তারেক-ফখরুল লড়াই: খালেদার কাছে বিচার
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের মনোনয়ন এবং ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি নিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়ার সঙ্গে দলটির সিনিয়র নেতাদের স্পষ্ট দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের কারান্তরীণ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সাক্ষাৎ প্রার্থনা করেছেন।
বৃহস্পতিবার (২২ নভেম্বর) দুপুরে মির্জা ফখরুল খালেদা জিয়ার সঙ্গে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের সাক্ষাৎ প্রয়োজন উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন করেছেন। মির্জা ফখরুল চিঠিতে বলেছেন, যেহেতু খালেদা জিয়া দলের প্রধান তাই নির্বাচনের জন্য বিএনপির মনোনয়ন চূড়ান্ত করতে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা প্রয়োজন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সাক্ষাতের অনুমতি দেবে বলেই আশা করছে বিএনপি। তবে দলটির একাধিক সূত্র বলছে, যদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অনুমতি না দেয় তাহলে তারা হাইকোর্ট থেকে সাক্ষাতের অনুমিতি নেওয়ার চেষ্টা করবেন।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই তাঁর পুত্র তারেক জিয়ার সঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যদের চার ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছিল।
১। খালেদা জিয়ার গ্রেপ্তার হওয়ার আগে অতীতে যাদেরকে বহিষ্কৃত, ওয়ান ইলেভেনের সময় সংস্কারপন্থী ছিল, এমন নেতাদের সমন্বিত ভাবে আবার বিএনপিতে আমন্ত্রণ জানান। তিনি সংস্কারপন্থীদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মনজুরুল আহসানের নেতৃত্বে তাঁদের কাজ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু একাদশ নির্বাচনের জন্য তারেক জিয়া যে মনোনয়ন চূড়ান্ত করেছেন সেখানে দেখা যাচ্ছে, তিনি সংস্কারপন্থীদের মনোনয়ন দেওয়ার পক্ষপাতী নন। কিন্তু বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য মনে করেন, অধিকাংশ সংস্কারপন্থীই এলাকায় অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং জনপ্রিয়। যেহেতু এই নির্বাচনে জয়লাভ করাই আসল কথা তাই সংস্কারপন্থীদের মনোনয়ন দেওয়া প্রয়োজন।
২। গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বিএনপির চেয়ারপারসন একথাও বলেছিলেন যে, যারা বিএনপির সঙ্গে ঐক্যে আসবে, তাদের জন্য দলকে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। নিজের শেষ সাক্ষাৎকারে তিনি এমন কথাও বলেছিলেন, প্রয়োজনে বিএনপি একটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে কিন্তু তারপরও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরাতে হবে। শরিকদের স্বার্থে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করার জন্য বিএনপি নেতাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। কিন্তু এখন তারেক জিয়া মনোনয়নের যে ছকবিন্যাস করেছেন তাতে শরিকদের জন্য ৪০ থেকে ৫০টির বেশি আসন রাখা হয়নি। জানা গেছে, এ কারণে শরিকরা বিএনপির ওপর অসন্তুষ্ট। অবস্থার পরিবর্তন না হলে শেষ পর্যন্ত শরিকদের ঐক্যের মধ্যে রাখা যাবে কিনা তা নিয়েও সংশয় সৃষ্টি হয়েছে।
৩। ঐক্যফ্রন্ট গঠনের আগে ঐক্যফ্রন্টের সকল দলের একটি সমন্বিত নির্বাচনী ইশতেহারের কথা বলা হয়েছিল। উল্লেখ্য যে, সমন্বিত ইশতেহার ছিল ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম দাবি। কিন্তু তারেক জিয়া নিজস্ব উদ্যোগে লন্ডন থেকে একটি ইশতেহার তৈরি করছেন যে ইশতেহারের সঙ্গে ঐক্যফ্রন্টের অনেক দলের অবস্থান সাংঘর্ষিক। সেজন্য ফ্রন্টের মধ্যে এই ইশতেহার নিয়ে একটি বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, তারেক জিয়ার ইশতেহারে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলা হয়েছে যার সঙ্গে ঐক্যফ্রন্টের অনেক দলই একমত নয়। এ প্রসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের বক্তব্য হচ্ছে, নির্বাচনে সময় এই বিষয়গুলো সামনে না এনে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব দেওয়াটাই শ্রেয়। ইশতেহারের বিষয়েও তারেক জিয়ার সঙ্গে একমত নয় বিএনপির এই নেতারা।
৪। তারেক জিয়ার সঙ্গে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে দলের অনেক সিনিয়র নেতাকে মনোনয়ন না দেওয়ার ইস্যুতে। একাদশ নির্বাচনে তারেক জিয়া একাধিক প্রবীণ-সিনিয়র নেতাকে মনোনয়ন থেকে বাদ দিচ্ছেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে যা সিনিয়র নেতাদের অসন্তুষ্ট করেছে। বিএনপির সিনিয়র নেতাদের অভিমত, এখন ধানের শীষে জোয়ার উঠেছে। এমন সময় দলের পরীক্ষিত সিনিয়র নেতাদের বাদ দেওয়াটা যৌক্তিক হবে না। জানা গেছে, তারেক জিয়া ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান ও ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলামসহ কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে বাদ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন। এই নেতাদের বাদ দেওয়াটা খারাপ নজির হবে বলে সিনিয়র নেতারা মনে করছেন।
বিএনপির সিনিয়র নেতারা এই বিষয়গুলো নিয়েই বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান। বিএনপি নেতারা বলেছেন, তারেক জিয়া কারো কথাই শুনতে চান না, তিনি শুধু সিদ্ধান্ত দেন। সেজন্যই খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলোচনা করে একটি সিদ্ধান্তে আসতে ইচ্ছুক বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা। এই জটিলতাগুলো মাথায় রেখেই বিএনপি প্রত্যেকটি আসনে একাধিক প্রার্থীকে মনোনয়ন পত্র জমা দিতে বলেছে বলে জানিয়েছে দলটির একাধিক সূত্র।