আজই সাতক্ষীরায় উড়েছিল রক্তের বিনিময়ে কেনা লাল সবুজের পতাকা
আজ গৌরবোজ্জ্বল ৭ ডিসেম্বর। সাতক্ষীরা হানাদারমুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশকে হানাদারমুক্ত করতে সাতক্ষীরার শ্যামলমাটি রক্তে রঞ্জিত করে ছোট বড় অন্তত ৫০টি যুদ্ধে অংশ নেয় মুক্তিকামী দামাল ছেলেরা। অবশেষে ৭ ডিসেম্বর রক্তের সিঁড়ি বেয়ে হানাদারমুক্ত হয় সাতক্ষীরা।
১৯৭১ সালের এই দিনে সাতক্ষীরার দামাল ছেলেরা থ্রি নট থ্রি রাইফেল আর এসএলআরের ফাঁকা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে সাতক্ষীরা শহরে প্রবেশ করে। মুক্তিকামী জনতার কন্ঠ থেকে বেরিয়ে আসে বারুদ ফোটা অবিনাশী স্লোগান-তুমি কে আমি কে-বাঙালি বাঙালি, মুক্তিযোদ্ধা জনতা- গড়ে তোল একতা, তোমার আমার ঠিকানা-পদ্মা মেঘনা যমুনা, শেখ মুজিবের পথ ধর-বাংলাদেশ স্বাধীন কর, বাঁশের লাঠি তৈরি কর-বাংলাদেশ স্বাধীন কর, জয় বাংলা। এভাবে স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে সাতক্ষীরার অলি-গলি। ওড়ানো হয় স্বাধীন বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা। সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে রাস্তায় নেমে আসে মুক্তিকামী আপামর জনতা। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ সাতক্ষীরা শহরে পাকিস্তান বিরোধী মিছিলে রাজাকাররা গুলি করলে শহীদ হন আব্দুর রাজ্জাককে।
এর পরই গর্জে উঠে রুখে দাঁড়ায় সাতক্ষীরার দামাল ছেলেরা। তারা যোগ দেয় মহান মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধের খরচ বহনের জন্য ব্যাংক থেকে টাকা ও অলংকার লুট এবং অস্ত্র লুটের দিয়ে শুরু করেন মুক্তিযুদ্ধ। ৮ম ও ৯ম সেক্টরের অধীনে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় ট্রেনিং শেষে ২৭ মে সাতক্ষীরার ভোমরা সীমান্তে প্রথম সম্মুখ যুদ্ধ শুরু হয়। এ সময় দুই শতাধিক পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। ১৭ ঘণ্টাব্যাপী এ যুদ্ধে শহীদ হন তিনজন মুক্তিযোদ্ধা। আহত হন আরও দুইজন মুক্তিযোদ্ধা। এরপর থেমে থেমে চলতে থাকে সাতক্ষীরার বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের গুপ্ত হামলা। এসব যুদ্ধের মধ্যে ভোমরার যুদ্ধ, টাউন শ্রীপুর যুদ্ধ, বৈকারী যুদ্ধ, খানজিয়া যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। এ সব যুদ্ধে শহীদ হয় ৩৩ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। পাকিস্তানি সেনা বাহিনীকে বিদ্যুতের আলো থেকে বিচ্ছিন্ন করতে ৩০ নভেম্বর টাইম বোমা দিয়ে শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত পাওয়ার হাউস উড়িয়ে দেয় মুক্তিযোদ্ধারা। এতে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে যায় পাক হানাদার বাহিনী। রাতের আঁধারে বেড়ে যায় গুপ্ত হামলা। পিছু হটতে শুরু করে হানাদাররা।
৬ ডিসেম্বর রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় টিকতে না পেরে বাঁকাল, কদমতলা ও বেনেরপোতা ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী সাতক্ষীরা থেকে পালিয়ে যায়। ৬ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হয় দেবহাটা ও কলারোয়া। ৭ ডিসেম্বর জয়ের উন্মাদনায় জ্বলে ওঠে সাতক্ষীরার মুক্তিকামী জনতা।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সাতক্ষীরার শ্যামল মাটি যাদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল জাতীর সেই শ্রেষ্ঠ বীর সন্তানেরা হলেন- শহীদ আব্দুর রাজ্জাক, কাজল, খোকন, নাজমুল, হাফিজউদ্দিন, নুর মোহাম্মদ, আবু বকর, ইমদাদুল হক, জাকারিয়া, শাহাদাত হোসেন, আব্দুর রহমান, আমিনউদ্দিন গাজী, আবুল কালাম আজাদ, সুশীল কুমার, লোকমান হোসেন, আব্দুল ওহাব, দাউদ আলী, সামছুদ্দোহা খান, মুনসুর আলী, রুহুল আমীন, জবেদ আলী, শেখ হারুনার রশিদ প্রমুখ।
সাতক্ষীরা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ইউনিট কমান্ডার মোশারফ হোসেন মশু বলেন, এ দিনে সাতক্ষীরাকে হানাদারমুক্ত করা হয়েছিল। এই দিনটি সাতক্ষীরার মানুষের জন্য গর্বের দিন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আগামীর উন্নয়নশীল দেশগড়ার প্রত্যয়ে জেগে ওঠার দিন আজ। আজ কোন কান্না নয়, আজ আনন্দের দিন। রক্তের সিঁড়ি বেয়ে অর্জিত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার দিন।
আজ সাতক্ষীরাবাসির বিজয়ের দিন। নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে এবার সাতক্ষীরামুক্ত দিবস পালিত হচ্ছে।