নৃশংস মৃত্যুদণ্ড পদ্ধতি…
মানবাধিকার সংস্থাগুলো মৃত্যুদণ্ড তুলে দেয়ার জন্য আওয়াজ তুললেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে ক্যাপিটাল পানিশমেন্টে বা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। পাশ্চাত্য দেশগুলো থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এমনকি বাংলাদেশেও বিভিন্ন অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।
পৃথিবীতে প্রথম সাংবিধানিক মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ১৮’শ শতাব্দীর দিকে। ব্যাবিলনের রাজা ২৫ টি অপরাধের জন্য শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড নির্ধারণ করেছন। তবে ধারণা করা হয়, এর আগে ১৪’শ ও ১৭’শ শতাব্দীর দিকেই সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হতো নানা কায়দায়। কখনো ক্রুশবিদ্ধ করে কখনো আঘাত করে এমনকি জীবন্ত পুড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হত। ১০ খ্রিষ্টাব্দের সময় থেকে ব্রিটেনে প্রথম ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর শুরু হয়। কিন্তু একই শতাব্দীতে রাজা উইলিয়াম এভাবে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার বিরোধিতা করেন। পরবর্তীতে এই আইন বেশিদিন টিকিয়ে রাখা যায়নি। পরবর্তীতে হেনরি দ্য এইট রাজা হলে পুনরায় এই পদ্ধতি চালু করা হয়। এবং সেই শতাব্দীতেই ৭২ হাজার মানুষকে বিভিন্ন অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। ব্রিটেন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আমেরিকা এবং পরবর্তীতে ইউরোপের দেশগুলোও একই উপায়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে।
তবে শুরুর দিকে ব্রিটেনে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার পদ্ধতি ছিল একটু ভিন্ন। ঘরের ভেতর গ্যাস সিলিন্ডার খুলে দিয়ে, ইলেকট্রিক শক দিয়ে এমনকি বিষাক্ত ইনজেকশন দিয়েও কার্যকর করা হতো মৃত্যুদণ্ড। পরবর্তীতে অনেক মতবিরোধের পর যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আইন পাশ করানো হয়। আর এভাবেই একই কায়দায় ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশগুলো মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে আসছে। তবে প্রাচীনকালের চিত্র ছিল ভিন্ন, ইতিহাসে এমন কিছু মৃত্যুদণ্ডের পদ্ধতির উল্লেখ আছে যেগুলোর কথা শুনলে গা শিউরে ওঠে –
বয়েলিং পদ্ধতি:
ফুটন্ত গরম পানিতে মৃত্যুদন্ড দেয়ার পদ্ধতি যে একটি ভয়ঙ্কর রূপ ছিল এতে কোনো সন্দেহ নেই। এটি সমগ্র এশিয়াতেই প্রচলিত ছিল তবে ইতিহাস দেখলে ইউরোপ এবং ইংল্যান্ডেও এর প্রয়োগ পাওয়া যায়। ১৩তম শতাব্দীতে, অর্কনির “ব্লাডি ইয়ার্ল” নামে পরিচিত জন হারাল্ডসন দু’জন ভিক্ষুককে গরম পানিতে পুড়িয়ে হত্যা করেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। তাদের দোষ ছিলো, গরিব কৃষকদের জমানো অর্থ জোরপূর্বক কেড়ে নেয়। এটি ছিল মৃত্যুদন্ডের এমন একটি পদ্ধতি যা মধ্যযুগে প্রতারক ও জালিয়াতিকারীদের জন্য ব্যবহৃত হত এবং রোমান সাম্রাজ্যে জাল মুদ্রা সরবরাহকারী ও অত্যন্ত হিংস্র খুনীদের জন্য শাস্তি ছিল যে তাদের গরম তেলে পুড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হত। এর একটি উদাহরণ হচ্ছে ১৩৯২ সালে নুরেমবার্গে এক ব্যক্তিকে তার মাকে ধর্ষণ ও হত্যার জন্য এ মৃত্যুবরণ দেয়া হয়।
এ পদ্ধতি বেশ ভয়ঙ্কর হলেও এর প্রয়োগ ছিলো সহজ। অপরাধীকে একটি বদ্ধ কলড্রন বা কেটলির মধ্যে স্থাপন করা হয় এবং তা উষ্ণ তরল পদার্থ দ্বারা পূর্ণ করে ফেলা হয়। আর এই তরল পদার্থ তেল, পানি, গলানো চর্বি এমনকি আলকাতরাও হতে পারে। একটি হুক থাকত যা ব্যবহার করে দন্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে বের করে নিয়ে আসা হত। ১৫৩১ সালে ইংল্যান্ডে রাষ্ট্রদ্রোহের কারণে রিচার্ড রুজকে ব্যবহার করা হয় এই মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার জন্য। রিচার্ড এক বিশপকে মারার জন্য এক অনুষ্ঠানের খাবারে বিষ মিশিয়ে দেন। এতে দুই জন অতিথি মারা গেলেও বেঁচে যান বিশপ। এ মৃত্যুদণ্ডের ব্যাপারে এক প্রত্যক্ষদর্শী মন্তব্য করেন:“তার তীক্ষ্ণ চিৎকারে চারদিক ভারী হয়ে উঠেছিল। মহিলারা এবং কম বয়সী ছেলে মেয়েরা অসুস্থবোধ করতে থাকে এ দৃশ্য দেখে। এমনকি অনেকে অজ্ঞান হয়ে যান। রিচার্ড যখন অর্ধমৃত অবস্থায় তখনই তারা সেস্থান ত্যাগ করেন। তবে বেশিরভাগ প্রত্যক্ষদর্শীই ভয় পাননি”।
দ্য ব্লাড ঈগল:
এ পদ্ধতি প্রাচীন নর্স যোদ্ধাদের চিহ্নিত করে তাদের উপর প্রয়োগ করার একটি কৌশল। রক্তের ঈগল পদ্ধতি এমন এক বর্বরতা এবং কাব্যিক চিত্রাবলী মিশ্রিত করে যা কেবল ভাইকিংদের পক্ষেই সম্ভব ছিল। এতে প্রথমত, অপরাধীর পিঠের মাঝে চামড়া কেটে ফেলা হত যেন স্পাইনাল কর্ড দেখা যায়।
এরপর পাঁজর মেরুদণ্ড থেকে স্খলিত করা হবে এবং জোরপূর্বক পিঠের উল্টদিকে পাঁজরের হাড়গুলো বের করে নিয়ে আসা হয় যাতে তা দেখতে ঈগলের পাখার মত দেখায়। এ অবস্থায় তাকে বাধ্য করা হত বাঁকা হওয়ার জন্য যার ফলে শরীরের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসত ফুসফুস। এরপর শরীরের সেই গহ্বরের মধ্যে ছিটিয়ে দেয়া হত লবণ। ফলাফল স্বরূপ এক ভয়ঙ্কর মৃত্যু ঘটতো অপরাধীর। তবে যখন পিঠের ত্বক কেটে ফেলা হত বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তখনই মৃত্যু ঘটতো অপরাধীর।
বিদ্ধ করে:
১৫তম শতাব্দীর ওয়ালাচিয়া (বর্তমানে রোমানিয়া) এবং কাউন্ট ড্রাকুলা থেকে অনুপ্রেরিত হয়ে ভ্লাদ দ্য ইম্পালার পদ্ধতিটি সর্বাধিক ব্যবহার করা হয়, এ পদ্ধতি চালুর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। এ পদ্ধতিতে মৃত্যদন্ড দেয়া ছবিগুলো দেখে মনে হতে পারে যে এটি হয়তো অন্যান্যগুলোর থেকে কম কষ্টজনক কিন্তু বাস্তবে এটি অত্যন্ত দীর্ঘ সময়ব্যাপী প্রক্রিয়া। ঐতিহ্যগতভাবে, ধারালো দণ্ডটি লম্বাভাবে মাটিতে স্থাপন করা থাকে। তারপর অপরাধীকে সরাসরি দণ্ড বরাবর বসিয়ে দেয়া হয় যা তার শরীর কে দুই ভাগ করে রেক্টাম বা ভ্যাজিনা দিয়ে প্রবেশ করে। শরীরের ভারের কারণে দণ্ডটি ক্রমেই তাদের শরীরের মধ্য দিয়ে ডেবে যেতে থাকে। ক্রমেই শরীরকে মেরুতে আরো টেনে নিয়ে যায়, আধা গ্রিজযুক্ত কাঠের অংশটি তাদের শরীরের মধ্য দিয়ে জোর করে একেকটি অঙ্গকে ছিদ্র করে নিজের পথ করে নেয় যন্ত্রনাদায়ক ধীরগতির সঙ্গে। এক পর্যায়ে দণ্ডটির অপর মাথা বেরিয়ে আসে ঘাড়, গলা বা কণ্ঠনালী ভেদ করে।
১৭৭২ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের দিকে নির্যাতনের এই ধারা শুরু হয়। ব্যাবিলনে রাজা হাম্মুরবী এইভাবে একজন নারীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার আদেশ দেন তার স্বামীকে হত্যার জন্য। কিন্তু ১৯২১ থেকে ১৯২৩ সালের আর্মেনিয়ান গণহত্যার সময় অটোমান সরকার কৌশলটি কাজে লাগিয়ে ২০ শতকের হিসাবে সম্প্রতি এটি ব্যবহার অব্যাহত রাখে।
ইঁদুর দিয়ে:
মনে হতেই পারে শুধুমাত্র ইঁদুর দিয়ে কিভাবে কারো মৃত্যু হতে পারে? এটি মূলত মধ্যযুগীয় চীনে ব্যবহৃত হত্যার নির্মম এবং মারাত্মক পদ্ধতি। “এখন পর্যন্ত আরোপিত সবচেয়ে নিষ্ঠুর যন্ত্রণা কৌশল” হিসাবে উল্লেখিত এটি। এতে জীবন্ত ইঁদুর দিয়ে অপরাধীর মাংস খাওয়ানো হয়। শুরুতে, কয়েকটি ইঁদুর ভর্তি মাটির বাথট্যাবের মত বড় পাত্রে অপরাধীকে নগ্ন অবস্থায় রাখা হয়। তারপর সে পাত্রে লাল গরম কাঠ কয়লা প্রচুর পরিমাণে দিয়ে দেয়া হয় যার ফলে ইঁদুর গুলো ছ্যাকা খেয়ে বন্দীর দেহে উঠে যায় এবং তাকে কামড়াতে শুরু করে। খুবই কম সংখ্যক মানুষ এই পদ্ধতিতে বেঁচে থাকে শেষ পর্যন্ত। এদের মধ্যে বেশিরভাগই অভ্যন্তরীণ রক্তপাত এবং গুরুতর সংক্রমিত ক্ষত থেকে সেপ্টিক শক এর কারণে মারা যান।