সম্রাট অশোক ও তার অজানা নবরত্ন
ইংরেজদেরও অনেক আগে ভারতবর্ষে ভিনদেশীদের পা পড়েছিল। পারস্য, গ্রীক, আফগান, আরব, মোঘলরা বারবার খুঁচে খুঁচে রক্তাক্ত করেছে ভারতবর্ষের বুক। লুটেপুটে নিয়েছে অজস্র ধনসম্পদ। কেউ কেউ তো বলেন, আজকের ব্রিটিশ সাম্রাজ্য গড়েই উঠেছে ভারতবর্ষ থেকে লুটে নেয়া সম্পদের বদৌলতে। তবে পাহাড়প্রমাণ সম্পদ আর জ্ঞান যে এক নয়, তা তো সবাই জানে। জ্ঞান কখনো হরণ করা যায় না। তাই তো মহাবীর, কণাদ, চাণক্য, কৌটিল্যের মতো জ্ঞানী গুণীদের কদর ছিল, আছে, থাকবে। এরমাঝেও কিছু জ্ঞান রয়েছে, যা এখনো আমাদের অনেকেরই অজানা। হতে পারে এগুলো কিংবদন্তী, কিংবা হতে পারে সত্যিই এমনসব জ্ঞানের চর্চা প্রাচীন ভারতে ছিল, যা এখনও আমাদের গোচরে আসেনি। এমনই একটি জ্ঞানীর সংঘ হচ্ছে সম্রাট অশোকের অজানা নবরত্ন। ধারণা করা হয়, আজ থেকে প্রায় দুই হাজার বছর আগে সম্রাট অশোক রাজনৈতিক ও সামাজিক নানা পটপরিবর্তনের জন্য এমন একটি সংঘ গড়ে তুলেছেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারদর্শী নয় জন বিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন এই সংঘের সদস্য। তা সম্পর্কেই আজ কিছু জেনে নেয়া যাক-
উৎপত্তির ইতিহাস
সম্রাট অশোক খ্রিস্টপূর্ব ২২৬ সালে গড়ে তুলেছিলেন দ্য সিক্রেট সোসাইটি অব নাইন আননৌন মেন। কিংবদন্তীতুল্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের যোগ্য এই উত্তরসূরি পিতামহের সাম্রাজ্য কীভাবে অক্ষুণ্ণ রাখা যায়, তা নিয়ে সর্বৈব চিন্তা করতেন। কলকাতা এবং মাদ্রাজের মধ্যবর্তী অঞ্চলগুলোতে কলিঙ্গ সাম্রাজ্য যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। সম্রাট অশোকের সেনারা প্রায় এক লাখ কলিঙ্গ যোদ্ধা এবং প্রায় দেড় লাখ গ্রামবাসীকে হত্যা করে। তবে ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই যুদ্ধে জয়লাভ করেও সম্রাট অশোকের মনে শান্তি ছিল না। বরং এর ভয়াবহতায় আরো মুষড়ে পড়েন তিনি। এই হানাহানি ভালো কিছু বয়ে আনে না, বইয়ে দেয় রক্তগঙ্গা- এই চিন্তাটিই অশোককে শোকে মূহ্যমান করে দিয়েছিল। কলিঙ্গ যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে অশোক শপথ নেন, বাকি জীবনে আর যুদ্ধ করবেন না তিনি। বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হলেন সম্রাট অশোক। সমগ্র ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের কথা প্রচার করতে শুরু করলেন তিনি। এছাড়াও মালয়, সিলন, ইন্দোনেশিয়াতেও প্রচার শুরু করলেন জোরেশোরে। বৌদ্ধধর্মে তার শিক্ষা পরবর্তীতে চীন, নেপাল ও মঙ্গোলিয়াতেও বেশ প্রভাব বিস্তার করেছিল। সম্রাট নিজে একজন নিরামিষাশী ছিলেন তবে অন্যদের জোর করেননি তার মতো নিরামিষ খাবার গ্রহণ করতে। অন্যান্য ধর্মের প্রতিও ছিল তার অগাধ শ্রদ্ধা। মদ্যপানকে নিষিদ্ধ করেছিলেন অশোক।
পাওয়েল এবং বার্জিয়ের তাদের বইতে সম্রাট অশোক সম্পর্কে লিখেছিলেন, “বিদ্রোহী ও রক্তপিপাসায় মত্ত মানুষদের তিনি এটি বুঝিয়েছিলেন যে মানুষকে জয় করা যায় কেবল ভালোবাসার মাধ্যমে। ঈশ্বর খুশি হন মানুষের বদান্যতা আর মহৎ কাজে, সেটিই ছিল অশোকের শিক্ষা। জীবিত সকল প্রাণীর রয়েছে নির্বিঘ্নে, শান্তিতে এবং আনন্দে বাঁচার অধিকার। অশোক তার কথায় এবং কাজের মাধ্যমে এগুলোই প্রচার করতেন।”অশোক তার এই মিশন সম্পূর্ণ করতে কাছের কিছু মানুষকে নিয়ে একটি সংঘ গড়ে তুলেন। খারাপ কাজ থেকে কীভাবে মানুষকে দূরে রাখা যায়, কীভাবে অন্যের ক্ষতিসাধন না করে একত্রে বসবাস করা যায়, সেটিই ছিল এই সংঘের কাজ। তবে অশোকের পক্ষে সবকিছু একসঙ্গে দেখা সম্ভব ছিল না। যেহেতু রাজ্য শাসন করার বিশাল দায়িত্ব ছিল তার কাঁধে, ভারতবর্ষের নয়জন বিচক্ষণ এবং গুণী ব্যক্তিকে এই তদারকির ভার দিলেন অশোক। নিরাপত্তার খাতিরে এই নয়জনের নাম কখনো প্রকাশ পায়নি। গড়ে উঠল সম্রাট অশোকের অজানা নয় রত্নের সংঘ।
প্রকৃতি থেকে শুরু করে মনোবিজ্ঞান, যে শাখায় যতটুকু জ্ঞান আহরণ করা সম্ভব, তার সবটুকু থেকে নেয়া শুরু করলেন এই নয় ব্যক্তি। সাধারণ মানুষ যদি এই বিজ্ঞানের কথা জেনে ফেলে, তা ধ্বংস ছাড়া আর কিছু ডেকে আনবে না- এই ভেবে সেগুলো প্রচারও করতেন না তারা। বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব, তথ্য ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সর্বক্ষেত্রে বিচরণ করার সুযোগ ও অনুমতি তাদের প্রদান করেছিলেন অশোক। প্রত্যেকের দায়িত্ব ছিল একটি করে বিশেষ বই রচনা করা, যে ক্ষেত্রে তারা পারদর্শী ছিল। সময়ে সময়ে সেগুলো পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জিত করত তারা। তবে এখানে একটি কথা রয়েছে। কেউ যদি তার ওপর অর্পিত বইটি শেষ করতে না পারতেন, তাহলে পরবর্তী উত্তরসূরির কাছে চলে যেত সে বইয়ের দায়িত্ব। এক্ষেত্রে সংঘের সদস্য সংখ্যা আর বাড়ানো হতো না। নয় সংখ্যাটিকে ধরে রাখা হতো ধ্রুব। রোগে শোকে ভুগলে, কিংবা মৃত্যুবরণ করলে কিংবা কেউ যদি স্বেচ্ছায় নিজের দায়িত্ব ছেড়ে দিতে চাইত, সাদরে আমন্ত্রণ জানানো হতো। তবে শপথ করতে হতো যে সে তার নাম এবং তার কাজ কারও কাছে প্রকাশ করবে না। ধারণা করা হয়, অজানা এই নবরত্নের সংঘটির আয়ুষ্কাল প্রায় দু’হাজার বছর।

ট্যালবট মান্ডির বই
নবরত্নের লেখা নয়টি বইয়ের বিষয় ও সংসর্গ ছিল তুলনাহীন। ইংরেজ লেখক ট্যালবট মান্ডি ১৯২৩ সালে একটি বই লিখেছিলেন যার নাম ছিল ‘দ্য নাইন আননোন ম্যান’। এই বইতে তিনি নয়টি বইয়ের তালিকা দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন সম্রাট অশোকের নবরত্ন এই নয়টি বিষয়ের ওপর কাজ করেছিলেন। সর্বজনবিদিত এই বিষয়গুলো হচ্ছে-
১) প্রোপাগান্ডা– কীভাবে প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হয়, যায় এবং মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ কীভাবে সংঘটিত হয়, সেটি ছিল প্রথম বইয়ের বিষয়। মান্ডির মতে, “জনমতকে বদলে হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ংকর বিজ্ঞান, কারণ এর ফলে বিশ্বের যে কেউ রাজত্ব করবার এখতিয়ার পেয়ে যায়।”
২) শারীরবিদ্যা– এই বইটি শারীরবিদ্যা সম্পর্কে হলেও বিষয় খুবই ভয়াবহ।কেবলমাত্র ছুঁয়ে কীভাবে একজনকে হত্যা করা যায়, তার বিষদ বর্ণনা দেয়া আছে এই বইতে। মান্ডির ধারণা, মার্শাল আর্ট এবং জুডোর যেসব কায়দায় একজনের শরীরের প্রেশার পয়েন্টে চাপ দিয়ে হত্যা করা যায়, তারই বর্ণনা রয়েছে এই বইতে।
৩) অণুজীববিদ্যা– মান্ডির মতে, এখানে এমন সব অণুজীব নিয়ে কথা বলা আছে, যেগুলো সম্পর্কে বর্তমান কালের বিজ্ঞানীরাও খুব বেশি কিছু জানেন না। এই বইতে অণুজীববিদ্যা নিয়ে নানা দিক আলোকপাত করা হয়েছে।
৪) আলকেমি– ধাতু থেকে কীভাবে স্বর্ণ তৈরি করা যায়, তার ব্যাখ্যা ছিল এই বইতে। একটি কিংবদন্তীর সূত্রানুসারে, দুর্ভিক্ষের সময় রাজ্যের মন্দির ও ধর্মীয় স্থাপনাগুলো থেকে গ্রাম্যদের “একটি গোপন সূত্র” থেকে স্বর্ণ উত্তোলন করে দেয়া হতো। কীভাবে আসত এই স্বর্ণ, তা সম্পর্কে আজও কেউ জানতে পারেনি। মান্ডি বলেছেন, এই বইতে নাকি পৃথিবীর কোথায় স্বর্ণের খনি আছে এবং কোন ধাতু থেকে স্বর্ণ পাওয়া যাবে, তা নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া আছে।
৫) যোগাযোগ– যোগাযোগ বলতে এখানে শুধু মানুষে মানুষে যোগাযোগের কথা বলা হয়নি। পৃথিবীর বাইরে যারা বাস করে, অর্থাৎ ভিনগ্রহবাসীদের সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করা সম্ভব, তা নিয়ে কথা বলা আছে এই বইতে। মান্ডির মতে, সম্রাট অশোকের নবরত্নের মাঝে থাকা এই ব্যক্তির সঙ্গে ভিনগ্রহবাসীদের যোগাযোগ ছিল।
৬) মহাকর্ষ অভিকর্ষ– কীভাবে আকাশে ভেসে থাকা যায়, কীভাবে বিমান তৈরি করা যায়, তা বর্ণনা করা আছে এই বইতে। রামায়ন মহাভারতে বর্ণিত আকাশযান সত্যিই ছিল কিনা, তা নিয়ে নাকি বর্ণনা করা হয়েছে এখানে।
৭) সৃষ্টিতত্ত্ব– মহাবিশ্ব কীভাবে তৈরি হলো, কীভাবে স্রষ্টা এই জগত পরিচালনা করছেন, সেসব নিয়ে লেখা আছে এই বইতে।
৮) আলোকবিদ্যা– এই বইতে আলোকে কীভাবে অস্ত্রে পরিণত করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও আলোর সঙ্গে গতির সমন্বয় করে পদার্থবিদ্যার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করা হয়েছে এই বইতে।
৯) সমাজবিদ্যা– শেষ বইটি লেখা হয়েছে সমাজ নিয়ে। একটি সমাজ কীভাবে চলবে, কীভাবে সেখানে মানুষ বসবাস করবে, তাদের ধ্বংস কীভাবে আসবে, সেসব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এখানে।
সত্য নাকি পুরোটাই বানোয়াট?
অশোকের এই অজানা নবরত্ন কি আসলেই ছিল? তৎকালীন সময়টা ছিল খুবই দুর্যোগপূর্ণ। চারপাশের রাজ্যগুলো যেকোনো সময় আঘাত হানবার সুযোগ খুঁজছে। একজন রাজা চাইবেন তার আহরিত জ্ঞানগুলো এক জায়গায় একাট্টা করে সংরক্ষিত করে রাখতে। হয়ত অশোকের মতো আরো অনেকেই এমন কাজ করেছিলেন।বিদ্যাবুদ্ধি, যুদ্ধক্ষেত্রে, রাজ্য চালনায়, সমাজ ব্যবস্থায় এই বিজ্ঞ ব্যক্তিদের দর্শন ও সুপরামর্শ একটি সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে অনেকাংশে সাহায্য করে, সেটি বলাই বাহুল্য। তারপরও একটি কথা থেকে যায়। প্রায় ২ হাজারেরও বেশি সময় ধরে গোটা বিশ্বে এমন একটি সংঘ নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করে আসছে ভারতের দূর্গম এক অরণ্যের কোলে, সেটি ভাবাও যেন বিস্ময়কর! আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্র, প্রযুক্তি, কাঠামোর চেয়ে সম্রাট অশোকের এই নবরত্নের ভাণ্ডার অনেক বেশি ছিল, এমনটা যেন বিশ্বাস হতেও হতে চায় না।
নাসার বিজ্ঞানীরা যেখানে এখনো ভিনগ্রহের প্রাণীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলার জোগার করেছেন, সেখানে সম্রাট অশোকের সময়ে এটি নিয়ে বইও লেখা হয়ে গিয়েছে, এটি ভাবতেও কেমন যেন রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে শরীর। আবার অনেকে বলেন, যদি সত্যিই এমন কিছু থাকত, তাহলে প্রমাণ কই? সে বইগুলো কোথায়? এত যত্ন করে লেখা বইগুলো কী করা হয়েছে? কালের আবর্তে হারিয়ে গিয়েছে নাকি আদতে তেমন কিছু লেখাই হয়নি? মান্ডি বলেন, “আমাদের চেনা জগতের বাইরেও অনেক কিছু আছে। সেটা এখনো খুঁজে উঠতে পারিনি আমরা। কেউ চাইতেন আমরা সেগুলো খুঁজে পাই, এগিয়ে যাক সভ্যতা। আবার কেউ সেগুলো লোকচক্ষুর অন্তরালেই রেখে দিতে চেয়েছিলেন। হয়ত সম্রাট অশোকও ছিলেন তাদের মাঝে একজন!”