শুধু পদ্মা গর্ভেই ৫১ বছরে এক জেলার সমান জমি
গত ৫১ বছরে প্রায় ৬৬৩ বর্গ কিলোমিটারের বেশি জমি বিলীন হয়ে গেছে পদ্মার গর্ভে৷ সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে৷
পদ্মার গর্ভে বিলীন হওয়া জমির পরিমাণ মেহেরপুর জেলার আয়তনের (প্রায় ৭১৬ বর্গ কিমি.) কাছাকাছি বা ঢাকা শহরের আয়তনের প্রায় আড়াই গুণ৷
নদী ভাঙন নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশের একটি সংস্থা, ‘সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস’৷ প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক মমিনুল হক সরকার ডয়চে ভেলেকে জানান, গত চার দশকে বাংলাদেশের প্রধান তিনটি নদীতে দেড় লাখ হেক্টর জমি হারিয়ে গেছে৷ অন্যদিকে ফেরত পাওয়া গেছে প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর জমি৷ সেই হিসাবে বাংলাদেশ প্রধান তিনটি নদীতে একল হেক্টর জমি হারিয়েছে৷
বাংলাদেশে প্রবাদ আছে – নদীর একদিক ভাঙে, আরেকদিক গড়ে৷ কিন্তু নদীগর্ভে যে পরিমাণ জমি বিলিন হচ্ছে, চর জাগছে তার চেয়ে অনেক কম৷ আবার সেই চরে খুব একটা জনবসতিও গড়ে উঠতে পারছে না৷ ফলে মানুষ যেমন আবাসস্থল হারাচ্ছেন, পাশাপাশি হারিয়ে ফেলছেন সর্বস্ব৷ তাহলে কি নদীর ভাঙন ঠেকানোর কোনো পথ নেই? সরকারই বা এ ব্যাপারে কী করছে? আর একটু বেশি উদ্যোগ নিলে কি ভাঙন ঠেকানো সম্ভব?
চেষ্টা করলেও ভাঙন ঠেকানো সম্ভব না’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নাসরিন আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘চেষ্টা করলেও ভাঙন ঠেকানো সম্ভব না৷ এখন যে এখন এলাকা ভাঙছে, ২০-২৫ বছর পর ওই এলাকাতেই চর জেগে উঠছে৷ সেটার ব্যবস্থাপনা জরুরি৷ আসল কথা হলো – এখন যে ভাঙন, সেটা যে নতুন করে শুরু হয়েছে এমন নয়৷ এটা আগেও ছিল৷ কিন্তু আমাদের জনবসতি আগে এত ঘন ছিল না৷ ফলে কিছু জমি নদীগর্ভে গেলেও খুব একটা প্রভাব পড়ত না৷ কিন্তু এখন এক ইঞ্চি জমিও নেই যেখানে মানুষের বসতি নেই৷ এখন যেখানে ভাঙছে সেখানেই দেখা যাচ্ছে বহু মানুষ গৃহ হারাচ্ছেন, হারাচ্ছেন তার সর্বস্ব৷ ফলে প্রচারণাটা বেশি হচ্ছে৷ বালুর বস্তা বা ব্লক দিয়ে কত শতাংশ ভাঙন আটকানো যাচ্ছে – প্রশ্ন করেন তিনি৷
পদ্মার আয়তন, আকৃতি বদল আর স্থান পরিবর্তন নিয়ে নাসার প্রতিবেদনটি অনলাইন প্রচারমাধ্যম ‘আর্থ অবজারভেটরি’তে প্রকাশ করা হয়৷ সেখানে বলা হয়েছে, ১৯৮৮ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত স্যাটেলাইটে ধারণকৃত ১৪টি ছবি নিরীক্ষা তারা দেখেছেন, বিগত ৩০ বছর ধরে পদ্মার আয়তন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্থান পরিবর্তন হচ্ছে বিভিন্ন আকৃতিতে৷ আর এ কারণেই দেখা দেয় ভূমিক্ষয়৷ ১৪টি ছবিই নেওয়া হয়েছে প্রত্যেক বছরের শুষ্ক মৌসুম জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে৷ স্যাটেলাটের ব্যবহারকৃত ল্যান্ডস্যাট ৫ ছিল থিমেটিক ম্যাপারের, ল্যান্ডস্যাট ৭ ছিল বৃদ্ধি পাওয়া থিমেটিক ম্যাপারের এবং ল্যান্ডস্যাট ৮ ছিল প্রয়োগগত ভূমির ছবির জন্য৷ লক্ষাধিক কৃষিজীবী মানুষকে নদীটির ১৩০ কিলোমিটার উপকূলের পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে চলতে হয়৷
১৯৬৭ সাল থেকে আজ অবধি ৬৬ হাজার হেক্টরের বেশি ভূমি পদ্মায় হারিয়ে আয়তন বিচারে যা যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বড় শহর শিকাগোর সমান৷ ভয়াবহ মাত্রার এ ভূমিক্ষয়ের অন্যতম কারণ হচ্ছে, উত্তাল নদী প্রবাহের মধ্যে উপকূল সুরা কর্মসূচিতে খুব কম এলাকা থাকা এবং নদীর তীরে বিশাল বালুচর থাকা৷ দীর্ঘদিন যাবত পদ্মা নদীর প্রশস্ততা, গভীরতা, আকৃতি নিয়ে কাজ করা বিজ্ঞানীরা নাসার স্যাটেলাইটে ধারণকৃত ছবিকে ব্যাখ্যা করে বলেন, ১৯৮৮ সাল থেকে পদ্মার আকৃতি ও প্রশস্ততার পরিবর্তন হচ্ছে ব্যাপকভাবে৷ এমনকি বিজ্ঞানীদের কাছে নদীটির আঁকা-বাঁকা গতিপথসহ ভূ-তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি উঠে এসেছে৷
‘আশির দশকে যে ভাঙন ছিল এখন সেটা অনেক কম’
মমিনুল হক সরকার বলেন, ‘‘আমরা বহু বছর ধরে নদীর ভাঙন নিয়ে কাজ করি৷ এর মধ্যে ১৯৬৭ সাল থেকে স্যাটেলাইটের ব্যবহার শুরু হয়েছে৷ এই ৫১ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে আমরা দেখেছি, শুধু যমুনা নদীতে আমরা হারিয়েছি, দেড় হাজার বর্গ কিলোমিটার জমি৷ যেটা একটা ছোট জেলার সমান৷ আবার মেঘনা থেকে আমরা ফিরে পেয়েছি প্রায় এক হাজার ৭০০ স্কয়ার কিলোমিটার জমি৷ পদ্মা-মেঘনা ঘমুনা মিলিয়ে আমরা এই সময়ের মধ্যে এক হাজার ২০০ স্কয়ার কিলোমিটার জমি নদীগর্ভে হারিয়েছে৷ যা পেয়েছি তা বাদ দিয়েই হিসাবটা এমন৷”
তিনি বলেন, ‘‘কুড়িগ্রাম থেকে যমুনা ঢোকার পর থেকেই সেখানকার জেলাগুলোয় ভাঙন হচ্ছে৷ গাইবান্ধা, জামালপুর ও পাশের জেলাগুলো এর মধ্যে রয়েছে৷ কয়েক দশক ধরেই সিরাজগঞ্জ সবচেয়ে বেশি ভাঙন প্রবণ এলাকা৷ আবার চাঁপাইনবাবগঞ্জের যে এলাকা থেকে গঙ্গা প্রবেশ করেছে, যাকে আমরা গবেষকরা আরিচা পর্যন্ত গঙ্গা বলেই সম্বোধন করছি, সেটিও সেখানে একসময় প্রচুর ভাঙন ঘটালেও এখন প্রবণতা কিছুটা কম৷ তবে আশির দশকে যে ভাঙন ছিল এখন সেটা অনেক কম৷”
জনাব সরকার আরো বলেন, ‘‘বাংলাদেশে সব মিলিয়ে প্রতিবছর প্রায় ছয় হাজার হেক্টর জমি নদীতে হারিয়ে যাচ্ছে৷ স্যাটেলাইটের ইমেজ পরীক্ষা করে আমরা নদীগুলোর তখনকার অবস্থা আর এখনকার অবস্থা বিচার করে দেখতে পেয়েছি যে, গত চার দশকে বাংলাদেশের প্রধান তিনটি নদীতে দেড় লাখ হেক্টর জমি হারিয়ে গেছে৷ আর ফেরত পাওয়া গেছে প্রায় পঞ্চাশ হাজার হেক্টর জমি৷ এখানেও একটি পার্থক্য রয়েছে যে, নদীতে যেসব জমি হারিয়ে যাচ্ছে, সেগুলো কিন্তু উর্বর জমি, রাস্তা ঘাট, স্কুল কলেজ বাড়িঘর রয়েছে৷ কিন্তু যে জমি উঠছে, সেটাও ব্যবহার উপযোগী হতে আরো অনেক বছর দরকার হবে৷” তাঁর মতে, ছোটছোট নদীগুলোর ভাঙন ঠেকাতে কর্তৃপক্ষ কিছুটা সক্ষম হয়েছে৷ তবে প্রাকৃতিক কারণে যে ভাঙন হচ্ছে সেটা ঠেকানোর জন্য আমাদের এখন সমন্বিত পরিকল্পনা নিতে হবে৷ সরকারকেও বরাদ্দ বাড়াতে হবে৷