অ্যাসিরিয়ান সভ্যতা
চেঙ্গিস খানের দৌরাত্ম্য তখনো শুরু হয়নি, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে রোমানদের প্রভাবও যখন ছিল না, তারও আগে পৃথিবীতে ছিল এক বিশাল সাম্রাজ্য। বলছি, অ্যাসিরিয়ান রাজ্যের কথা। ঐতিহাসিকদের মতে, অ্যাসিরিয়ানরাই ইতিহাসে প্রথম প্রকৃত ‘সাম্রাজ্য’ গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছিল। পরবর্তীতে, পৃথিবীতে যত শক্তি সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে অ্যাসিরিয়ানরা ছিল তাদের পথিকৃৎ।
খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে, যখন আসিরিয়ান সাম্রাজ্য তার সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থা বিরাজ করছে; তখন তার বিস্তৃতি ছিল আধুনিক ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ইসরাইল, তুরস্কের অংশবিশেষ, ইরান ও মিশর জুড়ে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো এত প্রাচীন যুগে প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যেও নিদর্শন হিসেবে পাওয়া যায় সুবিশাল গ্রন্থাগার, উদ্ভিদ উদ্যান ও সাফারি পার্ক!
অ্যাসিরিয়ানদের ক্ষমতায় উত্থানের ইতিহাসটা কিন্তু আরো কয়েক শতাব্দী পুরনো। ব্রোঞ্জ যুগের শেষ ভাগে, অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব চতুর্দশ শতাব্দীতে উত্তর ইরাকের তাইগ্রিস নদীর তীরে আশুর নামক শহর ছিল। এটি ছিল মূলত টিন ও টেক্সটাইল শিল্পের বাণিজ্য কেন্দ্র, যাকে ঘিরেই অ্যাসিরিয়ান সভ্যতার উৎপত্তি। আশুর নামটি দেয়া হয়েছিল এক দেবতার নামে, যাকে কিনা শহরটির এবং পরে পুরো অ্যাসিরিয়ান সভ্যতার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ভাবা হতো। প্রশাসনিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে অ্যাসিরিয়ানরা রাজনীতি ও ধর্মের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করেছিল। খ্রিস্টপূর্ব ত্রয়োদশ শতাব্দীতে একজন উচ্চ সম্মানিত ধর্মযাজক, যার নাম ছিল ‘প্রথম আশুর উবালিত’, তিনি অ্যাসিরিয়ানদের সর্বপ্রথম রাজা হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। রাজা হয়েই তিনি অ্যাসিরিয়ায় একটি স্থায়ী সেনাবাহিনী তৈরি করলেন। এরফলেই অ্যাসিরিয়া একটি নগররাষ্ট্র থেকে সাম্রাজ্য হওয়ার পথে পা বাড়ালো।
সাম্রাজ্যে অবশ্যই রাজার নির্দেশই শিরোধার্য- এই প্রথম অ্যাসিরিয়ার সকল ধর্ম, মত, সংস্কৃতির মানুষরা এক শাসনকর্তার শাসনের অধীনে এলো। পরবর্তী দেড়শ বছর যাবত অ্যাসিরিয়া তার সাম্রাজ্যের বিস্তার ও সমৃদ্ধি বাড়াতে থাকলো। খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতাব্দীতে একটি রহস্যজনক প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যা এখনো নৃতাত্ত্বিকদের ধাঁধা লাগিয়ে দেয়; সেটি অ্যাসিরিয়ানদের সাম্রাজ্যের অনেক অঞ্চল ধ্বংস করে দেয়। তবে এর কয়েক শতাব্দী পর অ্যাসিরিয়ান রাজারা রাজ্য বিজয়ের নতুন মহোৎসব শুরু করেন। এবার তারা নিজেদের প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে সুবিশাল সাম্রাজ্য পরিচালনার উপযুক্ত করে তোলেন যা অ্যাসিরিয়ান সাম্রাজ্যকে বেশ কয়েক প্রজন্ম পর্যন্ত টিকিয়ে রাখে।
সেনাবাহিনীর ধারণায় অ্যাসিরিয়ানরা ব্যাপক সংস্কার আনে। রাজ্য বিজয়ের ক্ষেত্রে তারা ছিল নির্দয়। এ সময় তারা বিপুল লুটতরাজ করত। তাদের বিরোধিতা করলে নিষ্ঠুর শাস্তি ভোগ করতে হতো। বিরোধীদের তারা শূলবিদ্ধ করত ও গায়ের চামড়া ছিলে নিতো। তবে অ্যাসিরিয়ানদের অন্যতম একটি ভাল দিক ছিল। কোনো এলাকা জয় করার পর মূল সাম্রাজ্যের সঙ্গে ওই এলাকার সংযোগ সূত্র স্থাপন করার জন্য বেশ ভালো মানের রাস্তাঘাট তৈরি করত। অ্যাসিরিয়ান রাজাদের মধ্যে রাজধানী পরিবর্তন করার একটা প্রবণতা লক্ষণীয় ছিল। যখনই কোনো নতুন রাজা ক্ষমতায় আসতেন, তিনি নিজ ইচ্ছামতো রাজধানী সরিয়ে নিতেন। এর ফলে বিভিন্ন জায়গায় নতুন নতুন সুসজ্জিত সুবিশাল রাজপ্রাসাদ ও মন্দির নির্মিত হতো। যদিও অ্যাসিরিয়ান রাজাই ছিলেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, রাজার সভাসদরাও শাসনকার্যে গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিতে পারতেন। অ্যাসিরিয়ানদের মধ্যে নারীর ক্ষমতায়নও প্রতিষ্ঠিত ছিল। সামুরামাত নামের এক রানী বহুদিন যাবত অ্যাসিরিয়ান সাম্রাজ্য শাসন করতেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। অন্যান্য নারী শাসকদের পরিচয় পাওয়া যায়নি।
নতুন প্রতিষ্ঠিত প্রাসাদগুলোতে অ্যাসিরিয়ানরা তাদের পূর্ববর্তী বিজয় গাঁথা খোদাই করে অথবা চিত্র শিল্পের মাধ্যমে ধরে রাখতো। এসব দেয়ালচিত্র থেকে অ্যাসিরিয়ানদের রাজ্য বিজয় এর নেশা অনেক বেশি করে প্রতীয়মান হলেও অ্যাসিরিয়ান রাজারা ওই অঞ্চলের সংস্কৃতিরও খুব ভক্ত ছিলেন। বিশেষ করে পার্শ্ববর্তী রাজ্য ব্যাবিলনিয়ার কৃষ্টি-কর্মের গুণগ্রাহী ছিলেন তারা। ব্যাবিলনিয়ানরা সভ্যতার জন্মলগ্ন থেকেই শিল্প-সাহিত্যে পথপ্রদর্শক হিসেবে ভূমিকা রেখে এসেছে। তাদের হাত ধরেই লেখালেখির যাত্রা শুরু হয়। শিল্প ও সংস্কৃতির যে জয়যাত্রা ব্যাবিলন থেকে শুরু হয় অ্যাসিরিয়ানরা নিজেদেরকে সেগুলোর উত্তরাধিকারী এবং রক্ষাকারী মনে করত। চিকিৎসাবিজ্ঞান থেকে সঙ্গীত, যেকোনো বিষয়ের পান্ডিত্যধারী ব্যক্তিবর্গ অ্যাসিরিয়ান রাজার দরবারে বেশ সম্মান লাভ করতেন। রাজধানীতে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন এলাকা থেকে নিয়ে আসা উদ্ভিদ ও প্রাণীদের অভয়ারণ্য তৈরির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পার্ক প্রতিষ্ঠা করা হতো। তারা প্রাণীদেরকে খাঁচায় বন্দী করে চিড়িয়াখানা বানাতো না। সাফারি পার্কের মতো ব্যাপার ছিল অনেকটা।
আশূর্বানিপাল নামক অ্যাসিরিয়ান সভ্যতার শেষ দিককার একজন রাজা, তার শাসনকালে ব্যাবিলনের বিভিন্ন অঞ্চলে তার পক্ষ থেকে অনেক পণ্ডিতদের প্রেরণ করেন যাতে তারা ঘুরে ঘুরে সেখানকার প্রাচীন জ্ঞানের পান্ডুলিপি সংগ্রহ করতে পারে। মাটির গায়ে সেসব পাণ্ডুলিপি থেকে উদ্ধারকৃত অনুবাদ খোদাই করে আশূর্বানিপাল তৈরি করেন বিশাল এক গ্রন্থাগার। ৬১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নিনেভার শেষ যুদ্ধে সে লাইব্রেরী ধ্বংস করে দেয়া হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময় উনিশ শতকের এক প্রত্নতাত্ত্বিক উদ্ধার অভিযানে সেই লাইব্রেরীর অনেক সাহিত্যকর্ম উদ্ধার করা হয়। গিলগামেশ ও ব্যাবিলন মহাকাব্য দুটি এই উদ্ধার অভিযানেরই ফসল, যেগুলো আসিরিয়ানরা রচনা করেন আজ থেকে প্রায় তিন হাজার বছর আগে! শতাব্দীর পর শতাব্দী ব্যাবিলন ও মিডাসদের আক্রমণ প্রতিহত করতে করতে একসময় অ্যাসিরিয়ান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে (৬১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। তবে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম সার্থক সম্রাজ্য হিসাবে, নানা যুদ্ধ প্রকৌশল আবিষ্কার ও শিল্প সাহিত্যে অসাধারণ অবদানের জন্য অ্যাসিরিয়ানরা পৃথিবীর ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিয়েছে।