লিঙ্গ রূপান্তরকারীদের সাফল্য
রূপান্তরকামিতা বলতে বিশেষ একটি প্রবণতা বোঝায় যখন সেক্স বা ‘জৈবিক লিঙ্গ’ ব্যক্তির জেন্ডার বা ‘সামাজিক লিঙ্গ’র সঙ্গে প্রভেদ তৈরি করে। রূপান্তরকামী বা ট্রান্স-সেক্সুয়াল ব্যক্তিগণ এমন একটি যৌন পরিচয়ের মধ্য দিয়ে যান যা প্রকৃতিগতভাবে তাদের নির্ধারিত যৌনতার সঙ্গে স্থিতিশীল নয় এবং নিজেদেরকে স্থায়ীভাবে সেই লিঙ্গে পরিবর্তন করতে চান। ট্রান্স-সেক্সুয়াল বা রূপান্তরকামী মানুষেরা ছেলে হয়ে (দৈহিক বৈশিষ্ট্যে) জন্ম নেয়া সত্ত্বেও মন মানসিকতায় নিজেকে নারী ভাবতে পছন্দ করেন। এর উল্টোটিও কখনো কখনো হয়ে থাকে অর্থাৎ নারী হিসেবে জন্ম নেয়ার পরেও মানসিক জগতে থাকেন পুরুষসুলভ। এদের কেউ কেউ বিপরীত লিঙ্গের পোশাক পরিধান করেন, এই ব্যাপারটিকে বলা হয় ট্রান্সভেস্টিজম বা ক্রসড্রেস। আবার কেউ সেক্স রিঅ্যাসাইনমেন্ট সার্জারির মাধ্যমে তাদের কাঙ্ক্ষিত রূপান্তরিত মানবে পরিণত হন। এরা সকলেই রূপান্তরিত লিঙ্গ নামক বৃহৎ রূপান্তরপ্রবণ সম্প্রদায়ের অংশ হিসেবে বিবেচিত।
যারা এই ট্রান্স-জেন্ডার পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যান তারা বেশ হতাশার মধ্যে থাকেন। যারা নিজেদের ভেতরের এই ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যকে নিজেদের শারীরিক ত্রুটি বলে ধরে নেন তারা অতৃপ্তির সঙ্গে জীবন পার করে দেন আবার কেউ কেউ নিজেদের বাহ্যিক নারী রূপ বা পুরুষ রূপের বাইরে গিয়ে “অস্বাভাবিক” আচরণ করেন বলে পাগল (স্কিজোফ্র্যানিক) বলে বিবেচিত হন। সার্জারি করে অন্য লিঙ্গে রূপান্তরিত হওয়া বেশ ব্যয়সাধ্য ও কষ্টসাধ্য হলেও, বর্তমানে অনেকেই এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজের আসল পরিচয় খুঁজে নিচ্ছেন। শুধু তাই নয়, তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত লিঙ্গ পেয়ে স্বপ্নে ডানা লাগিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছেন সাফল্যের জগতে। কেউ কেউ আবার সাফল্যের চূড়ায় থেকেও নিজের কাঙ্ক্ষিত পরিচয়কে পাওয়ার জন্য নিজের লিঙ্গ পরিবর্তন করেছেন। এমন কিছু মানুষকে নিয়েই আজকের আলোচনা-
কেইটলিন জেনার:
ব্রুস জেনার হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। খেলার জগতে যে কেউ তাকে ব্রুস জেনার হিসেবে এক নামে চেনেন। কেননা অলিম্পিকে দু’বার সোনা জয়ের রেকর্ড আছে তার, তাও আবার ডেকাথলনে। ‘কিপিং আপ উইথ দ্য কারদাশিয়ানস’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিনোদন জগতে পা রাখেন। এই অনুষ্ঠানের পর রিয়েলিটি টিভি তারকা হিসেবে সবার নজরে আসেন। বর্তমানে তার নতুন একটি পরিচয় রয়েছে। ২০১৫ সালে নারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বিশ্বব্যাপী সাড়া ফেলে দেন ৬৫ বছর বয়সী এই ক্রীড়াবিদ। মার্কিন সাময়িকী ভ্যানিটি ফেয়ারের প্রচ্ছদে প্রথমবারের মত নারী হিসেবে আবির্ভূত হন তিনি। এরপর থেকে ব্রুস জেনারের বদলে কেইটলিন জেনার হিসেবে সবার কাছে নিজের পরিচয় দিতে পেরে খুশি তিনি।
লিঙ্গ রূপান্তরের অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি বলেন, “ইদানিং সকালবেলা ঘুম থেকে উঠতে খুব ভালো লাগে। বুঝতে পারি নিজের মতো আছি। আসল পরিচয় খুঁজে পেয়েছি। এখন স্বাভাবিক জীবন-যাপন করছি। জীবনের এতোটা বছর দ্বিধার মধ্যে কাটিয়েছি। আমার আলমারির এক পাশে পুরুষের পোশাক থাকতো, আরেক পাশে নারীর। এখন মনে হচ্ছে পুরো আলমারিটি পরিস্কার করেছি।” রাডার অনলাইন বলছে, ১০ হাজার ডলার দিয়ে কৃত্রিম স্তন সংযোজনের পাশাপাশি পুরো লিঙ্গান্তর প্রক্রিয়াতে খরচ পড়েছে ৮১ হাজার ডলার। লিঙ্গান্তরের আগে তিনবার বিয়েও করেন এবং তিনি মডেল ও টিভি পার্সোনালিটি কেন্ডাল জেনার এবং কাইলি জেনার এর বাবা।
মানবী বন্দ্যোপাধ্যায় ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে ভারতের প্রথম অধ্যক্ষ হন। শত বাঁধা পেরিয়ে বাংলা সাহিত্যে পিএইচডি করেন মানবী। এরপর বিবেকানন্দ শতবার্ষিকী মহাবিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। পশ্চিমবঙ্গের ট্রান্সজেন্ডার ওয়েলফেয়ার বোর্ডে ভাইস চেয়ারপার্সন হন তিনি। রুপান্তরকামীদের মুলস্রোতে ফিরিয়ে আনাতে সব ধরণের চেষ্টা করেছেন তিনি। ‘সোমনাথ’ থেকে ‘মানবী’ হওয়ার এই লড়াইকে কোনও অংশে কম তো বলা যায়ই না, বরং এগিয়ে রাখতে হয়। ব্রুস জেনার ছেলে থেকে মেয়ে হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে, ভারতের তুলনায় যে সমাজ অনেকটাই উদার ও প্রগতিশীল। তাছাড়া ব্রুস বিখ্যাত একজন মানুষ। তার অনুরাগীর সংখ্যাও প্রচুর। সোমনাথ ছেলে থেকে মেয়ে হয়েছেন এমন একটা সমাজে যেখানে সেই রূপান্তরের পর কারো অভিনন্দন তো নয়ই বরং তীক্ষ্ণ কথার বাণে বিদ্ধ হতে হয়।
এ বিষয়ে মানবী এক সাক্ষাৎকারে বলেন ‘শরীরটা যে আমার শরীর নয়, সেটা তো অনেক আগেই বুঝতে পেরেছি। তার থেকে মুক্তির একটা প্রয়াস ছিল। পুনর্জন্মে বিশ্বাস করলে নয় চাইতাম, মরে গিয়ে যেন পরজন্মে নারী হয়ে জন্মাই। এরপর শুনলাম, আধুনিক বিজ্ঞানে এর একটা ট্রিটমেন্ট থাকলেও থাকতে পারে। তখন এক চিকিৎসক আমার লেখালিখি দেখে যোগাযোগ করেন। আমাকে বলেন, যাদের নিয়ে কাজ করি, লেখালিখি করি, তাদের চিকিৎসা করাতে পারেন। ট্রিটমেন্টটা কিন্তু সেই অবস্থায় একটা নিরীক্ষার স্তরে, একেবারেই ফুলপ্রুফ না। সেদিক থেকে আমার এই সিদ্ধান্তের ভীষণ একটা গুরুত্ব ছিল, তাকে হয়তো মহানুভবতাই বলা চলে। কারণ ডাক্তারকে বলেছি, আমার শরীরটা নিয়েই পরীক্ষা করতে পারেন।’
এই পরিবর্তন তার জীবনকে নিজের গন্তব্যে নিয়ে গেছে। ১৯৯৫ সালে ভারতে প্রথমবারের মতো রূপান্তরকামীদের জন্য পত্রিকা বের করেন সোমনাথ, নাম ‘অবমানব’। তবে, সমাজের আঘাত হানার খেলা এত কিছুর পরেও বন্ধ হয়নি, তার রূপ বদলেছে মাত্র। মানবী অবশ্য দমেননি। তাঁর স্পষ্ট কথা “মানুষকে কী বলল, কোনো দিনই কান দিইনি। জানি, রোজগার করলে খেতে পারব, পরিবারকে খাওয়াতে পারব। আর রোজগার না করলে উপোস করে থাকব। কাজেই, কে কী বলল, তাতে কিচ্ছু যায় আসে না।”
কল্কি সুব্রমানিয়াম:
দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুর এক ব্রাহ্মণ পরিবারে কল্কির জন্ম। তার প্রাথমিক পরিচয় ছিল একজন পুরুষ হিসেবে, নারী হিসেবে নয়। পরিবারের সবাই বেশ খুশিই ছিল দুই কন্যার পর পুত্র সন্তান পেয়ে। কিন্তু কল্কি যতই বড় হতে থাকে ততই তার এই মানিয়ে নেয়া জীবনকে নিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। মাকে জানানোর পরও পরিবার থেকে মানসিক কোন সহায়তা না পেলেও তিনি যতটুকু যা পড়ালেখা করতে চান সেই সুযোগটুকু দিয়েছিল তার পরিবার। সেই সুযোগকে সম্পূর্ণভাবেই কাজে লাগান তিনি। সাংবাদিকতা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কে স্নাতকোত্তর শেষ করেন। তারপর কল্কি একটি বহুজাতিক সংস্থায় চাকরি নেন এবং নিজ যোগ্যতায় অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জন করে সেক্স রে-এসাইনমেন্ট সার্জারি করান এবং নিজের আকাঙ্খিত লিঙ্গে রূপান্তরিত হন; পরিপূর্ণতা দেন নিজেকে।
এরপর কল্কি প্রতিষ্ঠা করেন তার নিজের সংস্থা সহোদরী ফাউন্ডেশন। তার এই সংস্থা গত এক দশক ধরে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের রূপান্তরকামী মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের উপরে নিরন্তর কাজ করে চলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে নিমন্ত্রণ করা হয়। জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে তিনি আজ যে পর্যায়ে এসেছেন তার এই অনুপ্রেরণা বিশ্বের মানুষের কাছে তুলে ধরতে। রূপান্তরকামী মানুষদের একজন সফল প্রতিনিধি হিসেবে আজ তার নাম দেশ, বিদেশে সমানভাবে আদৃত। চিত্রশিল্পী, লেখক, রূপান্তরকামী মানবাধিকার কর্মী, অভিনেত্রী কল্কির বহুমুখী প্রতিভা আজ চর্চিত সমাজের নানা মহলে।
লিলি এলবে:
১৮৮২ সালের ২৮ ডিসেম্বর, ডেনমার্কে জন্ম নেন আইনার ম্যাগনাস আনড্রেয়াস ওয়েগনার। ১৯৩১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর, ৪৮ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন লিলি এলবে হিসেবে। সে সময় প্রথম লিঙ্গ পরিবর্তনকারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন লিলি এলবে। কলেজে পড়ার সময় তার প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠে গ্রেডা গটলিয়েব এর সঙ্গে। ১৯০৪ সালে তারা বিয়ে করেন। গ্রেডা ছিলেন একজন পেইন্টার। তার পেইন্টিংগুলোতে মডেল হতেন আইনার নিজেই। নারীদের পোশাক পরিধান শুরু করেন গ্রেডার চাহিদা অনুযায়ী মডেল হওয়ার জন্য। শুধু পোশাকই নয় এর পাশাপাশি আইনারকে মডেলের স্টকিং আর হিল জুতো পরিধান অবস্থায় আঁকার কাজ করতেন গ্রেডা। এলবে হঠাত খেয়াল করলেন মেয়েদের পোশাকে তিনি মোটেও অস্বস্তি বোধ করছেন না বরং তিনি নিজের ভেতর এক নারীসত্তাকে ভীষণভাবে উপলব্ধি করছেন। পরবর্তীতে গ্রেডার আঁকা সেই চিত্রকর্মগুলো ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে উঠে। সবাই প্রথমে ভাবতো এটি গ্রেডারের বোন লিলি এলবে, কেননা গ্রেডা সবাইকে তাই বলে এসেছিল। ১৯১৩ সালে সবাই বেশ বড় রকমের ধাক্কা খায় যখন তারা বুঝতে পারে গ্রেডার ছবিগুলোর মডেলটি আর কেউ নয়, বরং তার স্বামী আইনার।
১৯২০ থেকে ১৯৩০ সালে লিলি নিয়মিত নারী পোশাক পরিধান করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন। ১৯৩০ সালে যখন জার্মানীতে লিঙ্গ পরিবর্তনমূলক অস্ত্রোপচার সবেমাত্র শুরু হতে যাচ্ছে ঠিক তখনই এলবে জার্মানীতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। দুই বছরে চারটি অস্ত্রোপচার হয় লিলির। তিনটি অপারেশন ও বৈবাহিক জীবনের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি টেনে চতুর্থ অস্ত্রোপচারের জন্য লিলি জার্মানীতে ফেরেন। ততদিনে তিনি ডেনমার্কে হৈচৈ ফেলে দেন এবং আইনত একজন নারী হিসেবে নাগরিকত্ব পান। এ সময়ে হল্যান্ডের মডেল ও অভিনেত্রী হিসেবে নিজের খ্যাতি ও যশ প্রতিষ্ঠা করেন লিলি। অভিনয়ে দক্ষতার জন্য তিনি ভ্যানিশ ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ও এলজিবিটি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল থেকে ৪টি পুরস্কার পান। এবার লিলি একজন ফরাসি আর্ট ডিলারের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন যার নাম ক্লদ লেজুনেত। লিলি স্বপ্ন দেখতেন চতুর্থ সার্জারীর পর তিনি ক্লদের সঙ্গে সংসার শুরু করবেন, যেখানে তার নিজের সন্তান থাকবে।
১৯৩১ এর জুনে ফাইনাল সার্জারিতে ডাক্তাররা চেয়েছিলেন লিরির দেহে একটি যোনীপথ এবং জরায়ুর প্রতিস্থাপন করতে। প্রক্রিয়াটি ছিলো তখন একেবারেই পরীক্ষামূলক ও নতুন। এলবের শরীর সেই জরায়ু ট্রান্সপ্লান্ট প্রত্যাখ্যান করে। যার ফলে ভয়াবহ ইনফেকশনে আক্রান্ত হন তিনি। সে বছরেরই ১৩ সেপ্টেম্বর, সার্জারীর তিন মাস পর ইনফেকশনজনিত কারণে হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে মারা যান তিনি।