

পেশার প্রয়োজনে যাদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয়, তারা নিশ্চই আমার সঙ্গে একমত হবেন যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকেই এখন সবচেয়ে বেশি ভয় পায় যে কোন অঞ্চলের অপরাধীরা।তথ্যর অবাধ প্রবাহের সুযোগ বন্ধ করাটা সমাধান নয়। যে তথ্য আসে আসুক। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি এতে কোন ক্ষতি নেই । যারা নাগরিক সাংবাদিকতা অনুসরণ করেন তারা বুঝে কাজটি করলেই হয়। সত্য মিথ্যা যাচাই করার ক্ষমতা তো এক ধরণের দক্ষতা। এই দক্ষতা যার নেই তার জন্যে মূল ধারার গণমাধ্যতো আছেই।

এতক্ষণ যে আলোচনা হলো তাতে নিশ্চই পরিষ্কার যে নাগরিক সাংবাদিকতার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে দেশের মূল ধারার গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে সাংবাদিকতা আরো বেশি চ্যালেঞ্জের হয়ে উঠেছে। কারণ নাগরিক সাংবাদিকতা তাদের কাছে প্রাথমিক তথ্য। এটি ব্যবহার করতে হলে তাঁকে বিষয়টি যাচাই করতেই হচ্ছে। কোন একটি বিষয় আলোচিত হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে বিষয়টি আমলে আনতে হচ্ছে । খুব দ্রুত তাকেও বলতে হচ্ছে, আলোচিত বিষয়টি ঠিক অথবা ঠিক নয়। সুতরাং বলতেই হচ্ছে, নাগরিক সাংবাদিকতা শুধু সমাজ জীবনের জন্যে ইতিবাচক নয় মূলধারার সাংবাদিকতাকেও ধারালো করছে।

 

লেখক : বার্তা সম্পাদক,একাত্তর টেলিভিশন

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)