অন্যরকম এক রাজকন্যা
আলেক্সিওস কামনিনোস একজন বাইজানটাইন সম্রাট। তার সেনাবাহিনীকে একত্র করে সিদিআর যাযাবর গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করলেন। সৌভাগ্য কামনা করে যুদ্ধক্ষেত্রে সম্রাট তার সঙ্গে খ্রিস্টান ধর্মের একটি অন্যতম পবিত্র চিহ্ন বহন করতেন। সেটি ছিল কুমারী মেরির অবগুন্ঠন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এতেও সম্রাট পার পেলেন না। যুদ্ধে শুধুমাত্র তিনি পরাজিতই হলেন না, তার বিশাল সৈন্যদল পিছু হটলো এবং তাকে পশ্চাদ্দেশে ছুরিকাঘাত করা হলো। পালানোর সময় তিনি দেখলেন পবিত্র মেরীর অবগুন্ঠন প্রচন্ড বাতাসে বহন করা খুবই কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। তাই তিনি সেটিকে একটি ঝোপের ভেতর লুকিয়ে রেখে প্রাণ নিয়ে পালালেন। পরাজয় বরণ করেও আলেক্সিওস কিছু সিদীআর সৈন্যকে কতল করে তার নিজের বাহিনীর কয়েকজন কমরেডকে ছাড়িয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। হয়তো এজন্যই আলেক্সিওস এর কন্যা আনা দীর্ঘ ছয় দশক পরে ইতিহাসকে নতুন করে লিখতে পেরেছিল! আনা তার জীবনের শেষ দশক ব্যয় করেছিলেন তার বাবার প্রতিষ্ঠিত রাজ্য আলেক্সিয়ার ৫০০ পৃষ্ঠার সুদীর্ঘ ইতিহাস রচনা করে।
বইটি রচিত হয়েছিল গ্রীক ভাষায়। গ্রীক মহাকাব্যগুলো থেকে অনুপ্রাণিত ছিল এটি। কিন্তু গ্রিক উপকথার লেখকদের থেকে আনা আরো কৌশলী হতে হয়েছিলেন। একজন ঐতিহাসিকের মহান দায়িত্ব সামলানোর পাশাপাশি তাকে তার পরিবারের প্রতি আনুগত্যের কথাও ভাবতে হয়েছিল, যেখানে তার বাবার পশ্চাদ্দেশে ছুরিকাঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার মতো অপমানজনক ঘটনা জড়িয়ে ছিল। জীবনভর পড়াশোনা ও তার বাবার প্রশাসনে দায়িত্ব পালন আনাকে এসবের জন্য অনেকটাই প্রস্তুত করেছিল। ১০৮৩ খ্রিস্টাব্দে আলেক্সিওস এর কন্যা রাজকুমারী আনার জন্ম। তার মাত্র কিছু কাল আগেই রোমান সাম্রাজ্যে চলমান নৃশংস গৃহযুদ্ধ ও বিপ্লবের ফাঁক ফোকরের সুযোগ নিয়ে আলেক্সিওস রঝম দখল করেন। আলেক্সিওস যখন রোমান সাম্রাজ্যের ক্ষমতায় বসেন, রোমের তখন ভগ্নদশা। চারপাশে শত্রুদের হাতছানি। যেকোনো মুহূর্তে আঘাত হানার জন্য পূর্ব দিকে অপেক্ষা করছে সেইজুকরা, পশ্চিমে নরম্যানরা এবং উত্তরে সিদিআররা তো রয়েছেই। রাজকুমারী আনার পুরোটা শৈশব ও কৈশোরকাল কেটেছে চতুর্দিকের শত্রুদের কবল থেকে নিজেদের সীমানা রক্ষায় তার বাবার একের পর এক যুদ্ধযাত্রার দৃশ্য দেখে দেখে।
ওই সময় বাইজানটাইন এর রাজধানী কনস্টান্টিনোপলে আনা চালিয়ে যাচ্ছিল তার নিজের লড়াই। রাজকুমারী হিসাবে আচরণের নিয়ম কানুন ও বাইবেল আয়ত্ত করাই তার কথা ছিল। কিন্তু আনা তার আগ্রহ খুঁজে পেল পুরান ও দর্শন শাস্ত্রে। রাতের বেলা লুকিয়ে লুকিয়ে এসব বিষয়ে পড়তে পড়তে তার প্রাচীন গ্রিস এর ইতিহাস ও ভাষা সম্পর্কে বেশ ভাল ধারণা জন্মালো। তার এ আগ্রহ দেখে রাজা আলেক্সিওস তার জন্য গৃহ শিক্ষক নিযুক্ত করলেন। আনা আধুনিক সাহিত্য, গণিত, দর্শন, ইতিহাস ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্রে পড়াশোনায় আগ্রহ খুঁজে পেল। একজন পন্ডিত একবার এমন অভিযোগ করছিলেন যে, রাজকুমারী আনা তাকে অ্যারিস্টোটলের বক্তৃতা শোনানোর জন্য এতো এতো অনুরোধ করতো যে, তার মাথা ঘুরে যেত। ১৫ বছর বয়সে আনার বিয়ে হয় পার্শ্ববর্তী রাজ্যে রাজকুমার নিকেফোরাসের সঙ্গে। মূলত দুই পরিবারের মধ্যে শত্রুতা থামাতে এটি ছিল আলেক্সিওস এর একটি পরিকল্পনা।
নিকেফোরাসের সঙ্গে আনার পছন্দ অনেক জায়গাতেই মিলে যায়। দু’জনেই ছিলেন ইতিহাসের প্রচন্ড ভক্ত। আলেক্সিওস বেঁচে থাকার সময় আনা এবং নিকেফোরাস তার রাজ্য পরিচালনা উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করতেন। আলেক্সিওস এর মৃত্যুর পর আনার ভাই জন বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের সম্রাট হন। আনা ও তার স্বামী তখন পুরোপুরি জ্ঞান চর্চায় মনোনিবেশ করেন। নিকেফোরাস একটি ইতিহাস রচনা করেন যেখানে তিনি দেখান, তার হাতে যদি বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের ক্ষমতা থাকত তবে তিনি আলেক্সিওসের চেয়ে অনেক ভাল শাসক হতে পারতেন। স্বামীর এ ব্যাপারটি কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি আনা। তাই সে তার বাবা প্রয়াত সম্রাট আলেক্সিওসের প্রকৃত গুণাবলী ব্যাখ্যা করে একটি ইতিহাস রচনা করা শুরু করেন। বইটির নাম বিখ্যাত ‘আলেক্সিয়াড’। এই বইয়ে আলাদা শুধু তার বাবার স্তুতিই করেছে। মোটকথা বইটিতে বিচার ছিল। এজন্য আলেক্সিয়াড আজও বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য দলিল হিসেবে টিকে আছে।