যেভাবে ক্ষমতার চূড়ায় হিটলার…

অ্যাডলফ হিটলার কে ছিলেন? ইতিহাসে অন্যতম নিপীড়ক? নাকি যুদ্ধ বিদ্ধস্ত একটি দেশ, ভেঙে পড়া অর্থনীতি এবং পতিত এক জাতিকে এক করতে সম্ভাব্য সবকিছু করতে পস্তুত এক মহান নেতা? সামান্য এক সেনা থেকে কিভাবে হিটলার একটি গণতান্ত্রিক দেশের শাসন ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছালেন?

হিটলারের অভ্যুত্থান গল্পের শুরু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে অর্থ্যাৎ১৯১৮ সালে। মিত্র বাহিনীর একের পর এক সফল অভিযান দেখে জার্মানি বুঝতে পারে, যুদ্ধে তাদের পক্ষে জেতা আর সম্ভব নয়। তারা এক যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করে। ইতি ঘটে নারকীয় এক যুদ্ধের। আর যুদ্ধের সঙ্গে বিদায় নেয় জার্মানির সাম্রাজ্যবাদী শাসনতন্ত্র। সারাদেশে সংক্রমণের মত ছড়িয়ে পড়ে নাগরিক অস্থিরতা ও শ্রমিক ধর্মঘট। রাজনীতিবিদদের মনে তখন একটাই সংখ্যা, তবে কি কমিউনিজম বিপ্লবের পথে হাঁটছে জার্মানি?

এই আশঙ্কা থেকে মুক্তি পেতে ও জন আক্রোশ থামাতে তখনকার প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক ভাইমার রিপাবলিক গঠন করলো। মিত্র বাহিনীর আরোপিত শান্তি চুক্তির বাস্তবায়ন ছিল নতুন গঠিত সেই সরকারের প্রধান দায়িত্ব। যার ফলে জার্মানি তার সাম্রাজ্যের এক দশমাংশেরও বেশি অঞ্চল হারিয়ে বসে। সুবিশাল জার্মান সেনাবাহিনী ভেঙে দেয়া হয়। মহাযুদ্ধের সকল দায়-দায়িত্ব জার্মানির উপর চাপিয়ে দেয়া হয়। ফলে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও ভগ্ন অবকাঠামো মেরামতের দায়িত্ব নিতে হয় তাদের। এই সবকিছু জার্মানির ইতোমধ্যেই দুর্বল হয়ে পড়া অর্থনীতিকে আরো বেশি হুমকির মুখে ফেলে দেয়। বহু জাতীয়তাবাদী এবং প্রবীণ নাগরিক এসবকে জার্মান জাতির জন্য চূড়ান্ত অপমান হিসেবে মনে করতে থাকেন। তাদের মনে একটা ভ্রান্ত ধারণা জন্মাতে থাকে যদি রাজনীতিবিদ ও বিপ্লবীদের দল বিশ্বাসঘাতকতা না করত, জার্মান বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ জয় করা অসম্ভব হতো না।

1.যেভাবে ক্ষমতার চূড়ায় হিটলার...

হিটলার নিজেও ছিলেন এই ধারণার বাহক। মনের দিক থেকে তিনি ছিলেন গোড়া জাতীয়তাবাদী। তাই জার্মানদের এই জাতিগত অপমানবোধ তাকেও মর্মপীড়া দিতে থাকে। জার্মানিতে তখন লক্ষাধিক ইহুদীর বাস। কিন্তু বহু জার্মান তাদেরকে বহিরাগত হিসাবে গণ্য করত। প্রথম মহাযুদ্ধের পর ইহুদিদের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে তারা তাদের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফলাফল বলে মনে করত। বহু জার্মানদের ধারণা ছিল (যা কিছুটা সত্যও), ইহুদিরা যুদ্ধকে পুঁজি করে ব্যবসা করেছে।

তিনি নাজি পার্টি নামক একটি ছোট্ট জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দলে যোগ দিলেন, তখন কেউ ভাবতেই পারেনি এই সামান্য দলটি জার্মানির রাজনীতিতে কোন প্রভাব ফেলতে পারে। কিন্তু হিটলারের বক্তৃতাগুলো এতই সম্মোহনী ক্ষমতা সম্পন্ন ও প্ররোচনামূলক ছিল যে কিছুদিনের মধ্যে শুধু তার জন্যই বহু জার্মান সমর্থন নাজি পার্টির দিকে চলে আসে। জাতীয় রাজনীতি নিয়ে জনগণের অসন্তোষের উপরে ইহুদি বিদ্বেষের বেশ কড়া প্রলেপ লাগিয়ে নাজিরা প্রোপাগান্ডা তৈরি করল। আন্তর্জাতিক ইহুদি ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে তারা পুঁজিবাদ ও সাম্যবাদ উভয়কেই সমানভাবে দোষারোপ করত। মহাযুদ্ধের ধ্বংস ভূমিতে ধীরে ধীরে উপ্ত হচ্ছিল নাজিবাদের বীজ।

কিন্তু নাজি পার্টি প্রাথমিক সফলতা অর্জনে ব্যর্থ হয়। সরকার উৎখাতের চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ায় তাদেরকে জার্মানিতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। দেশদ্রোহিতার অভিযোগ এনে হিটলারকে দেয়া হয় কারাদণ্ড। কিন্তু বছর খানেক পর ছাড়া পাওয়ার পর তিনি তার আন্দোলনকে পুনর্গঠন করার কাজে লেগে যান। তারপর এলো সেই ১৯২৯ সাল, শুরু হলো দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন। আমেরিকান ব্যাংকগুলো জার্মানি থেকে তাদের লোন উঠিয়ে নেয়ায় ধুঁকতে থাকা জার্মান অর্থনীতি যেন এক রাতের মধ্যেই ধসে পড়ল। হিটলার এই সময় তৈরি হওয়া জনও আক্রোশের সুযোগটি বেশ ভালোভাবেই নিলেন। তিনি মানুষকে এই চরম দুরবস্থা থেকে মুক্তির স্বপ্ন দেখাতে লাগলেন।

2.যেভাবে ক্ষমতার চূড়ায় হিটলার...

জার্মানদের অতীত গৌরব ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিলেন, যেখানে মূল ধারার দলগুলো অবস্থা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিল। আর বামপন্থী বিরোধী দলগুলো অভ্যন্তরীণ কলহের জন্য বিভক্ত হয়ে পড়ে। এর ফলে সাধারণ মানুষ ভরসার আশায় ক্রমাগত নাজিদের দিকে ঝুঁকতে থাকেন। দুই বছরের মাথায় তাদের সংসদীয় ভোটের হার ৩ শতাংশ থেকে ১৮ শতাংশে উন্নীত হয়। ১৯৩২ সালে হিটলার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেন, কিন্ত হিন্ডেনবার্গ এর কাছে পরাজিত হন।

কিন্তু ওই নির্বাচনে তার প্রাপ্ত ৩৬ শতাংশ ভোট তার জনপ্রিয়তার অগ্রগতিকে নির্দেশ করে। অপরদিকে হিন্ডেনবার্গের উপদেষ্টা মন্ডলী ও পৃষ্ঠপোষক ব্যবসায়ীরা হিটলারকে তার চ্যান্সেলর নিযুক্ত করার পরামর্শ দেন। হিটলারের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। যদিও চ্যান্সেলর শুধু ছিলেন সংসদের প্রশাসনিক প্রধান, হিটলার চ্যান্সেলর হওয়ার পর ধীরে ধীরে তার পদের ক্ষমতা বাড়াতে কাজ করেন। বিদ্রোহীদের দমনের জন্য তার সমর্থকরা প্যারা মিলিটারি গ্রুপ তৈরি করে। হিটলার জনগণের মধ্যে আশঙ্কা সৃষ্টি করেন, যেকোনো সময় কমিউনিস্ট অভ্যুত্থান ঘটতে পারে।

3.যেভাবে ক্ষমতার চূড়ায় হিটলার...

জনগণের মধ্যে বিশ্বাস সৃষ্টির চেষ্টা করেন, একমাত্র তিনি দেশের আইনকানুন আবার পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য উপযুক্ত। ১৯৩৩ সালে উত্তেজিত এক যুবক পার্লামেন্টারি বিল্ডিং এ আগুন ধরিয়ে দেয়। হিটলার এ ঘটনায় সুযোগ নিতে ছাড়েননি। চলমান অস্থিরতায় জরুরি ভিত্তিতে তার হাতে ক্ষমতা প্রদানের জন্য তিনি সরকারকে প্ররোচিত করেন। ক্ষমতা পাওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে তিনি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কেড়ে নেন। রাজনৈতিক দলগুলো ভেঙ্গে দেয়া হয় এবং ইহুদি বিদ্বেষী আইন সংসদে পাস করা হয়। ১৯৩৪ সালের আগস্টে প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গের মৃত্যুর পর সবাই বুঝতে পারেন, নতুন কোনো নির্বাচন হচ্ছে না।

4.যেভাবে ক্ষমতার চূড়ায় হিটলার...

হিটলারের আগুন ধরানো সম্মোহনী বক্তৃতায় ছিল তার প্রধান শক্তি। শক্তিশালী আশ্বাসে আশ্বস্ত হয় জার্মানির সাধারণ মানুষজন তাকে ও নাজি পার্টিকে সর্বাঙ্গে সমর্থন দেয়। ব্যবসায়ীদের দলসহ অন্যান্য পৃষ্ঠপোষকরাও জনসমর্থন যেদিকে সেদিকেই থাকাকে নিরাপদ মনে করে। একটি যুদ্ধাহত ও অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু দেশের জনগণকে আশার বাণী শুনিয়ে ও স্বপ্ন দেখিয়ে হিটলার তার জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার পথ পরিষ্কার করে ফেলেন।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)