উচ্চশিক্ষায় কোণঠাসা মাতৃভাষা
১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের মায়ের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আত্মত্যাগ, যার ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন। যেই দেশে মায়ের ভাষা রক্ষায় এত ত্যাগ-তিতিক্ষা সেই দেশের উচ্চশিক্ষায় দিন দিন কোণঠাসা হয়ে পড়ছে বাংলা ভাষা। সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সব বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুটা বাংলার চিহ্ন থাকলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গ্রাহ্যই করা হয় না। কিন্তু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও নতুন নতুন যেসব বিষয় যুক্ত হচ্ছে সেগুলোয় বাংলার ছিটেফোঁটাও রাখা যাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) পূর্ণাঙ্গ সিদ্ধান্তে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে সব বিষয়ের সঙ্গে ‘বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস’ এবং ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য’ নামের দুটি বিষয় যোগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ইউজিসির অনুরোধে ‘বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস’ রচনা করেন অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ও অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান। আর ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য’ সম্পাদনা করেন জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ও অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর দে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এই বিষয় দুটি পড়ানোর ব্যাপারে নির্দেশনা জারি করা হলেও বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ই তা মানছে না।
জানা যায়, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনেকটাই স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। তাদের একাডেমিক কাউন্সিল, সিন্ডিকেট কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই তারা কোর্স পরিচালনা করে। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলে ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০’ অনুযায়ী। কিন্তু আইনে কোনো কোর্সে বাংলা বিষয় যোগ করার বাধ্যবাধকতা নেই। তাই
ইউজিসির পক্ষে অনুরোধই প্রধান উপায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউজিসির অনুরোধ শুনলেও অনেকেই শোনেনি। আর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইউজিসির দেওয়া বিষয় দুটি যোগ করেনি।
ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, ‘আমাদের ফুল কমিশন সব কোর্সে বাংলা দুটি বিষয় যোগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই তা মেনেছে, আবার কেউ কেউ এখনো শুরু করতে পারেনি। তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের নিজস্ব কর্মপদ্ধতিতে চলে। বিশ্বায়নের যুগে অনেকে মনে করছে, বাংলা না পড়লেও চলবে। ইংরেজি অবশ্যই পড়তে হবে, তবে সেটা বাংলাকে বাদ দিয়ে নয়।’
জানা যায়, দেশের শতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র সাত-আটটিতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে চার বছরের স্নাতক (সম্মান) চালু রয়েছে। প্রতিটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগ থাকলেও বাংলা নেই। শিক্ষকরাও ইংরেজিতে ক্লাসে পাঠদান করেন। এমনকি বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নামও ইংরেজিতে। আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালগুলোর বেশির ভাগ ক্লাসই নেওয়া হয় ইংরেজিতে। উভয় ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ রেফারেন্স বইও ইংরেজিতে। বাংলায় ভালো মানের বইও পাওয়া দুষ্কর।
তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বিভিন্ন কলেজে প্রায় ১৫ লাখ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়ন করছে। এসব কলেজে পড়ানো হয় বাংলায়। আর বেশির ভাগ রেফারেন্স বইও বাংলায়। আর প্রতিটি বিষয়েই বাংলায় নোট-গাইডও রয়েছে। তবে অনেকেই মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্র জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে নেই। তারা উচ্চশিক্ষা প্রদান করলেও পড়ালেখা হয় স্কুল-কলেজের মতো।
জানা যায়, যেসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় স্নাতক কোর্স চালু আছে সেগুলোর মধ্যে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস (ইউল্যাব), সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ (ইউডা), শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি, উত্তরা ইউনিভার্সিটি, ফারইস্ট ইউনিভার্সিটি, গণবিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম।। এর বাইরে সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটিতে বাংলা ভাষা বিষয়ে শুধু এমএ পড়ানো হয়।
স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির আইন বিষয়ের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের ক্লাস থেকে পরীক্ষা সব কিছুই হয় ইংরেজিতে। তবে গাজী শামসুর রহমান, সিদ্দিকুর রহমান, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, এস আর পালসহ অনেক লেখকেরই বাংলায় ভালো ভালো আইনের বই রয়েছে। সেগুলো আমরা পড়লেও লিখতে হয় কিন্তু ইংরেজিতেই।’
ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘গত ১৫ থেকে ২০ বছর ধরে মনে হচ্ছে, ইংরেজি ছাড়া চলবেই না। অথচ ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের পর কিন্তু এই অবস্থা ছিল না। আমাদের দেশে অনেকেই বাংলা ভাষা নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগছেন। অথচ পৃথিবীর কোথায়ও মাতৃভাষা ছাড়া উচ্চশিক্ষা হয় না।’