পরিবেশ দূষণে বছরে শুধু শহরেই এত মানুষের মৃত্যু
বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণ অনেক মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ বিশ্বব্যাংক বলছে, শুধু ঢাকায়ই এক বছরে ১৮ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে৷ সারাদেশের শহরাঞ্চলে মারা গেছে ৮০ হাজার৷
পরিবেশ দূষণের সমন্বিত নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে মানুষের জীবনের ওপর৷ বিশ্বব্যাংকের এই জরিপটি করা হয় ২০১৫ সালের তথ্য০ উপাত্তের ভিত্তিতে৷ রবিবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে তা প্রকাশ করা হয়৷ সংস্থাটির ২০১৮ সালের দেশভিত্তিক পরিবেশ বিশ্লেষন প্রতিবেদনে ‘বাংলাদেশের শহরাঞ্চলের পরিচ্ছন্নতা ও স্থিতিশীল উন্নয়নের সুযোগ বৃদ্ধিকরণ’ অংশে বলা হয়েছে, ‘‘ পরিবেশ দূষণের কারণে ২০১৫ সালে শুধু শহরাঞ্চলেই মারা গেছেন ৮০ হাজার ২৯৪ জন মানুষ৷ এর মধ্যে বায়ূ দূষণজনিত কারণে মারা যান প্রায় ৪৬ হাজার এবং পানি, অপর্যাপ্ত স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্য বিধিসংক্রান্ত কারণে মারা গেছে প্রায় ৩৪ হাজার মানুষ৷
পানি, স্যানিটেশন এবং অস্বাস্থ্যগত প্রত্যক্ষ প্রভাবে মারা গেছেন ৪ হাজার ৮০০ জন, পরোক্ষ প্রভাবে ৯৬৬ জন, পানিতে আর্সেনিকের কারণে প্রায় ১০ হাজার এবং পেশাগত পরিবেশ দূষণে মারা গেছেন প্রায় ১৯ হাজার মানুষ৷
ঢাকার হিসাব পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এ শহরে পারিপার্শ্বিক বায়ু দূষণজনিত কারণে মারা যান প্রায় সাড়ে ৬ হাজার এবং আবাসস্থলের বায়ু দূষণে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার মানুষ৷
এছাড়া পানি, স্যানিটেশন এবং অস্বাস্থ্যগত বিষয়ে প্রত্যক্ষ প্রভাবে মারা গেছেন প্রায় ১ হাজার, পরোক্ষ প্রভাবে প্রায় ২০০ জন, পানিতে আর্সেনিকের কারণে ২ হাজার ২০০ এবং পেশাগত দূষণে মারা গেছেন প্রায় ৪ হাজার ২০০ ব্যক্তি৷
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘‘শ্রম উৎপাদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে এই মৃত্যুতে ক্ষতির পরিমাণ এক দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার, যা ২০১৫ সালের বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) শূন্য দশমিক সাত শতাংশের সমান৷ রাজধানী ঢাকাতেই ক্ষতি হয়েছে ৩১ কোটি ডলার, যা ২০১৫ সালের জিডিপির শূণ্য দশমিক দুই শতাংশের সমান৷ দূষণের কারণে ঢাকার বাসিন্দাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে পাঁচ লাখ ৭৮ হাজার বছরের সমপরিমাণ সময়৷”
ঢাকা, পাবনা ও কক্সবাজার শহরে পরিচালিত জরিপের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়৷ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে সারা বিশ্বে পরিবেশ দূষণগত কারণে মারা গেছে গড়ে ১৬ শতাংশ মানুষ৷ আর বাংলাদেশে ২৮ শতাংশ৷ এই সময়ে দেশের শহরাঞ্চলে পঙ্গুত্ব বরণসহ নানা ক্ষতির শিকার হয়েছেন ২৬ লাখ ২৭ হাজার ৯২৬ জন৷ শুধু ঢাকা শহরে ক্ষতির শিকার হয়েছেন ৫ লাখ ৭৮ হাজার ৭৮১ জন৷
প্রিভেনটিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশে বায়ু দূষণ, খাদ্য দূষণ এবং জল দূষণ, প্রধানত এই তিনটি কারণে মানুষের মৃত্যুহার বেশি৷ অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার, অতিরিক্ত সার ব্যবহার, খাদ্যকে সংরক্ষণের জন্য ফরমালিন ও কারবাইডের ব্যবহারের কারণে খাদ্য-দূষণ হচ্ছে৷ এই খাবার খেয়ে মানুষ বিষক্রিয়ায আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে৷ আবার এই খাবারগুলো খাওয়ার কারণে কিডনি, লিভার, পাকস্থলী ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে৷ ফলে কিডনি ফেইলিওর, গ্যাস্ট্রিক, আলসার আক্রান্ত হচ্ছে৷ দীর্ঘমেয়াদে মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়
বায়ু দূষণের জন্য অ্যাজমা, শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা, অ্যালার্জিসহ নানা রোগে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে৷ জল দূষণের কারণে টাইফয়েড, আমাশয়, কলেরা প্রভৃতি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে৷ শব্দ দূষণের কারণে মানসিক চাপ বেড়ে যাচ্ছে৷ ফলে মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে৷ শব্দ দূষণের কারণে উদ্বেগ বেড়ে যায়, যা হার্টের রোগ বাড়ায়, রক্ত চাপ বাড়ায়, অনিদ্রা রোগও বাড়ে৷ এসবই মৃত্যুর কারণ৷”
তিনি বলেন, ‘‘বিশ্বব্যাংক পরিবেশ দূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে ৮০ হাজার মানুষ মারা যাওয়ার কথা বলেছে৷ পরোক্ষভাবে এই কারণে কতলোক মারা যায়, তার কিন্তু হিসেব নেই৷ আমাদের গড় আয়ূ বেড়ে যাচ্ছে৷ এখন ৭২ বছরের বেশি৷ কিন্তু এই জীবনে একজন মানুষ কত বছর অসুস্থ থাকে, তাতে তার যে কর্মঘণ্টা নষ্ট হয় তার দাম কত? অসুস্থতার কারণে চিকিৎসা ব্যয় কত? এসব বিবেচনা করলে ক্ষতির পরিমান অনেক বেশি৷”
ডা. লেলিন চৌধুরীরর মতে, ‘‘পরিবেশ দূষণের কারণে দেশের মানুষ যে ক্ষতির মুখে আছে তার সামান্য অংশই বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের উঠে এসেছে৷ বাস্তবে ক্ষতির পরিমাণ এরচেয়ে অনেক অনেক বেশি৷’
পরিবেশ দূষনের কারণে এই যে মৃত্যু, তাকে কোনো এক ধরনের পরিবেশ দূষণের ফল বলে মনে করেন না পরিবেশ, পানি ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপন ড. আইনুন নিশাত৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এটা সার্বিকভাবে পরিবেশ দূষণ সমন্বিত নেতিবাচক ফল৷ বায়ূ দূষণ, পানি দূষণ, খাদ্য দূষণ, শব্দ দূষণের সমন্বিত প্রভাব পড়ছে জনস্বাস্থ্যের ওপর৷”
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা বাড়ছে৷ ফলে খাবার পানির সংকট তৈরি হয়েছে৷ তাঁরা রেশনিং করে পানি খায়৷ এটার কারণে তাঁদের কিডনির ওপর প্রভাব পড়বে, রক্তচাপ বাড়ব৷”