ফরাসি বিপ্লবের পরিণতি
আধুনিক সমাজের সকল বড় পরিবর্তনের পিছনে যুগ যুগ ধরে চলমান বিভিন্ন বিপ্লব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।এমনই আধুনিক সমাজের গোড়ার দিকের একটি বিপ্লব হল ফরাসি বিপ্লব।যা ফ্রান্স তথা পুরো ইউরোপকে চিরতরে বদলে দিয়েছে।ফরাসি বিপ্লব তার সকল উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হলেও এ বিপ্লব ফ্রান্সের রাজনীতি থেকে শুরু করে সমাজ ব্যবস্থায় যে বিপুল পরিবর্তনের ধারা এনেছিল তা পরবর্তীতে পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে যায়।তো কীভাবে শুরু হয়েছিল ফরাসি বিপ্লব? আর কী ই বা ছিল এর পরিণতি?
ফারসি বিপ্লব
ফরাসি বিপ্লব ১৭৮৯ সালে শুরু হয় এবং ১৭৯০ তে এর সমাপ্তি ঘটে।ফারসি বিপ্লবের পেছনে অনেক হেতু রয়েছে।প্রথম কারণ ছিল অর্থনৈতিক।ফ্রান্সের মার্কিন বিপ্লবে সাহায্য এবং রাজা ষষ্ঠদশ লুই এর বেহিসাবী খরচ ফ্রেঞ্চ রাজপরিবারকে প্রায় দেউলিয়া করে দেয়। একারণে ফ্রেঞ্চ সরকার জনগণের উপর বাড়তি কর চাপিয়েছিল।কিন্তু জনগণ এই কর দিতে অস্বীকৃতি জানায় যা ধর্মঘট এবং দাঙ্গাতে রূপ নেয়।সমস্যা সমাধানে ফ্রান্সের সরকার জনগণের সঙ্গে একটি মিটিংয়ের ডাক দেন যেখানে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং নিন্মবিত্ত সকল শ্রেণীরই প্রতিনিধি থাকবে এবং রাজাকে তাদের দূর্দশা এর কথা জানাবে।এই মিটিং এর জন্য ৫ মে ,১৭৮৯ তারিখ ধার্য করা হয়।কিন্তু সমস্যা শুরু হয় শ্রেণিকে কেন্দ্র করে।
উচ্চবিত্তের সঙ্গেমধ্যবিত্তের দাঙ্গা
ফ্রান্সে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের ভেটো অধীকার থাকলেও নিন্মবিত্তের ছিল না।কিন্তু জনসংখ্যার প্রায় ৯৮ শতাংশই ছিল এই শ্রেণির।তাই নিন্মবিত্তের মানুষেরা তাদের অধিকারের জন্য সংগ্রাম শুরু করে।যা উচ্চবিত্তের সঙ্গে দাঙ্গায় রূপান্তরিত হয়।সমস্যা সমাধানে সকল শ্রেণির প্রতিনিধিদের মধ্যে বৈঠক চলতে থাকে। ২০ জুন,১৭৮৯ সালে নিন্মশ্রেণির প্রতিনিধিরা একটি ইনডোর টেনিস কোর্টে মিলিত হয় এবং যতদিন সংবিধানে পরিবর্তন না আসবে ততদিন ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।যা “টেনিস কোর্ট ওথ” নামে পরিচিত।এর এক সপ্তাহের মধ্যেই ৪৭ জন লিবারেল নেতা এবং মধ্যবিত্তের বেশিরভাগই এদের সঙ্গে যুক্ত হয়। ২৭ জুন রাজা লুইস অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও সকল শ্রেণীকেই বিধানসভায় যোগ দিতে অনুরোধ জানায়।১২ জুলাই পর্যন্ত সংসদে সভা চলমান থাকে।
সংসদে নতুন আইন প্রণয়ন
রাজধানী প্যারিসের মানুষেরা রাজপরিবারের ক্ষমতা চলে যাওয়া এবং নৃশংসতার ভয় পেতে শুরু করে।১৪ জুলাই বিক্ষোভকারীরা বস্তিল দূর্গ দখল করেন এবং অস্ত্র সস্ত্র লুট করেন।রাজধানী সহ সারা দেশে এই খবর ছড়িয়ে পড়ে এবং ক্ষিপ্ত জনগণ রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নামে।আন্দোলনের মুখে ৪ আগস্ট সংসদে নতুন আইনের খসড়া প্রণীত হয়।এই আইন অনুসারে সকল মানুষের সমান অধীকার, বাক স্বাধীনতা, সার্বভৌম এবং গণতান্ত্রিক সরকারের আশা দেয়া হয়।কিন্তু এই আইন বাস্তবায়ন এবং কীভাবে সরকার নির্বাচন হবে ও নতুন রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে সংসদ সদস্যদের মধ্যে লড়াই চলতে থাকে।অবশেষে ৩ সেপ্টেম্বর নতুন আইন পাশ হয় এবং আইনে রাজার হাতে শুধু প্রতিনিধি বাছাইয়ের ক্ষমতা দেয়া হয়।কিন্তু এতে অনেক আন্দোলনকারী এবং সংসদের প্রতিনিধিরা খুশি ছিলেন না।তাহলে কী ছিল এর পরিণতি?
জেবকবিনস
আন্দোলনকারীরা রাজতন্ত্রের পুরোপুরি সমাপ্তি চাইলেও তা না হওয়ায় অনেকেই খুশি ছিলেন না।১৭৯২ সালের ১০ আগস্ট জেবকবিনস নামক এক আন্দলনকারী তার অনুসারীদের নিয়ে রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করে এবং রাজা লুই কে গ্রেফতার ও হত্যা করে নিজে ক্ষমতা দখল করেন।তিনি ত্রাসের রাজত্ব শুরু করে।খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের হত্যা এবং বিপ্লবে যারা জড়িত ছিলেন না তাদের হত্যা শুরু করে।তার ৯ মাস শাসনকালে প্রায় ১৭ হাজার নিরস্ত্র ফরাসি নাগরিককে হত্যা করা হয়।অবশেষে জেকবিনসকে হত্যার মাধ্যমে নেপোলিয়ন ফ্রান্সের সুপ্রিম কোর্টের সহায়তায় ক্ষমতায় আসেন।বিপ্লবের মূল উদ্দেশ্যগুলোকে ঠিক রেখে নতুন সংবিধান গঠন করেন তিনি।কিন্তু নবগঠিত ফ্রেঞ্চ রিপাবলিক প্রতিবেশী দেশগুলোর কাছ থেকে বহুবার আক্রমণের শিকার হয়।প্রতিবেশী দেশগুলোর ভয় ছিল তাদেরও ফ্রান্সের মত রাজতন্ত্রের সমাপ্তি হবে।নেপোলিয়ন এসকল আক্রমণ প্রতিহত করেন।এই বিপ্লবের ছোঁয়া পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে দেয়।এভাবেই ফরাসি বিপ্লব পরবর্তীতে পুরো ইউরোপের রাজনৈতিক শাসন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজায়।