শৃঙ্খলিত প্রমিথিউস

গ্রিক পুরাণে প্রমিথিউস একটি তাৎপর্যবাহী চরিত্র। জেনে নিন পৌরাণিক কাহিনীর বিখ্যাত ও জনপ্রিয় সেই প্রমিথিউসের চিত্তাকর্ষক গল্প-

মানবজাতি সৃষ্টির পূর্বের কথা। গ্রিক দেবতারা টাইটান নামক দৈত্যদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। যুদ্ধে জয় লাভ করলেন দেবতারা। অনেক টাইটানকে নিশ্চিহ্ন করা হলো, কিছুর জায়গা হলো টারটারাস নরকের চিরন্তন অগ্নিকুণ্ডের ভেতরে। টাইটানদের একজন ছিলেন প্রমিথিউস। যার নামের অর্থ-‘দূরদর্শী’। টাইটান হয়েও প্রমিথিউস দেবতাদের পক্ষে লড়ার সিদ্ধান্ত নেন। এমনকি তার ভাই এপিমিথিউসকেও দেবতাদের পক্ষে যুদ্ধে করতে প্ররোচিত করেন। তাদের আনুগত্যে খুশি হয়ে দেবতাদের রাজা জিউস দুই ভাইকে পুরস্কার দিলেন। প্রমিথিউস ও এপিমিথিইউসের হাতে পৃথিবীর সব প্রাণী সৃষ্টির দায়িত্ব দেয়া হলো।

1.শৃঙ্খলিত প্রমিথিউস

এপিমিথিউসের দায়িত্ব ছিলো সকল প্রাণীকে দেবতাদের আশীর্বাদ স্বরূপ দেয়া ক্ষমতা সরবরাহ করা। এপিমিথিউস পাখিদের দিলেন ওড়ার ক্ষমতা, মাছদের দিলেন পানিতে ভেসে থাকার ক্ষমতা, পশুদের দিলেন কোমল পশমে ঢাকা চকচকে দেহ ও ধারালো থাবা। এপিমিথিউস যখন এসব কাজে ব্যস্ত, তখন প্রমিথিউস মাটি দিয়ে মানুষের অবয়ব নির্মাণ করে যাচ্ছিলেন। প্রমিথিউস মানুষকে তৈরি করলেন দেবতাদের আকৃতিতে। এসব দেখে জিউস রায় দিলেন, এই নতুন সৃষ্ট মানুষ নামের প্রাণীরাও অন্য নশ্বর প্রাণীদের মতো পৃথিবীতে অবস্থান করবে এবং সেখানে থেকে অলিম্পাস পর্বতের দেবতাদের উপাসনা করবে। জিউস চাইতেন, মানুষ বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির কাছে অসহায় থাকবে এবং এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য দেবতাদের উপাসনা করবে।

কিন্তু প্রমিথিউসের উদ্দেশ্য ছিলো আরো মহান। দেবতা জিউস সে সময় একটি নতুন নিয়ম চালু করেন। মানুষ ব্যতীত অন্য যে কোনো একটি প্রাণীকে দেবতাদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করতে হবে এবং উৎসর্গের পর যে অংশটুকু অবশিষ্ট থাকবে, সেটুকু মানুষকে দেয়া হবে পুরস্কার স্বরূপ। এখানে প্রমিথিউস একটি চাল চাললেন। তিনি একটি গরুকে হত্যা করে তার মাংস ও চামড়া এক পাত্রে রাখলেন ও হাড়গুলো অন্য পাত্রে রাখলেন। তারপর মাংসের পাত্রের উপরের অংশ নাড়িভুঁড়ি দিয়ে এবং হাড়ের পাত্রের উপরের অংশ চর্বি দিয়ে ঢেকে দেয়া হলো। সুতরাং, আপাতদৃষ্টিতে হাড়গোড়ের পাত্রকেই বেশ আকর্ষণীয় ও মাংসের পাত্রকে আবর্জনাপূর্ণ মনে হতে লাগলো। প্রমিথিউস যখন জিউসকে আহ্বান করলেন যে কোনো একটি বেছে নেয়ার জন্য, জিউস তখন চর্বি দ্বারা আবৃত পাত্রটি বেছে নিলেন এবং ধোঁকা খেলেন।

2.শৃঙ্খলিত প্রমিথিউস

প্রমিথিউসের এ প্রতারণায় দেবতা জিউস বেশ অপমানিত বোধ করলেন। ক্রুদ্ধ হয়ে মাংস রান্না করা বা অন্য কোনো কাজ যাতে মানুষ না করতে পারে সে কারণে তিনি পৃথিবীতে আগুনের ব্যবহার বন্ধ করে দিলেন। কিন্তু প্রমিথিউস তাঁর সৃষ্টির ওপর এ জুলুম সহ্য করতে পারলেন না। তাই তিনি অলিম্পাস পাহাড়ের চূড়ায় উঠে হেফেস্টাস ও এথেনার কারখানা থেকে আগুন চুরি করে আনলেন। তিনি একটি ফাঁপা মৌরির খোলকের মধ্যে আগুনের শিখাকে লুকিয়ে নিয়ে নিরাপদে লোকালয়ের মানুষের কাছে চলে এলেন এবং তাদেরকে আগুন সরবরাহ করলেন। এই আগুন মানুষকে দিলো শক্তি। আগুন পাওয়ার পর মানুষ নিজেদের জন্য খাদ্য প্রস্তুত করা শিখলো, প্রচণ্ড শীতে নিজেদের উষ্ণ করার উপায় খুঁজে পেলো। আবার আগুনের সাহায্যে বিভিন্ন রকম ধাতু দিয়ে তৈরি করল নানা অস্ত্রশস্ত্র। প্রমিথিউসের আগুন পেয়ে মানব সভ্যতার খুব দ্রুত বিকাশ ঘটল।

জিউস অলিম্পাস পর্বত থেকে মানুষের এ অগ্রযাত্রা প্রত্যক্ষ করলেন। তাঁর আর বুঝতে বাকি রইলো না এসবের পেছনে কার হাত রয়েছে! আরেকবার দেবতাদের ধোঁকা দেয়ার দায়ে অভিযুক্ত হলেন প্রমিথিউস। প্রচণ্ড ক্রোধের বশে জিউস প্রমিথিউসকে দিলেন ভয়ানক এক শাস্তি। প্রমিথিউসকে এক খাঁড়া পর্বতগাত্রে অনন্তকালের জন্য শৃঙ্খলিত করে রাখার নির্দেশ দেয়া হলো। প্রতিদিন সকালে শেকলবদ্ধ প্রমিথিউসের কাছে একটি শকুন আসত। শকুনটি প্রমিথিউসের কলিজা ঠুকরে ঠুকরে খেতো সারাদিন। রাতে আবার প্রমিথিউসের শরীরে নতুন কলিজা প্রতিস্থাপন করা হতো, পরের দিন শকুনটি যাতে আবার এসে খেতে পারে। চিরদিনের জন্য নিদারুণ যন্ত্রণা ভোগ করলেও প্রমিথিউস কখনো তাঁর কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা বা অনুশোচনা করেন নি। প্রবল যন্ত্রণার মাঝেও তাঁর এ অনন্য ধৈর্যশক্তি তাকে পৌরাণিক কল্পকাহিনীর অন্যতম জনপ্রিয় এক চরিত্রে পরিণত করে।

3.শৃঙ্খলিত প্রমিথিউস

নিজেকে উৎসর্গ করে মানুষকে প্রমিথিউস যে জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও ক্ষমতা দান করেছেন তা নিছক গল্প হলেও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। চিত্রকলা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রেও প্রমিথিউসের উপমা ও তাঁর মাহাত্ম্য বহু শিল্পী তাদের শিল্পের উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেছেন। বিখ্যাত ইংরেজ কবি শেলী প্রমিথিউসের গল্প থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ‘মুক্ত প্রমিথিউস’ নামে একটি গীতিনাট্য লিখেন। সেখানে তিনি প্রমিথিউসকে একজন রোমান্টিক নায়ক হিসেবে কল্পনা করেন। যে শৃঙ্খল ভেঙ্গে মানুষের মাঝে আবার মুক্তির বার্তা নিয়ে আসে। তিনি প্রমিথিউস সম্পর্কে বলেন, “মানবিকতা ও আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে প্রমিথিউস হচ্ছে সবচেয়ে নিখুঁত একটি দৃষ্টান্ত।” প্রমিথিউসের গল্প আমাদের শিক্ষা দেয় কিভাবে এক ব্যক্তিবিশেষের সৎ অভিপ্রায় ও ত্যাগ পুরো মানবজাতির কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসতে পারে।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)