প্রযুক্তিতে নারীর অবস্থান কতটা পোক্ত?

যখন কেউ ফোন করে বলে একটা ভাল কাজ জানা লোক দেন, ঠিক আপনার মত… তখন মনে হয় সব পাওয়া হয়ে গেছে… এভাবেই নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করেন ফৌজিয়াতুন নাহার। একজন সিসকো এবং মাইক্রোসফট সার্টিফাইড ট্রেইনার হিসেবে কর্মরত আছেন জেনুইটি সিস্টেমসে। ডিপ্লোমাতে ভর্তি হন বাবার ইচ্ছাতে। তবে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করতে এসেই ভাল লাগা শুরু। আর থেমে থাকা নয়, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও সার্টিফিকেশন অর্জন করে নিজেকে নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়।

বাংলাদেশে তথ্য ও প্রযুক্তির প্রবেশ বহু আগে হলেও একবিংশ শতাব্দিতে এসে আই.টি আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের একটি অংশ হয়ে গেছে। ডিজিটালাইজেশনের এই যুগে জীবন ও কর্মের সব ক্ষেত্রেই রয়েছে প্রযুক্তির প্রয়োগ। বিএইচটিপিএ’র প্রকল্প পরিচালক আ.ন.ম সফিকুল ইসলাম বলেন, আইটি সেক্টরই মেয়েদের জন্য সবচেয়ে সম্ভাবনাময় কর্মক্ষেত্র। কারণ এখানে নারী-পুরুষ প্রভেদের কোনো সুযোগ নেই। এই কর্মক্ষেত্রে প্রয়োজন দক্ষতা, নিষ্ঠা আর নতুন কিছু শেখার আগ্রহ। এই বিচারে নারী কর্মীরা সবচেয়ে উপযুক্ত।

তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নারী উদ্যোক্তা ও নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন লুনা শামসুদ্দোহা। তিনি বলেন, নারীদের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি এক মহাচ্যালেঞ্জ। আর এমন চ্যালেঞ্জ হাজারোটা রয়েছে। প্রথম কথা হলো, যদি অনেক উপর থেকে বলি তবে বলতে হয়, মেয়েরা কম্পিউটার সায়েন্স, ইঞ্জিনিয়ারিং খুব কম পড়ে। এটাকে অনেকেই ছেলেদের লেখাপড়াও ভাবে। সেখানে একটা বাধা রয়েছে। তারপরে মেয়েরা যাও পড়ে, তাতে ছেলেদের তুলনায় ক্যারিয়ারে যায় না। এটাও হয়। খুব কম মেয়ে দেখা যায়, যারা বুয়েট বলেন, এটা বলেন সেটা বলেন, সেখান থেকে পড়ালেখা করে, কিন্তু কাজ করতে আসে না। এ ক্ষেত্রে একটা বড় বাধা দেখা যায়। এটাও সামাজিক চ্যালেঞ্জ। অনেকেই মেয়েদের রাতের বেলায় আসা যাওয়া, কাজ করারে স্বাভাবিকভাবে নেয় না। এটা এখনো আমাদের দেশে হচ্ছে।

তবে আশার কথা হচ্ছে, দেশের তথ্যপ্রযুক্তিখাতে নারীদের অবস্থান ধীরে ধীরে পোক্ত হচ্ছে। নতুন করে নারীরা আসছেন খাতটিতে, উদ্যোক্তা হচ্ছেন অনেকেই। সব ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেই তথ্যপ্রযুক্তিতে উদ্যোক্তা হওয়া যায় বলেই এই হার দিন দিন বাড়ছে। দেশের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নারী তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নতুন যেসব উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে সেখানে কোনো না কোনো ভাবে নারীর অংশগ্রহণ থাকছেই। পুরুষের পাশাপাশি এখন সমান তালেই তারা এগিয়ে যাচ্ছেন।

ইউওয়াই সিস্টেমস লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী এবং বেসিসের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি ফারহানা এ রহমান বলেন, বিশ্বের সব দেশেই তথ্যপ্রযুক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ কম। বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে গত কয়েক বছর থেকে দেশে নারীরা খাতটিতে আসতে শুরু করেছেন। নারীদের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে উদ্যোক্তা হবার প্রধান বাধা হচ্ছে পরিবার। কারণ, সবাই মনে করেন উদ্যোক্তা হলে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। কিন্তু দিন শেষে কতটা পাচ্ছে সেটাও তারা দেখেন। পাশাপাশি সামাজিক বাধা তো আছেই।

ব্যবসা শুরু করতে গিয়ে নারীদের প্রথম যে সমস্যাটায় পড়তে হয় তা হলো পুঁজি। সরকার নারীদের একটা ঋণের কথা বললেও সেটা পাওয়া খুবই কঠিন। দীর্ঘসূত্রিতা এবং যেসব ডকুমেন্ট দিতে হয় সেটাই অনেকে দিতে পারেন না। ফলে সেটাও অধরাই থেকে যায়। এগুলো নারীদের উদ্যোক্তা হবার ক্ষেত্রে বড় বাধা সৃষ্টি করে বলে জানান তিনি।

দেশে সফটওয়্যার খাতের একমাত্র সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস বা বেসিসে সদস্য কোম্পানি রয়েছে এক হাজার ২০০টি। এর মধ্যে ৬০টি কোম্পানিতে শেয়ার ও কোম্পানির বোর্ডে রয়েছেন নারী উদ্যোক্তারা। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ই-কমার্সে উদ্যোক্তা হচ্ছেন অনেক নারী। ই-ক্যাবের হিসাবে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েন অব  বাংলাদেশের সাড়ে আটশো সদস্যের মধ্যে ১২০ জন নারী। এছাড়াও নারী-পুরুষ উভয়ের শেয়ারে রয়েছে কিছু কোম্পানি রয়েছে।

ই-কমার্সের পাশাপশি এফ-কমার্সেও আধিপত্য নারীদের। রাজধানী কেন্দ্রিক এফ-কমার্সে অন্তত ৬০ শতাংশ নারী জড়িয়ে আছেন। বিক্রি করছেন তাদের নিজেদের তৈরি পণ্য ও সেবা। স্বাবলম্বী হয়েছেন অনেকেই। দেশের তথ্যপ্রযুক্তিতে অন্যতম একটি খাত বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং বা বিপিও। খাতটিতে কাজ করছে এখন অন্তত ৩৫ হাজার তরুণ-তরুণী। এসব বিপিও কাজের অন্যতম একটি হচ্ছে কল সেন্টারের কাজ। দেশের এবং দেশের বাইরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দেশে অসংখ্য নারী কল সেন্টারে কাজ করেন।

বাংলাদেশ উইমেন ইন টেকনোলজি বা বিডাব্লিউআইটি’র সভাপতি লাফিফা জামাল বলেন, নারীদের কর্মসংস্থান বাড়ছে এটা যেমন সত্যি, তেমনি আবার প্রতিবন্ধকতাও বাড়ছে। অনেক দেশের মতো আমাদের নারীরাও চায় তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নিজেদের একটা অবস্তান তৈরি করতে। কিন্তু নানান প্রতিবন্ধকতার ফলে তা হয়ে উঠছে না।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)