বিদেশি সাংবাদিকরা যেভাবে বেগবান করেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা
মুক্তিযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী নয় মাসে পাকিস্তানীদের হত্যাযজ্ঞের চিত্র বহির্বিশ্বে তুলে ধরার জন্য কিছু বিদেশি সাংবাদিকের আত্মত্যাগের কথা অবশ্যই স্বীকার্য। এদের মধ্যে রয়েছেন সায়মন ড্রিং, মার্ক টালি, সিডনী শেনবার্গ প্রমুখ। যুদ্ধ চলাকালীন আমাদের নিজস্ব কোনো গণমাধ্যম ছিল না বললেই চলে। বাংলাদেশ বেতার শুধুমাত্র এদেশের ভূখণ্ডের ভেতরই মানুষের কাছে বার্তা পৌঁছাতে সক্ষম ছিল। কিন্তু যুদ্ধের সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল নিজেদের ভূখণ্ডে নিজেদের সামরিক বাহিনী কর্তৃক অত্যাচার নিপীড়নের খবর সত্য ও সঠিক রূপে বহির্বিশ্বে পৌঁছে দেওয়া। এ কাজে অসামান্য অবদান রেখে বাংলাদেশের বিজয়কে আরো অনুকূলে এনেছেন বিদেশি গণমাধ্যমকর্মীরা। তাই মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদান মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। তারাও এক অর্থে মুক্তিযোদ্ধা।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরপরই বিদেশী গণমাধ্যমকর্মীরা সংবাদ সংগ্রহের জন্য বাংলাদেশে ভিড়তে শুরু করে। ২৫ মার্চ তারা অবস্থান করছিল শাহবাগের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। এদের মধ্যে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন, কানাডা, ফ্রান্স, জাপান ও রাশিয়ার প্রায় ৩৭ জন সাংবাদিক। বাঙালিদের নিজেদের স্বাধীনতা আদায়ের আন্দোলন নয়, বরং শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণের পর অন্যতম পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খুব কাছের দেশ পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া কেমন হয় তার উপরই বেশি চোখ ছিল সাংবাদিকদের।
২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট শুরু হওয়ার ঠিক আগমুহুর্তে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী সকল বিদেশি সাংবাদিককে জোরপূর্বক হোটেলে আটকে রাখে। কেউ ভাবতেও পারেনি কী ঘটতে যাচ্ছে সেই রাতে। নিউইয়র্ক টাইমস তাদের ২৯ তারিখের প্রতিবেদনে লিখে, “পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হুমকি দিয়েছে, হোটেল থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করা হলে সাংবাদিকদের গুলি করা হবে”। একই প্রতিবেদনে আটকে পড়া সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে হোটেলে অবস্থানরত এক সৈনিকের জবাব এভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়, “উই ওয়ান্ট ইউ টু লীভ বিকজ ইট উইল বি ঠু ডেঞ্জারাস ফর ইউ। ইট উইল বি ঠু ব্লাডি”। সৈনিকের এমন জবাবে সাংবাদিকরা নিজেদের নিয়ে যতটা না ভয় পেয়েছিলেন তার চেয়েও বেশি ভয় পান নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের সাথে আজ রাতে কী বিভীষিকা ঘটতে যাচ্ছে তার কথা চিন্তা করে।
তারা হোটেল থেকেই দেখতে পেয়েছেন, নিরস্ত্র বেসামরিক লোকজনের উপর সামরিক বাহিনীর বর্বর আক্রমণ। ট্যাঙ্ক, বন্দুক আর মেশিনগানের গুলির শব্দে আঁতকে উঠেছিলেন সবাই। গণহত্যার ব্যাপারে সাংবাদিকরা যেন কোনো তথ্য বহির্বিশ্বে সরবরাহ করতে না পারে তা নিশ্চিত করা ছিল পাকিস্তানের অন্যতম কাজ। এর প্রথম কারণ হলো তারা নিজেরা সম্পূর্ণ অবগত ছিল কীভাবে নিরীহ বাঙালিদের উপর অন্যায়স্বরূপ বীভৎস অত্যাচার চালাচ্ছে। আর দ্বিতীয় কারণ হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা। পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তার অধিকারী ছিল এবং তারা ভয় পেয়েছিল যদি বহির্বিশ্বে এটা প্রকাশ পায় যে পাকিস্তানে সরবরাহকৃত মার্কিন অস্ত্র বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে তাহলে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক সহায়তা বন্ধ করে দিতে পারে।
ফলস্বরূপ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী যত দ্রুত সম্ভব সাংবাদিকদের দেশ থেকে বহিষ্কার করার প্রক্রিয়া শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় সাংবাদিকদের ২৮ মার্চের মধ্যেই ঢাকা ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়।
বহিষ্কৃত সাংবাদিকদের মধ্যে একজন ছিলেন নিউ ইয়র্ক টাইমসের সিডনি শ্যানবার্গ। তিনি ছিলেন দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক প্রতিনিধি। অন্যান্য সাংবাদিকের সাথে তিনিও ২৫ মার্চের ভয়াবহতা নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করেন। তার রচিত বিয়ন্ড দ্য কিলিং ফিল্ডস নামক বইতে তিনি নিজের চোখে দেখা মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনা দেন। ২৫ মার্চের ঘটনা বর্ণনায় তিনি লিখেন, “শুরুর দিকে গোলাগুলির আওয়াজ অনেকটা বিক্ষিপ্ত ছিল তবে রাত ১টার দিকে অনবরত গুলির আওয়াজ শুনতে পাই হোটেল কক্ষ থেকে। প্রায় টানা তিন ঘণ্টা গুলির আওয়াজ শুনেছিলাম”। ২৮ মার্চ যখন তাদেরকে সামরিক নিরাপত্তায় এয়ারপোর্টে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন তিনি সকালের বিধ্বস্ত ঢাকার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন গাড়িতে বসে।
অলিগলির ভেতরকার বাসাবাড়িতে দরজা-জানালা ভেঙ্গে পড়ে রয়েছে, ছাদে আগুন জ্বলছে, রাস্তায় মানুষের লাশ পড়ে রয়েছে। সেসব লাশের উপর দিয়েই তাদের গাড়ি এগিয়ে চলছে এয়ারপোর্টের দিকে। এয়ারপোর্টে তাদের উপর কঠোর তল্লাশি চালানো হয়। তাদের নোটবুক, রেকর্ডার সবকিছু বাজেয়াপ্ত করা হয় সেখানে। করাচিতে ফিরে যাওয়ার পর নিউ ইয়র্ক টাইমসে ২৮ মার্চ এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
বিদেশি সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও তিনি পরবর্তীতে আবারও গণহত্যার প্রতিবেদন প্রকাশ করতে জুন মাসে যুদ্ধচলাকালীন বাংলাদেশে আসেন। তখন তিনি শহর ও গ্রাম থেকে বেশ কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীকে সূত্র ধরে সংবাদ প্রকাশ করেন। এর প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ৩০ জুন পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাকে আবার দেশ থেকে বহিষ্কার করে।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের ২৮ তারিখের সংবাদের শিরোনামে ৩৫ জন সাংবাদিকের দেশ ত্যাগের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে অবস্থানরত বিদেশী সাংবাদিকদের সঠিক সংখ্যা ছিল ৩৭। সেখানে আরো দুজন সাংবাদিকের কথা আলাদা করে উঠে আসে, তখন যাদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। প্রতিবেদনে বলা হয়, যখন সাংবাদিকদের একসাথে আটকে রাখা হয় তখন অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস ও রয়টার্সের দুজন সাংবাদিক হোটেলে ছিলেন না। অফিসে তাদের সন্ধান করা হলে অফিস জানায় এখন পর্যন্ত ঢাকা থেকে তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। এই দুজন ব্যক্তির একজন ছিলেন ২৬ বছর বয়সী বিলেতি সাংবাদিক সায়মন ড্রিং।
লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফের সাংবাদিক সায়মন ড্রিং সর্বপ্রথম ঢাকা এসেছিলেন ১৯৬৮ সালে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের খবর সংগ্রহের কাজে তিনি ঢাকা ত্যাগ করে ভিয়েতনাম চলে যান। কিন্তু ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পরিস্থিতি যখন অবনতির দিকে, বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে যখন স্বাধীনতার ডাক দিলেন তখন সমগ্র বিশ্বের মানুষ একটি আসন্ন যুদ্ধের আভাস পায়। যে কারণে বিদেশী সাংবাদিকরা বাংলাদেশে আসতে শুরু করেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ৬ মার্চ সায়মন ড্রিং পুনরায় বাংলাদেশে আসেন।
২৫ মার্চ রাতে বন্দুকের মুখে যখন বিদেশি সাংবাদিকদের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আটক করা হচ্ছিল, সাইমন তখন অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের আলোকচিত্রী মাইকেল লরেন্টকে সঙ্গী করে হোটেলের ছাদে আশ্রয় নিয়ে তাৎক্ষণিক বহিষ্কারের হাত থেকে রেহাই পান। ২৭ তারিখ কারফিউ উঠে গেলে তিনি হোটেলের কর্মচারীদের সহায়তায় দুই দিন অগ্নিদগ্ধ ঢাকার ধ্বংসযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করেন। পরে ঢাকা ত্যাগ করার সময় অত্যন্ত সৌভাগ্যবশত এয়ারপোর্টে নিজের নোটবুকটি বাজেয়াপ্ত হবার হাত থেকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন। করাচি হয়ে ব্যাংককে এসে সেনাবাহিনীর হত্যাকাণ্ডের বিবরণ পাঠাতে শুরু করেন তিনি।
৩০ মার্চ ডেইলি টেলিগ্রাফে প্রকাশিত ‘ট্যাংকস ক্রাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান’ শিরোনামের সংবাদে তিনি ঢাকার বীভৎস অবস্থা বর্ণনা করেন। যার শুরুটা ছিল এমন, “In the name of the god and united Pakistan, Dacca is a crushed and frightened city today”। এই সংবাদটিতেই মূলত তৎকালীন ঘোষণাকৃত স্বাধীন বাংলাদেশের বীভৎস চিত্র সঠিকরূপে বিশ্বের মানুষের কাছে উঠে আসে। ২৭ মার্চ বাংলাদেশ ত্যাগের পর তিনি আবার নভেম্বরে ভারতে আসেন। তখন তিনি মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর সংগ্রহ করতেন কলকাতা থেকে। সেসব খবর টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশ করার জন্য পাঠিয়ে দিতেন লন্ডনে। ১৬ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর ট্যাংকে চড়ে তাদের সাথে ঢাকায় প্রবেশ করেন সায়মন ড্রিং এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাথেই বিজয় উল্লাসে অংশগ্রহণ করেন তিনি।
ঢাকার অবস্থা যে বর্তমানে স্বাভাবিক রয়েছে তা সংবাদপত্রে প্রকাশ করার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৮ জন সাংবাদিককে ঢাকায় আনে এবং সম্পূর্ণ নিজেদের পরিচালিত ভ্রমণের মাধ্যমে শহরের অবস্থা পরিদর্শন করায়। তাদেরকে এমন শর্ত দেওয়া হয় যে তারা পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে নিজেরা যা দেখবে তার একটি কথাও প্রতিবেদনে লিখতে পারবে না বরং সেনাবাহিনী তাদেরকে যা বলবে তা-ই সংবাদে লিখতে হবে। সাংবাদিকরা তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব খুব সুন্দরভাবে পালন করে। তারা পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যায় এবং তাদের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের স্বাভাবিক অবস্থা তুলে ধরে। সেসব প্রতিবেদনে বলা হয় ঢাকাতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক, সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। সেই ৮ সাংবাদিকরে মধ্যে একজন ছিলেন অ্যান্থনি মাসারেনহাস, যিনি বাকিদের মতো নিজের বিবেকের কাছে বিক্রি হতে পারেননি।
মাসারেনহাসের জন্ম বেলজিয়ামে হলেও তার শিক্ষাজীবন কাটে করাচিতে। তিনি ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের সংবাদপত্র মর্নিং নিউজ-এর সহকারী সম্পাদক। বাকি ৭ সাংবাদিকের নৈতিক বিবেক না থাকলেও এই সাংবাদিক নিজের বিবেকের কাছে আটকে যান। নিজে যা দেখেছেন তার বিপরীতে লিখার নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও তিনি তা করতে পারেননি। বরং পাকিস্তান ১০ দিনের ঢাকা ভ্রমণ শেষে তিনি ১৯৭১ সালের ১৮ মে সরাসরি লন্ডনে চলে যান। সেখানে গিয়ে তিনি সানডে টাইমসের দপ্তরে গিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে যা দেখেছিলেন সে সম্পর্কে সত্যিকারের গল্প লিখতে আগ্রহ জানান।
২০১১ সালে বিবিসির একটি সাক্ষাৎকারে অ্যান্থনি মাসারেনহাসের স্ত্রী ইভেন মাসারেনহাস, তার স্বামী যেদিন পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভ্রমণ শেষে ফিরে এসেছিল, সেদিনের বর্ননা দেন এভাবে,
“আমি আমার স্বামীকে এই অবস্থায় আগে কখনো দেখিনি। সে ছিল একেবারেই হতাশ, কোনো একটা চাপ অনুভব করছিল সে, সত্য প্রকাশের চাপ। সে ছিল অত্যন্ত ভীত আর আমাদের সেনাবাহিনীর উপর ছিল বিরক্ত। আমাকে বলেছিল যদি সে সত্য প্রকাশ করতে না পারে তাহলে সে কখনোই আর একটি শব্দ লিখতে পারবে না।”
সানডে টাইমস তার লিখিত প্রতিবেদন প্রকাশে সম্মত হয়। কিন্তু তার দুশ্চিন্তা ছিল তার পরিবারকে নিয়ে। তার পরিবার তখন অবস্থান করছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করলে পরিবারকে সেটার খেসারত দিতে হতে পারে এই চিন্তা করে তিনি তার সন্তান ও স্ত্রীকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে লন্ডনে নিয়ে আসেন এবং ১৯৭১ সালের ১৩ জুন লন্ডনের সানডে টাইমসে ‘জেনোসাইড’ শিরোনামের সেই বিখ্যাত প্রতিবেদনটি প্রথম পাতায় বাই-লাইন স্টোরি হিসেবে ছাপা হয়। এটিই ছিল পশ্চিমা সংবাদপত্রে প্রকাশিত গণহত্যার প্রথম বিবরণমূলক সংবাদ।
ধারণা করা হয় এই প্রতিবেদনটি বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বৈধতা অর্জনে ব্যাপক সাহায্য করে। এই প্রতিবেদনের কারণে ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীনতা অর্জনে সাহায্য করার ব্যাপারে আরো বেশি উৎসাহ প্রকাশ করে। বিবিসির তৎকালীন সম্পাদক হারল্ড ইভানের সাথে এক সাক্ষাৎকারে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, “এই প্রতিবেদনটি এত গভীরভাবে আমাকে বিস্মিত করেছিল যে আমি একপর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তানে সশস্ত্র হস্তক্ষেপের জন্য ইউরোপ এবং রাশিয়ার ইতিবাচক মনোভাব পেতে তাদের সাথে ব্যক্তিগত কূটনৈতিক প্রচারাভিযানে লিপ্ত হই”।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের গণহত্যার সত্য খবর বহির্বিশ্বে জানিয়ে দিতে মাসকারেনহাস সপরিবারে নিজের দেশ ত্যাগ করেন। তার এই ত্যাগের মাধ্যমে তার পেশাদারিত্ব প্রকাশ পায়নি বরং তার উঁচু পর্যায়ের মানবিকতা ও ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
যুদ্ধক্ষেত্রে গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ একটি অত্যন্ত জরুরী যুদ্ধকৌশল। সত্যকে গোপন রেখে বহির্বিশ্বে নিজেদের কর্মকাণ্ডের বৈধতা অর্জন করাই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর মূল লক্ষ্য। এমনকি তারা পশ্চিমা সাধারণ জনগণদেরও ঢাকায় কী হচ্ছে সে ব্যাপারে সম্পূর্ণ অজ্ঞ রাখার চেষ্টা চালায় গনমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে। ইয়াহিয়া ভুট্টোর শাসনামলে পাকিস্তানি সংবাদপত্র ও টেলিভিশনগুলো সর্বদা সরকারের গুণগানে ব্যস্ত থাকতে বাধ্য ছিল, যার ফলে পশ্চিমা নাগরিকদের মস্তিষ্কে সামরিক শাসনের শুরু থেকেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী দেবতাসুলভ কিছু একটা হিসেবে স্থান করে নেয়।
তারা কখনো ভাবতেই পারেনি পূর্ব পাকিস্তানে যা হচ্ছে তা অন্যায়। বরং বাঙালিদের এমন আন্দোলনকে ভারতের উসকানি বলে প্রকৃত সত্য থেকে অন্ধকারে রাখা হয় পশ্চিমা নাগরিকদের। কিন্তু সায়মন ড্রিং, সিডনী শ্যানবার্গ আর মাসারেনহোর মতো সাহসী সাংবাদিকদের পেশাদারিত্ব, মানবিকতা, আর বিবেকের তাড়না বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে যতটা বেগ দিয়েছে এবং বিদেশি গণমাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বৈধতার প্রতি বহির্বিশ্বের মানুষের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া অর্জনে যেভাবে সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে, তাদের এই ঋণ কখনোই শোধ করার মতো নয়। তারাও মুক্তিযোদ্ধা।