মাদকের হাট ”বিএফডিসিতে”
কালকে প্রকাশিত ‘বিএফডিসির এত অনিয়ম, দেখার কী কেউ নেই’ এমন শিরোনামের খবরে উঠে এসেছে নানা অনিয়মের কথা। তবে এই অনলাইন মাধ্যমটির নিজস্ব প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে বিএফডিসি নিয়ে আরো বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য।
অনুন্ধানের দ্বিতীয় পর্বের বিস্তারিত প্রতিবেদনবর্তমানে বিএফডিসির দিনের বেলার রূপ থাকে একরকম। গেটের বাইরে দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড়। শুটিং স্পট গুলোতে থাকে কর্মব্যস্ততা, তবে তা কাজের নয় আড্ডার। মাঝে মাঝে এক্সট্রারা (দ্বিতীয় শ্রেণীর নায়িকা) আসেন সে আড্ডায় সমবেত হতে।
তাছাড়া কাজের উদ্দেশে কখনো কখনো বিভিন্ন নেতারাও আসেন এই বিএফডিসিতে, মাঝে মাঝে দেখা মেলে অনেক সিনিয়র ও জুনিয়র আর্টিস্টদেরও। তবে কাজ না হলেও আড্ডাবাজি বেশ ভালোই জমেছে এই বিএফডিসিতে।
তবে অনেকদিনের অভিযোগ, এতো পুরান এবং নাম করা প্রতিষ্ঠান হওয়ার পরেও সেখানে নেই কোন নিরাপত্তাব্যবস্থা। বিশাল এই জায়গা পাহারা দেয়ার জন্যে নেই কোন উপযুক্ত নিরাপত্তাকর্মী।
অভিযোগকারীদের মতে, গেটে পাহারায় নিযুক্ত কর্মচারীদের কিছু টাকা ঘুষ দিলে যে কেউই অনায়াসে ভেতরে ঢুকে যেতে পারে। ফলে ভেতরের অবস্থানরত শিল্পীদের নিরাপত্তার কোন ঠিক নেই এবং সেটা দেখারও কেউই নেই। এই নিয়ে আগে বিভিন্ন গণমাধ্যমও অনেক খবর ছাপিয়েছে। তবে কোন সুরাহা মেলেনি। দিনের বেলার এফডিসির বাস্তব চিত্র এটি।
তবে রাতের বিএফডিসির সঙ্গে দিনের কোন মিল পাওয়া যায়নি ,এর রাতের রূপটা অনেক ভয়ানক ও নতুনদের জন্য রীতিমত বিপদজনকও বটে।
রাতে আঁধার নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গেই বদলাতে থাকে বিএফডিসির অভ্যন্তরীণ পরিবেশ। যার একপাশে রয়েছে তেঁজগাও রেলগেট এলাকা, অন্য পাশে বিভিন্ন গাড়ির গ্যারেজ।
ফলে ঢাকা শহরের অপরাধপ্রবণ জায়গাগুলোর মধ্যে এটির অবস্থান সবার ওপরে বলা চলে। মাদক থেকে শুরু করে দেহব্যবসা, সব ধরণেরই অপকর্ম হয় এই এলাকায়। এসব থেকে পিছিয়ে নেই এফডিসিও। রোজ রাতে বহিরাগত লোকজন এসে মাদকের আসর বসায় বলে অভিযোগও অনেকদিনের, এই নিয়ে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন ঘটনাও ঘটেছে বেশ কয়েকবার।
তাছাড়া, কিছুদিন আগে ‘এফডিসিতে প্রোডাকশন ম্যানেজারের মৃত্যু’ শিরোনামের একটি খবরও ছাপিয়েছে ডেইলি বাংলাদেশ। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএফডিসি) ভবন থেকে পড়ে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। নাম তার আবু সিদ্দিক। তিনি ছিলেন বিএফডিসির প্রোডাকশন ম্যানেজার।
পরে, নিহত ব্যক্তির স্ত্রী কাজল ও কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ওই রাতে সাড়ে ৮টার দিকে এফডিসির আট নম্বর ভবনের দ্বিতীয় তলা থেকে আবু সিদ্দিক পড়ে যান। তারা নাকি সেখানে সমবেত হয়ে মদ্যপান করছিলেন।
এফডিসির ৮ নম্বর ফ্লোরের বারান্দা
এই ধরণের আরো বহু অনাকাঙ্ক্ষিত কাহিনী এরইমধ্যে ঘটেছে এফডিসিতে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, এফডিসির কিছু উল্টোপাল্টা জায়গা, যেখানে মাদক কেনা-বেচা হয় হরদম। তার মধ্যে ভেতরের সুইমিংপুল, ঝরনা স্পট, ক্যানটিনের সামনের জায়গা, কড়ইতলা ও প্রশাসনিক ভবনের পেছনে মাদক সবচেয়ে বেশী কেনা-বেচা হয়।
এফডিসির বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য সিসি ক্যামেরা বসানো থাকলেও সব চোখ ফাঁকি দিয়ে ঘটেই চলছে এসব অপকর্ম। তাছাড়া এর আনাছে-কানাছে প্রকাশ্যে মাদক বিক্রির হাটও বসে বলে অভিযোগ আছে। যা নিরাপত্তাকর্মীরা দেখেও না দেখার মত করে থাকেন।
আবার এরকমও তথ্য বেরিয়ে এসেছে, মাদক বিক্রির টাকা থেকে একটা অংশ নিরাপত্তাকর্মীদের পকেটে যায়। বিফডিসিতে বর্তমানে মাদকের এতই ছড়াছড়ি যে, সেখানে আর গাঁজার কথা নাই বলি! প্রায় সব স্থানে এর গন্ধে টিকাই অসম্ভব মনে হয়।
এদিকে, মাদকের এমন ছড়াছড়িতে শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খানের কাছে জানতে চাওয়া হলে, তিনি এই ধরণের ঘটনার সঙ্গে অবগত নয় বলে জানান। তবে মাদকের সঙ্গে জড়িত কারো উপযুক্ত প্রমাণ মেললে এর জন্য যথাপোযুক্ত ব্যবস্থা নেবেন বলে আশ্বাস দেন।
তবে সাধারণ সম্পাদক বিষয়টি সম্পর্কে অবগত না থাকলেও চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির মহাসচিব বদিউল আলম কিছুটা জানেন। তিনি বলেন, মাদকসেবনই নয় বরং এর কিছু স্টোররুমে নিয়মিত জুয়া খেলা হয়। আমার ধারণা, এফডিসি কর্তৃপক্ষের কেউ কেউ এসবের সঙ্গে যুক্ত আছেন। তা না হলে তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তি হয় না কেন? এতদিন এসব বন্ধ হচ্ছে না কেন?
তাছাড়া চলচ্চিত্রের আরেক পরিচালক শাহ আলম কিরণ বলেন, সন্ধার পর থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটি পুরোপুরি অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে। ওই সময় এফডিসিতে গাঁজার গন্ধে টিকে থাকা মুশকিল। আমি নয় যে-কেউই চলার পথে এই গন্ধ পাবেন।
এদিকে বিএফডিসির বহু কর্তৃপক্ষ, চলচ্চিত্রের পরিচালক, প্রযোজক এবং অনেক সিনিয়র নায়ক-নায়িকাদের একাংশের ধারণা, কারওয়ান বাজার রেললাইন ঘেঁষে গড়ে ওঠা বস্তিতে যারা মাদকের ব্যবসা করছেন, তাদের সঙ্গে এখানের কেউ কেউ হয়ত জড়িত। তা নাহলে এত সহজেই এই ধরণের মাদকের হাট বসতো না!
তাদের অনেকেই আবার ক্যানটিনের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। প্রায় পাঁচ বছর ধরে এর পরিচালনা করছেন কবির হোসেন রাজীব। এ ব্যাপারে জানতে তাকে ফোন করা হলে তিনি অনেকটা চটে যান। বলেন, এই সব ফালতু কথা আপনাদের কে বলে? এসবের জন্য প্লিজ আমাকে ফোন করবেন না।
এদিকে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে ঢাকা মেট্রোর উপপরিচালক মুকুল জ্যোতি চাকমা মনে করেন, যেহেতু বিএফডিসি রেললাইন এলাকার পাশে, তাই এটাই অপরাধের জন্য নিরাপদ জায়গা মনে হতে পারে অনেকের। সরকারি স্থাপনা হওয়ায় সেদিকে কম দৃষ্টি থাকে প্রশাসনের। এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হবে।
তাছাড়া তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুর রশীদ বলেন, আমি এত দিন বিষয়টি সিরিয়াসলি জানতাম না। এখন জেনেছি। বিএফডিসির মতো জায়গায় এমন অপরাধের সঙ্গে যারাই যুক্ত থাকুক, আমরা তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হবো।
[বিএফডিসির এত অনিয়ম, দেখার কী কেউ নেই-এর পার্ট-৩ পড়তে চোখ রাখুন আগামী কালকের বিনোদন ক্যাটাগরি]