সপ্ত সুরের সাধনায় : পলাশ মজুমদারের সাথে
সপ্ত সুর আর বাদ্য যন্ত্র মিলে মিশে আমাদের কখনো হাসায় কখনো কাঁদায়, আবার ঘুরিয়ে নিয়ে আসে স্মৃতির পাতায় । খেয়াল হোক বা লালন, নজরুলের সাধনা সংগীত । হয়তো রবীন্দ্রনাথের ভালোবাসার কোন সখির প্রতি, নিভৃতে যতনে প্রেমের করুণ আকুতি । সব টুকু যার কণ্ঠে মুগ্ধ হয়ে শুনতে ভালোলাগে । আবার নিরন্তর বাদ্য যন্ত্র সহ সপ্ত সুরের বিদ্যা দিয়ে চলেছেন হাজারো সংগীত পিপাসুদের কাছে । আজ দীপালোক একাডেমীর সংগীত শিক্ষক পলাশ মজুমদারের সাথে সাতক্ষীরাকে নিয়ে তার ভাবনা ও সংগীত জীবনের কিছু কথা নিয়ে আমাদের এই আয়োজন –
দৈনিক সাতক্ষীরা : শখ বা পেশা হিসেবে অনেক কিছুই তো আছে , কিন্তু গানের সাথে পথ চলা কেনো ?
উত্তর : যখন মায়ের কোল থেকে এক-দু পা করে হাটতে শিখছি, বাড়িতে থাকা রেকর্ডারে শাস্ত্রীয় সংগীতের খেয়াল শুনতে শুনতে গানের প্রতি মনের অবচেতনায় একটা ভালোবাসা তৈরি হয়। তার পর থেকেই সংগীত কে জীবনের একটি অংশ করে নিয়েছি ।
দৈনিক সাতক্ষীরা : সংগীত নিয়ে একটি স্মরণীয় ঘটনা বলুন ?
উত্তর : যে দিন টি ফেলে আসি সেটিই স্মরণীয় হয়ে যায় । স্মৃতির পাতা উল্টালে গুরুজির কাছে প্রথম ‘সা’ শেখা থেকে আজ আপনার সাথে কথা বলছি এটাও আমার কাছে কাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে । তবে কিছু কিছু সময়ে যে কথা গুলো বেশি মনে পড়ে-
সেদিন স্টেজের চারিদিকে অনেক দর্শক । মঞ্চে আমার ছাত্রী গান গাইছে ‘গোপাল কে দড়ি বেধে রাখিসনে আর ,ছেড়ে দে মা জননী ’ আর আমি তবলাই সঙ্গদিচ্ছি । হঠাৎ গানের মাঝে তাল হরিয়ে ফেলে গান বন্ধ হয়ে যায়। সেখানে বসেই কাঁদতে শুরু করে সে, উপস্থিত কয়েক শত দর্শক স্তব্ধ নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে দৃশ্য দেখে । না পারার ব্যথা যে সেদিন সবার মন কে ছুঁয়ে ফেলে ।
অনুষ্ঠানের আগে থেকেই ভয় ছিলো । আমরা তো আসলে গানের কণ্ঠ নিয়ে জন্ম গ্রহণ করিনা । সাধনা আর পরিশ্রমে জয় করতে পারি । সেদিনের পর মনে হয়েছিল আমার অর্জিত সব টুকু বিদ্যা তাকে দান করার উপায় থাকতো ? তবে হ্যাঁ সৃষ্টি কর্তার প্রতি তার জন্য অনেক চেয়েছিলাম। ব্যর্থতা থেকে কেউ হয়তো নতুন পথের সন্ধান পায় আবার কেউ ঝড়ে পড়ে । সে ও নতুন পথের সন্ধান পেয়েছিল । গোপালকে ছেড়ে দেবার জন্য মা যশোদার প্রতি যে আকুতি জানিয়ে ছিল । সেই আকুতি গোপালের কাছে সেদিন ঠিক পৌছে ছিল । আজ সত্যি তার কণ্ঠে গোপাল খেলা করে । আমার সে ছাত্রীর অনেক শ্রোতার মাঝে আমিও আজ তার এক জন শ্রোতা । সে কথা ভেবে আজ বড় ভালো লাগে ।
দৈনিক সাতক্ষীরা : সংগীত শিক্ষায় কার অনুপ্রেরণা সব থেকে বেশী ?
উত্তর : আসলে বাবা মায়ের কথা যদি বলেন , তবে তাদের কথা এভাবে বলে শেষ করা যাবেনা । তাদের সাপোর্ট টাই আসলে লাইফ সাপোর্ট । তবে সংগীতে আমার গুরু পূর্ণ চন্দ্র মন্ডল তার কাছেই তো হাতে খড়ি। এর পর দিল্লীর পন্ডিৎ অরবিন্দ সিং যাদের কৃপা হয়তো আমার সংগীত শিক্ষার অনুপ্রেরণা ।
দৈনিক সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরাতে সংগীত নিয়ে কাজ করতে কেমন লাগছে ?
ভালোলাগা খারাপ লাগা উভয় ধরনের মিশ্র অভিঙ্গতা হচ্ছে । সকলে শেখার থেকে গাইতে বেশি ভালোবাসে । তার পরো অনেকে এই জাগা থেকে বেরিয়ে এসে শিখতে চাই । কিছু মানুষের সহযোগিতায় চেষ্টা করছি সপ্ত সুরের সাথে শিক্ষার্থীকে পরিচিত করাতে ।
দৈনিক সাতক্ষীরা : নতুনদের জন্য কিছু বলুন ?
উত্তর : সংগীত হলো সপ্ত সুরের সাধনা । এটা আসলে দুই একদিনের বা দুই এক বছরের শেখার বিষয় নয় । চাই ইচ্ছা ও পরিশ্রম ।দুই দিনের শিক্ষায় যে সংগীত অর্জন হয় তা অপসংস্কৃতি ছাড়া কিছুই না । সার্কাসের চোখ ধাঁধানো আলো বা বাহিক্য চাকচিক্য মানুষকে ধোঁকা দেয়, আমরা জেনো এমন ধোঁকা না খাই। অভিভাবক অবশ্যই সঠিক শিক্ষকের কাছে সন্তান পাঠাবে । সংগীতের প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা থাকলে তো সাফল্য আসবেই ।
দৈনিক সাতক্ষীরা : গান শেখাতে কেমন লাগে ?
অবশ্যই ভালোলাগে তবে তৃষ্ণার্ত মানুষ কে জল পান করাতে যেমন আনন্দ লাগে, শিক্ষার্থী শেখার আগ্রহ নিয়ে আসলে তেমনি ভালোলাগে । তবে শিক্ষার্থীদের মাঝে শেখার আগ্রহ তৈরিতে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম করছি ।
দৈনিক সাতক্ষীরা : পেশা হিসেবে সংগীত কে নেওয়ার সুযোগ আছে কিনা ?
উত্তর : প্রাচীন কাল থেকে মানুষ সংগীত কে পেশা হিসেবে নিয়েছে । বর্তমান আধুনিক আকাশ সংস্কারের যুগে সেটা আরো সহজ হয়ে দাঁড়িয়েছে । তবে আমরা সংগীতকে সব সময় সহায়ক শিক্ষা হিসেবে নিয়ে থাকি । যদি সংগীতকে পেশা হিসেবে নিতে চাই তবে আমাদের শেখার যায়গাটাও তেমন মৌলিক ও শক্তিশালী করতে হবে ।
দৈনিক সাতক্ষীরা : সংগীত নিয়ে ভবিষ্যৎ কি পরিকল্পনা করছেন ?
উত্তর : আমার সোনার বাংলাতে অনেক সোনা এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে । আমি যেহেতু সাতক্ষীরাতে আছি ,সাতক্ষীরার প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই সোনা গুলো খুঁজে বের করতে চাই । একটু মাজা ঘসার পর দেখবেন এগুলো কেমন চক চক করছে । তাদের জন্য আমার ঘরে একটি স্টুডিও করে তুলচ্ছি । এখন সকলের আশীর্বাদ চায় ।
দৈনিক সাতক্ষীরা : সংগীত শেখার কনো বয়স আছে কিনা ?
উত্তর : না , শেখার কনো বয়স নাই । চাই শুধু ইচ্ছা আর পরিশ্রম । তবে ৪০ এর পরে পরিশ্রমের পরিমাণটা একটু বেশি হয় ।
দৈনিক সাতক্ষীরা : সংগীত নিয়ে আপনার মতো করে কিছু বলুন ?
উত্তর : প্রযুক্তির এই যুগে আমরা সহজে নানা অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ি । আমাদের খাদ্য বস্ত্রেরের মতো চাই বিনোদন । তার জন্য খেলাধুলার পাশাপাশি সুষ্ঠু সঠিক সাংস্কৃতিক চর্চার রয়েছে সীমাহীন প্রয়োজন। এক জন সংস্কৃতি মনা মানুষ কখনো অপরাধের সাথে যুক্ত হয়না । অভিভাবক সহ সকলকে আমাদের এর জন্য গণ-জাগরণ সৃষ্টি করতে হবে । সংস্কৃতি বাঁচলে দেশ বাঁচবে । দূর হবে সকল অপশক্তি ।