চে এবং ই তিহাসের ব্যবচ্ছেদ
পৃথিবী জুড়ে তার পরিচিতি। তরুণ চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও এখন বিপ্লবের প্রতীক। কিন্তু আসলেই কি তিনি বিপ্লবের মহানায়ক? না-কি ছিলেন আগ্রাসী সেনানায়ক; যিনি তার দমননীতির জন্য পশ্চিমা সরকারদের কাছে নিন্দিত? হ্যাঁ, চে গুয়েভারা’র কথায় বলছি। তার পুরো নাম চে গেভারা দে লা সেরনা, জন্মসূত্রে আর্জেন্টাইন নাগরিক তিনি। যুবক বয়সে বিলাসী মেডিকেল জীবন থেকে এক বছরের বিরতি নিয়ে বন্ধু আলবার্তো গ্রানাডোকে সঙ্গী করে বেরিয়ে পড়েন লাতিন আমেরিকা ভ্রমণে। উদ্দেশ্য পেরুর সান পেবলোর লেপার কলোনিতে কুষ্ঠ রোগীদের সেবাদান। কিন্তু চে একে একে চিলি, ইকুয়েডর, কলম্বিয়া, ভেনিজুয়ে্লা, পানামা হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামিতে ভ্রমণ শেষ করেন। এই সূদীর্ঘ ভ্রমণই তার জীবন পুরোপুরি বদলে দেয়।
চে গুয়েভারা লাতিন আমেরিকার মানুষের দূর্দশা দেখে অনুধাবন করেন জীবন রক্ষার জন্য চিকিৎসার চেয়ে অনেক বেশি কিছু দরকার। এ কারণেই কি তিনি বিপ্লবী জীবন বেছে নেন? নাকি তিনি পুজিবাদি পশ্চিমাদের মতবাদ এর মত একজন সঙ্গী ছিলেন যিনি কি-না লাতিন দেশগুলোর সরকার পতনের কারণ হয়েছিলেন? তখনকার লাতিন সরকাররা পুঁজিবাদীদের দোঁসর ছিলো। কলোনিয়াল শাসন এর অবসান ঘটলেও বিত্তশালীরাই সকল সম্পদ ও সুযোগ-সুবিধার অধিকারি ছিলো। মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয়দের ভূমি দখল করে লাভের জন্য ব্যবহার করত। মানুষ না খেয়ে থাকলেও এই প্রতিষ্ঠানগুলো আবাদী জমিতে ফসল ফলাতে দিত না।
অবস্থার উন্নতিতে বিপুল জনভোটে ১৯৫৩ সালে গুয়েতেমালার প্রেসিডেন্ট হন এলবাঞ্জ। চে তখন গুয়েতেমালায়। পরিস্থিতি অবসানের চেষ্টায় এলবাঞ্জ সাধারণ জনতার মধ্যে ভূমি ও সম্পদ বন্টনের চেষ্টা করেন। কিন্তু সিআইএ এর মদদপুষ্ট সামরিক অভ্যুত্থানে তার পতন হয়। যা কি-না পশ্চিমাদের কাছে ছিলো সমাজতন্ত্র এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ। কিন্তু চে বুঝতে পারে এটা ছিল মার্কির ব্যবসা রক্ষার পন্থা এবং তারা কমিউনিজম ধংসের নামে যে কোনো দেশ এর সঙ্গে এই কাজ করতে পারে।
চে গুয়েতেমালার অভিজ্ঞতা নিয়ে মেক্সিকো সিটিতে যান। সেখানে শুরু হয় চে এর জীবনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। পরিচয় হয় কিউবান পলাতক বিপ্লবী ফিডেল কাস্ট্রোর সঙ্গে। তারা একত্রে কিউবাকে স্বাধীন করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু কিউবা কি স্বাধীন ছিল না? নাকি এটা আরেকটি স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র ছিলো? কিউবার তখনকার শাসক সামরিক স্বৈরাচারী বাতিস্তা। খোঁদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডিও স্বৈরাচার বাতিস্তার নিন্দা জানান। কিন্তু চে এর সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত কাস্ত্রো সরকারও কি স্বৈরাচারী ছিল না? কাস্ট্রোর সময়ও লেবারক্যাম্প, গণহত্যা চলেছে। জনগণের বাক স্বাধীনতাও ছিলো না। চে নিজেও কি এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন? পশ্চিমাদের মতে কাস্ত্রোর শাসন না মানা হাজার হাজার কিউবানকে হত্যা করেন চে। কিন্তু একই সঙ্গে কিউবার প্রত্যন্ত এলাকায় স্কুল, চার্চ, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। এমনকি তিনি বাচ্চাদের কবিতার বই উপহার দিতেন এবং কবিতা আবৃত্তিও করে শুনাতেন। কারো কারো মতে চে এর দমননীতি এর প্রয়োজন ছিল তার আগ্রাসী শত্রুদের জন্য যারা কিনা শত শত গ্রামে আগুন জ্বালিয়ে দিতেও দ্বিধা বোধ করেনি। কিন্তু আসলেই কি চে কিউবার জনগনকে মুক্তি দিচ্ছিলেন? তাহলে কেন এত হত্যা, গ্রেফতার, লেবার ক্যাম্প এবং কেনই বা এত মানুষ কিউবা ত্যাগ করছিল?
চে এর জীবনের অারেকটি অধ্যায় শুরু হয় কিউবার অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার পর। এই সময়ে কিউবার মানুষ হারানো ভূমি ফিরে পায়, চাষাবাদের উন্নতি হয় এবং একই সঙ্গে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর হার ৯৬ শতাংশ হয় যা কি-না আজও পৃথিবী জুড়ে আলোচিত। কিন্তু একই সঙ্গে কিউবার শিল্প উৎপাদন কমে যায়। চে শ্রমিকদের টাকার বদলে চরিত্র পত্র দিতে থাকেন এবং কিউবা থেকে সকল সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করেন। একই সঙ্গে তিনি কাস্ট্রোকে সোভিয়েত ক্ষেপনাস্ত্র রাখার জন্য উপদেশ দেন যা কি-না প্রায় আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ ডেকে এনেছিল। পরবর্তীতে এজন্যই হয়তো চে কিউবা ত্যাগ করেন।
এরপর তার গন্তব্য হয় কংগোতে সেখানে তিনি বিপ্লবীদের একত্র করতে ব্যর্থ হন। সোভিয়েতের মানা স্বত্তেও তিনি বলিভিয়া যাত্রা করেন। কিন্তু বলিভিয়ার সরকার সিআইএ এর সঙ্গে হাত মিলিয়ে চে কে বন্দী এবং হত্যা করে। মৃত্যুর পরেও চে পুরো পৃথিবী তে স্মরণীয় হয়ে আছেন। কিন্তু আসলেই কি তার ছড়ানো বিপ্লব এবং বৈষম্যহীন পৃথিবীর স্বপ্ন জীবিত আছে? নাকি চে শুধুমাত্র তরুণদের ট্রেন্ড হিসাবে টিশার্ট এই জায়গা পেয়েছেন?