বৃহস্পতি কেন সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে না?
ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি প্লানেটস অরবিট ‘দ্যা সান’ অর্থাৎ আমাদের সৌরমণ্ডলের সমস্ত গ্রহ সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। সোলার সিস্টেমের যে কোনো ছবি হোক বা ভিডিও সেখানেও আমরা এটাই দেখে এসেছি যে সব গ্রহ সূর্যের চারপাশে ঘুরছে। কিন্তু আমি আপনাদের বলেছি যে যা কিছু আপনি পড়েছেন বা ভিডিওতে দেখেছেন তা টেকনিক্যালি সঠিক নয় অর্থাৎ গ্রহ রা সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে এই কথাটা টেকনিক্যালি ভুল। হ্যাঁ এটা একদম সত্যি। আকাশ থেকে পড়ার মত শোনালেও আসলে গ্রহরা সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে না।
এবারে কিছু প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক, তাহলে গ্রহরা কাকে বা কার চারপাশে ঘোরে? আর কেনোই বা আমাদের এমনটা পড়ানো হয় ছোট থেকে? সেই সমস্ত ছবি বা ভিডিও কি ভুল? যেখানে দেখানো হয় গ্রহরা সূর্যকে চক্কর কাটছে? এর উত্তর হলো ঐ সমস্ত ছবি বা ভিডিওগুলো একেবারে ভুল নয়। আর ছোটবেলায় আমাদের এমনটা পড়ানো হয় এই কারণে যাতে আমরা জটিল টেকনিক্যাল বিষয়গুলো না বুঝেও সৌরজগত সম্পর্কে সহজেই একটা ভাল ধারণা পেতে পারি।
আমাদের আজকের আলোচনার মাধ্যমে আমরা বিস্তারিত জেনে নেব যে, সৌরজগতের উপস্থিত গ্রহ উপগ্রহগুলো আসলে কাকে প্রদক্ষিণ করে এবং সূর্য নিজের চারপাশে ঘোরে। তবে চলুন এবার শুরু করা যাক। আজ অব্দি আমরা এটা জেনে বড় হয়েছি যে গ্রহরা তার নক্ষত্রের চারপাশে প্রদক্ষিণ করেন। আগেই বলেছি এই ধারণা সঠিক নয়। আসলে যেটা হয় গ্রহ এবং তার নক্ষত্র দুজনেই নিজেদের কমন সেন্টার অফ মাস এর চক্কর কাটে। এই কমন সেন্টার অফ মাস কে টেকনিক্যাল ভাষায় ব্যারি সেন্টার বলা হয়। আসুন জেনে নেই এই ব্যারি সেন্টার জিনিসটা কি। এবং সব কিছু কিভাবে কাজ করে?
ব্যারি সেন্টার কি এবং কোথায় থাকে বোঝার আগে আপনার জানা প্রয়োজন কোন বস্তুর সেন্টার অফ মাস বা ভরকেন্দ্র আসলে কি? সহজভাবে বললে ভরকেন্দ্র বা সেন্টার অফ মাস হল কোন বস্তুর মধ্যে কার এমন একবিন্দু বা স্থান যেখানে একটা আঙুল দিয়ে তাকে সহজে ব্যালেন্স করা যায়। যে কোনো বস্তুরই ভরকেন্দ্র অবশ্যই রয়েছে। যে বস্তুর ক্ষেত্রে যার ভর পুরটা জুড়ে সমানভাবে বিস্তৃত থাকে সেই বস্তুর ক্ষেত্র্রিতসেন্টার অফ মাস সাধারণত তার একদম মাঝামাঝি থাকে। উদাহরণ হিসেবে একটা রুলার বা স্কেলকে ধরা যেতে পারে। কিন্তু সব বস্তুর ক্ষেত্রে ভরকেন্দ্র তার মাঝামাঝি থাকে না। যেমন একটা হাতুড়ির ক্ষেত্রে সমগ্র ভর বা মাস গোটা বডিতে সমানভাবে বিস্তৃত নয় এর লোহার অংশটির ভর বেশি এবং কাঠের অংশটির ভর কম। স্বাভাবিকভাবেই এটাকে আমরা মাঝখানে আঙুল দিয়ে ব্যালেন্স করতে পারব না। কাজেই এক্ষেত্রে সেন্টার অফ মাস লোহার অংশটির দিকেই আমরা খুঁজে পাবো।
তাহলে আমরা এই উদাহরণ দুটা থেকে কি জানলাম? আমরা জানলাম যে যদি কোন বস্তুর মাস সমানভাবে ডিস্ট্রিবিউটর হয় তবে তার ক্ষেত্রে ভরকেন্দ্র একদম তার মাঝখানে থাকবে। কিন্তু যদি কোন বস্তুর মাস সমানভাবে ডিস্ট্রিবিউটর না হয় তাহলে যে প্রান্তে ভর বেশি সেইদিকেই ভর কেন্দ্র থাকবে। চলুন এবার ব্যারি সেন্টার সম্পর্কে কনসেপ্ট ক্লিয়ার করে নেয়া যাক। যেভাবে প্রত্যেকটি সিঙ্গেল অবজেক্টে একটা সেন্টার অফ মাস থাকে তেমনি মহাকাশে অবস্থিত যে কোন দুটো অবজেক্টের ক্ষেত্রেও একটা কমন সেন্টার অফ মাস থাকে যাকে ব্যারি সেন্টার বলা হয়। এই ব্যারি সেন্টারের চারপাশেই গ্রহ এবং তার নক্ষত্র দুজনেই ঘুরপাক খায়।
প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক তাহলে এই ব্যারি সেন্টার কোথায় থাকে। এর সহজ উত্তর হল ব্যারি সেন্টার কোন ফিক্সড পজিশনে থাকে না। ব্যারি সেন্টারের পজিশন দুইতা অব্জেক্টের মাসের ওপর নির্ভর করে। যদি দুইটার মধ্যে একটার ভর বা মাস অন্যটির থেকে বেশি হয় তাহলে তাদের ব্যারি সেন্টার স্বাভাবিকভাবেই বড় অবজেক্ট এর কাছাকাছি থাকবে। উদাহরণ হিসেবে যদি সূর্য এবং পৃথিবীর কথা বলি তাহলে পৃথিবীর তুলনায় সূর্যের ভর অনেক গুন বেশি। সেজন্যই সূর্য এবং পৃথিবীর ব্যারি সেন্টার সূর্যের নিজের কেন্দ্রের একদম কাছাকাছি অবস্থান করে। সূর্য এবং পৃথিবী দুজনেই এই কমন ব্যারি সেন্টারের প্রদক্ষিণ করে। যেহেতু আমরা পৃথিবীর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছি তাই আমাদের মনে হয় পৃথিবী ব্যারি সেন্টারের নয় বরং সূর্যের প্রদক্ষিণ করছে। কিন্তু ব্যারি সেন্টারের কন্সেপ্টটা তখন একদম ক্লিয়ার হয়ে যায় যখন আমরা জুপিটার অর্থাৎ বৃহস্পতি গ্রহের উদাহরণ দেখি।
বৃহস্পতি গ্রহ পৃথিবীর থেকে বহুগুণ বড় এবং এর মাস পৃথিবীর প্রায় তিনশো আঠারো গুন বেশি। এবারে বৃহস্পতি ও সূর্যের ব্যারি সেন্টারের ব্যাপারে বললে বৃহস্পতি গ্রহের বিশালতার জন্য ব্যারি সেন্টার সূর্যের কেন্দ্র থেকে অনেকটা দূরে এর বাইরে গিয়ে তৈরি হয়। যেহেতু সূর্য এবং বৃহস্পতি গ্রহ এই কমন সেন্টার অফ মাসের চক্কর কাটে তাই কিছুটা এমন দৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। হতে পারে আপনাদের মধ্যে অনেকেই এখনো এটা বুঝে উঠতে পারেননি যে দুটো অব্জেক্টের মাসের ব্যাবধান হলে ব্যারি সেন্টারের লকেশনে কতটা প্রভাব পড়ে এবং এর ফলে দুটো অবজেক্টের অরবিট বা কক্ষপথে কি পার্থক্য দেখা যায়। ধরা যাক দুই অবজেক্ট একদম সমান। তাহলে এদের ব্যারি সেন্টার একদম মাঝামাঝি অবস্থান করছেন ফলে এই দুইটা অবজেক্টই তাদের কেন্দ্রকে প্রদক্ষিণ করছে।
আবার যদি এমন হয় যে দুই তা অব্জেক্টের মধ্যে একটা অব্জেটের মাস বেশি তখন দেখা যাবে যে এদের কেন্দ্র বেশি মাসওলা অব্জেক্টের কাছাকাছি রয়েছে। আর এইখানেও এই দুই তা অব্জেক্ট তাদের ব্যারি সেন্টারের প্রদক্ষিণ করছে। যখন একটি অব্জেক্টটি অনেক বেশি বড় থাকবে আর অন্য অব্জেক্টটি তুলনামুলক ভাবে ছোট হয় তখন ও কিন্তু তারা তাদের ব্যাই সেন্টারকে প্রদক্ষিণ করে কিন্তু ছোট অব্জেক্টের দৃষ্টিকোণ থেকে ভাল করে দেখলে মনে হবে যে ছোট অব্জেক্টটি বড় অব্জেক্টকে প্রদক্ষিণ করছে। ঠিক এ রকমটাই ঘটে সূর্য এবং পৃথিবীর সহ অন্যান্য গ্রহ উপগ্রহের ক্ষেত্রে। পৃথিবী থেকে দেখলে আমাদের মনে হয় আমরা সূর্যের চারপাশে ঘুরছি কিন্তু আসল ব্যাপারটা আপনি কিন্তু এবার জেনে গেলেন।
আমাদের গোটা সোলার সিস্টেমের একটা ব্যারি সেন্টার আছে। সোলার সিস্টেমে থাকা সব অবজেক্টের কম্বাইন্ড মাস মিলিত ভরের সেন্টার কেই আসলে সূর্য্য সহ সব গ্রহ উপগ্রহ প্রদক্ষিণ করে। সৌরজগতের এই কমন ব্যারি সেন্টারের চক্কর কাটে সব অব্জেক্ট কিন্তু এই ব্যারি সেন্টার সব সময় এক জায়গায় থাকে না। প্রত্যেক বছর এর স্থান পাল্টাতে থাকে। যেহেতু শুধুমাত্র সূর্যের ভর আমাদের গোটা সোলার সিস্টেমের প্রায় ৯৯.৮ শতাংশ তাই বেশিরভাগ সময় আমাদের সৌরমণ্ডলের ব্যারি সেন্টার সূর্যের ভেতরেই অবস্থান করে। কিন্তু কখনো কখনো এটা সূর্যের সার্ফেসের বাইরের স্পেস এ অবস্থান করে ব্যারি সেন্টারের প্রদক্ষিণ করার ফলেই সূর্য নিজের জায়গা থেকে নড়াচড়া করতে থাকে। যেহেতু বেশিরভাগ সময় ব্যারি সেন্টার সূর্যের ভেতরে বা কেন্দ্রের কাছেই থাকে তাই সমস্ত গ্রহ একেই প্রদক্ষিণ করতে থাকে। সে জন্যই আমাদের মনে হয় যে গ্রহরা ব্যারি সেন্টারের নয় বরং সূর্যের প্রদক্ষিণ কাটছে। তাই সহজ ভাষায় বলে দেয়া হয় যে সমস্ত গ্রহ উপগ্রহ সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। কিন্তু বছর বছর আমাদের সলার সিস্টেমের ব্যারি সেন্টার পরিবর্তন হতে থাকে।
ব্যারি সেন্টারের কনসেপ্ট সমস্ত অব্জেক্টের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য সেটা কোন গ্রহ নক্ষত্র হোক বা গ্রহ উপগ্রহ হোক। আমাদের পৃথিবীর উপগ্রহ চাঁদের থেকে অনেকটাই বড়। তাই দুজনের ব্যারি সেন্টার পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে মাত্র চার হাজার ছয়শ একাত্তর কিলোমিটার দূরে তৈরি হয়। এই পয়েন্টকে পৃথিবী ও চাঁদ দুই জনেই চক্কর কাটে। ব্যারি সেন্টার কনসেপ্টকে কাজে লাগিয়ে দূরে অবস্থিত গ্রহের আবিষ্কার করা হয়ে থাকে।