বুলবুলের মুত্যুতে সংগীতাঙ্গনে শোকের ছায়া

প্রখ্যাত সুরকার, গীতিকার, সঙ্গীত পরিচালক ও মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল মঙ্গলবার ভোর রাতে রাজধানীর আফতাবনগরের বাসায় মারা গেছেন। দীর্ঘদিন হৃদরোগে আক্রান্ত বুলবুলের জীবনের শেষ সময়টা ছিল চার দেয়ালে বন্দি।বাসায়ই পরিবার পরিজন নিয়ে সময় কাটত তার। মাঝে মাঝে বন্ধু-সহকর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের নিয়ে আড্ডা দিতেন।

জীবনের শেষ দিকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতি খুব কমই চোখে পড়েছে।হার্টের অসুখ তাকে বেশ পীড়া দিচ্ছিল।সেই অসুখই কাল হল তার। গত বছর হার্টে ৮টি ব্লক ধরা পড়ার পর তার বুকে দুটি রিং পরানো হয়। সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরার পর আর সেভাবে গানে ফেরা হয়নি এই সুরকারের। যে মানুষটি চার দশক ধরে গানের ভুবনে ছিলেন সেই মানুষটিই কিনা শেষ জীবনে গান থেকে যোজন যোজন দূরে সরে যান। এই সময়টাতে তার সঙ্গী বলতে ছিলেন একমাত্র ছেলে সামির ও একান্ত সহকারী রোজেন। গান তেমন নিয়মিত করতেন না। গানের মানুষদের সঙ্গে আড্ডা বা মেলামেশা কমে গিয়েছিল।

বরেণ্য এই গীতিকার, সুরকার ও শিল্পীর মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে শোবিজ অঙ্গনে। শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও জাতীয় সংসদের স্পীকার। এছাড়াও গনমাধ্যম কর্মী থেকে শুরু করে সংগীত শিল্পী, সংগীত পরিচালক, সুরকার, গীতিকারসহ টেলিভিশন, চলচ্চিত্র অঙ্গন ছাড়াও দেশের বিভিন্ন সেক্টরের স্বনামধন্য ব্যক্তিরাও আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের মৃত্যতে শোক জানাচ্ছেন। সহজেই মেনে নিতে পারছেন না গুনী এ মানুষটির চলে যাওয়া।

বুলবুলের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে আফতাবনগরের বাসায় ছুটে আসেন তার সহকর্মীরা। সেখানে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। খবর শুনে বুলবুলের বাসায় ছুটে যান জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ। তিনি বলেন, আমি কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। গানের সব অঙ্গনে তিনি সফলতার তুঙ্গে ছিলেন। বুলবুল ভাইয়ের অকাল প্রয়াণে দেশের অনেক বড় ক্ষতি হলো, এটা পূরণ হওয়ার নয়।

কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোর বলেন, আমি মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। কিছুই বলতে পারছি না।

গীতিকার শহীদুল্লাহ ফরাজী বলেন, বিশ্বাস করতে পারছি না বুলবুল নেই। এই মৃত্যু মেনে নেয়া যায় না।

কণ্ঠশিল্পী মনির খান বলেছেন, আমি আসলে বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। আমার প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাই প্রেমের তাজমহল সিনেমায় গান গেয়ে। গানটি লিখেছিলেন ও সুর করেছিলেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ভাই। এরপর তার লেখা ও সুরকরা অসংখ্য গান গাওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার। তার এই চলে যাওয়া সংগীত জগতে বিরাট একটা শূণ্যতা তৈরি হলো।

রোমানা ইসলাম বলেন, আমি অনেক লাখী, উনার মতো একজন মানুষের সংস্পর্সে আসতে পেরেছিলাম, উনার কিছু গান পেয়েছিলাম। উনি এদেশের জন্য উজার করে দিয়েছেন। তার চলে যাওয়া কখনো পূরণ হওয়ার নয়।

এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও শোকের ছায়া নেমে আসে গুনী এ সংগীত শিল্পীর মৃত্যুতে। অনেকে সিনিয়র থেকে শুরু করে এই সময়ের সংগীতাঙ্গনের মানুষের পাশাপাশি শোবিজের অভিনেতা-অভিনেত্রী, সাংবাদিক ও ভক্তরা তার মৃত্যুতে শোক বার্তা প্রকাশ করছেন। সেই সঙ্গে ডেইলি বাংলাদেশ পরিবারও শোকাহত।

চিত্রনায়ক শাকিব খান তার ফেসবুকে লিখেছেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা, দেশ বরেণ্য গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল আর নেই.. (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তার চলে যাওয়ায় বাংলা সংগীতের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। গুণী এই মানুষটির মৃত্যুতে জানাই গভীর শোক। ওপারে ভালো থাকবেন অসংখ্য কালজয়ী গানের সৃষ্টা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল..

অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী লিখেছেন, বিনম্র শ্রদ্ধা…. আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল….

সংগীত পরিচালক শওকত আলী ইমন ফেসবুকে একে একে সবাইতো চলে যাচ্ছেন। তবুও আপনার কি এতই তাড়া ছিল! আমাকে প্রায়ই বলতেন ‘ইমন তোর সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে’, কই কথাগুলো তো বলে গেলেন না বুলবুল ভাই। আপনি ছিলেন আমার গুরু, আমার শিক্ষক, আমার সব ভাল কাজের উৎসাহ প্রেরণকারী বটবৃক্ষ। আপনি এ দেশের জন্য যা দিয়ে গেছেন, যতদিন এ জাতি বেঁচে থাকবে আপনার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে সবার হৃদয়ে বুলবুল ভাই।

অনেক পেয়েছি, শিখেছি আমিও আপনার কাছ থেকে। কত শত দিন-রাত পার করেছি স্টুডিওতে আপনার সঙ্গে, নিজের সন্তানের মতো আগলে রেখেছিলেন আজীবন, সবই এখন স্মৃতি। আল্লাহ আপনাকে বেহেশতের শ্রেষ্ঠতম স্থানে অভিষিক্ত করুন। আমিন।

সঙ্গীতশিল্পী প্রতীক হাসান লিখেছেন, ‘জন্ম’ ছবি থেকে শুরু, আপনার হাত ধরে বাংলাদেশের নায়ক কণ্ঠ হওয়ার সৌভাগ্য আমার। আপনার সৃষ্টি বাবার অসাধারণ কিছু গান গেয়ে আমি আজ প্রতীক হাসান। আমাকে দিয়েছেন অকৃত্রিম ভালোবাসা, পথচলার অনুপ্রেরণা আর আজীবন গাওয়ার কিছু গান। ভালো থাকবেন চাচা। আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে, একা করে। আপনার গানের মাঝেই অমর হয়ে থাকবেন আপনি।

সঙ্গীতশিল্পী ইমরান লিখেছেন, অনেক বড় একটা দুঃসংবাদ দিয়ে সকাল শুরু! দেশ বরেণ্য সুরকার, গীতিকার, মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল (স্যার) আমাদের মাঝে আর নেই! ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন। আজ ভোর ৪টার দিকে তিনি ইন্তেকাল করেছেন।

কণ্ঠশিল্পী কোনাল লিখেছেন, ঘুমিয়ে গেছে, অভিমানী গানের পাখি।

কণ্ঠশিল্পী কর্ণিয়া লিখেছেন, সকালটা এভাবে শুরু হবে ভাবিনাই! মুক্তিযোদ্ধা, বরেণ্য গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল স্যার আর নেই। ওপারে ভালো থাকবেন স্যার।

কণ্ঠশিল্পী সন্দীপন লিখেছেন, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল.. হে গুণী মহাপ্রস্থানে অশ্রু সজল বিনম্র শ্রদ্ধা…তুমি বেঁচে থাকবে হৃদয়ে, মননে, কর্মে যতদিন বাংলাদেশ থাকবে।

কণ্ঠশিল্পী সিঁথি সাহা লিখেছেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল স্যার আর নেই। আমাদের হৃদয়ে থাকবেন আপনি।

সঙ্গীতশিল্পী লুৎফর হাসান লিখেছেন, সবকটা জানালা খুলে দাও না। এই গানটি বুলবুল সুর করেছিলেন নজরুল ইসলাম বাবুর গীতিকবিতা থেকে। ‘ও মাঝি নাও ছাইড়া দে’ এসএম হেদায়েতের কথা থেকে সুর করেছিলেন বুলবুল। ‘সেই রেল লাইনের ধারে’ মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের গীতিকথায় বুলবুল সুর করেছেন। ‘মা গো আর তোমাকে’ গাজী মাজহারুল আনোয়ারের কথায় সুর করেছেন বুলবুল। ‘একতারা লাগে না আমার’ মনিরুজ্জামান মনিরের কথা বুলবুলের সুর। ‘সুন্দর সুবর্ণ তারুণ্য লাবন্য’ আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের নিজের কথা ও সুরের গান। এই গানগুলো গেয়েছেন সাবিনা ইয়াসমিন। বাংলাদেশের ইতিহাসের সুরের যে অধ্যায় সেখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের এটিও একটি।

কণ্ঠশিল্পী লোপা হোসেইন লিখেছেন, ক্লোজআপ ওয়ান শুরু করেছিলাম আপনার গান দিয়ে। সবশেষ টিভি লাইভও শুরু করেছিলাম আপনার দেশের গান দিয়ে। এমন কোনো টিভি বা মঞ্চ অনুষ্ঠান নেই যেখানে আপনার অন্তত একটি গানও গাইনি আমি। বাংলা গানের মডার্ন মেলোডি মানেই ছিলেন আপনি।

তিনি ‘ছিলেন’… আজ আরো এক কিংবদন্তি স্মৃতি হয়ে গেলেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা, গীতিকার, সুরকার, একজন সাহসী মানুষ, একজন দরদী মানুষ আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল স্যার, আপনার জন্য অনেক অনেক দোয়া। আল্লাহ আপনাকে শান্তিতে রাখুন।

নির্মাতা বন্ধন বিশ্বাস লিখেছেন, ‘সবকটা জানালা খুলে দাও না, আমি গাইবো গাইবো বিজয়েরই গান’ আপনি বাংলা গানের বিজয়ের কারিগর ছিলেন। ইতিহাস ছিলেন, এই ইতিহাস বাংলাদেশ ভুলবে না। আপনার চিরবিদায় একটা অধ্যায়জুড়ে শুধু শূন্যতায়।

ওপারে ভালো থাকবেন কিংবদন্তি…

নির্মাতা মাহমুদ দিদার লিখেছেন, দাদা এভাবে না বলে চলে গেলেন! আপনিতো কথা দিয়েছিলেন, দাদা আমাদের ছবির গানগুলো আপনি…

বরেণ্য এ শিল্পীর লাশ আগামীকাল বুধবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেয়া হবে। সেখানে বেলা ১১টায় তাকে সর্বস্তরের জনগণ শেষ শ্রদ্ধা জানাবেন। শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানো শেষে বাদ জোহর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে নেয়া হবে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের লাশ। সেখানে অনুষ্ঠিত হবে তার প্রথম জানাজা ও এরপর বিএফডিসিতে দ্বিতীয় জানাযা হবে। বরেণ্য এ শিল্পীর মরদেহ শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হবে বলে জানা গেছে।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)