মনোনয়ন দৌড়ে একঝাঁক ক্রীড়াবিদ-সংগঠক
তারিখ চূড়ান্ত হয়নি। তবে ধরে নেয়া হচ্ছে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের যে কোনো দিন হবে একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন। সে হিসেবে দেশের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে এখনও ৩ মাসেরও বেশি সময় বাকি। তবে এরই মধ্যে দেশে নির্বাচনী উত্তাপ শুরু হয়ে গেছে। শুরু হয়েছে নানা হিসাব-নিকাশ।
শহর, বন্দর আর গ্রাম-গঞ্জে বইছে নির্বাচনী বাতাস। কাগজ-কলমে এখনও প্রার্থী ঠিকঠাক না হলেও সম্ভাব্যরা নিজের ছবি দিয়ে দলের প্রতীকে ভোট চেয়ে পোস্টার, ব্যানার লাগানোও শুরু করে দিয়েছে নিজ নিজ এলাকায়।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করেন অনেক ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব, যাদের মধ্যে ক্রীড়া সংগঠকই বেশি। আছেন অনেক সাবেক তারকা ক্রীড়াবিদও। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে বিভিন্ন সেক্টরের মতো ক্রীড়াঙ্গনের অনেক মানুষ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। যাদের বেশিরভাগই বর্তমান সংসদ সদস্য। আছেন কিছু নতুন মুখও, যারা প্রথমবারের মতো নির্বাচনে অংশ নিতে চান বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ব্যানারে।
কেবল ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়া সংগঠকই নন, বিভিন্ন সময়ে ক্রীড়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন এমন অনেকেই আসন্ন নির্বাচনে অংশ নিতে প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছেন। যাদের কেউ নিজ নিজ দলের প্রভাবশালী নেতা, অনেকে মাঝারি গোচের। অনেকে আবার মনোনয়ন পাবেন না ধরেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন নিজেকে মানুষের কাছে নেতা হিসেবে উপস্থাপন করার।
দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক হারুনুর রশিদ এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির যুব ও ক্রীড়া সংগঠক জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক আমিনুল হক বলেছেন, তাদের দলের অনেকেই মনোনয়ন দৌড়ে রয়েছেন। তবে কাগজ-কলমে কেউই চূড়ান্ত নন। সবাই মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টা করছেন।
হারুনুর রশিদ নিজে নির্বাচন করতে চান লক্ষ্মীপুর-২ আসন থেকে। এই আসন থেকে তিনি ১৯৯৬ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ‘আমি এই আসন থেকে আগে নির্বাচিত হয়েছিলাম। দল মনোনয়ন দিলে এবারও নির্বাচন করতে চাই। আমি সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছি’- বলছিলেন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সাবেক এই সাধারণ সম্পাদক।
সাবেক ফুটবলার আমিনুল হক দলীয় মনোনয়ন পেলে এই প্রথম সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবেন। তিনি মনোনয়ন চাইবেন ঢাকা-১৬ আসন থেকে। দেশের ফুটবলে উজ্জ্বল মুখ আমিনুল হক। দীর্ঘদিন খেলেছেন লাল-সবুজ জার্সি গায়ে, নেতৃত্বও দিয়েছেন দেশকে। খেলা ছেড়ে রাজনীতিতে নেমেছেন সুদর্শন এ ফুটবলার। বিএনপির যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদকের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও পালন করছেন তিনি। ‘আমি প্রস্তুতি নিচ্ছি। দল মনোনয়ন দিলে নির্বাচন করবো’- বলেন আমিনুল হক।
বিভিন্ন ক্রীড়া ফেডারেশন ও ক্লাবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকেই আছেন যারা বর্তমান সংসদ সদস্য। গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন অনেকে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত এদের অনেকের মনোনয়ন পাওয়া নিশ্চিত। অনেকে বাদ পড়বেন। তবে ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনয়ন চূড়ান্ত না করা পর্যন্ত তাদের অপেক্ষায় থাকতেই হবে। যদিও প্রকাশ না হলেও অনেকে দলীয় হাই কমান্ডের সবুজ সংকেত পেয়ে নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় প্রচারণা শুরু করে দিয়েছেন।
এবারের সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে বড় চমক হতে পারে জাতীয় দলের বর্তমান দুই ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মর্তুজা এবং সাকিব আল হাসান যদি অংশ নেন। তারা দু’জন নির্বাচনে অংশ নেবেন কি না- সেটা নিজ মুখে একবারও বলেননি। তবে, কয়েক মাস আগে এক অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতা আ হ ম মোস্তফা কামাল জানিয়েছিলেন, আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবেন মাশরাফি এবং সাকিব। হয়ত এ লক্ষ্য সামনে রেখেই নিজ এলাকা নড়াইলে বেশ কিছু জনকল্যাণমূলক কাজও করে যাচ্ছেন মাশরাফি। সাকিব যদিও এ ব্যাপারে পুরোপুরি উদাসীন।
যদি মাশরাফি এবং সাকিব নির্বাচনে অংশ নেন, তাহলে তারা দু’জন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ব্যানারে প্রার্থী হবেন মাগুরা এবং নড়াইল থেকে। সাকিব আল হাসান অংশ নেয়ার কথা রয়েছে মাগুরা সদর এবং মাশরাফির অংশ নেয়ার কথা রয়েছে নড়াইল সদর আসন থেকে।
বর্তমান যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী ড. বীরেন শিকদার মাগুরা-২ আসনের সংসদ সদস্য। ওই আসনে তার মনোনয়ন পাওয়া অনেকটা নিশ্চিত। যেমন নিশ্চিত সাবেক যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নোয়াখালী-৫ আসন থেকে। বীরেন শিকদারের আগে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা আহাদ আলী সরকার তার আসন নাটোর-২ থেকে নির্বাচন করার আগ্রহ নিয়ে এলাকায় কাজ করছেন। ‘আমি বেশ ভালোভাবেই এলাকার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে যাচ্ছি। দল মনোনয়ন দিলে নির্বাচন করার ইচ্ছা আছে’-বলছিলেন সাবেক যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী।
জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক আরিফ খান জয় গত নির্বাচনে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন নেত্রকোনা-৩ আসন থেকে। এবারও তিনি ওই আসনে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আরিফ খান জয় ও গোলরক্ষক আমিনুল হক নিজ নিজ দলের মনোনয়ন পেলে একই সঙ্গে খেলা দুই ফুটবলারদের দেখা যাবে ভিন্ন ভিন্ন আসনে নির্বাচনী লড়াইয়ে।
আবাহনী লিমিটেডের পরিচালক, বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের সাবেক সহ-সভাপতি ও বাংলাদেশ টেনিস ফেডারেশনের সভাপতি শাহরিয়ার আলম গত নির্বাচনে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন রাজশাহী-৬ আসন থেকে। তিনি বর্তমানে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। এবারও ওই আসন থেকে তার মনোনয়ন পাওয়া প্রায় নিশ্চিত বলেই জানা গেছে।
বর্তমান সংসদ সদস্যদের মধ্যে নির্বাচন করবেন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সিনিয়র সহ-সভাপতি সাবেক ফুটবলার আবদুস সালাম মুর্শেদী। তিনি কিছুদিন আগে খুলনা-৪ আসনের উপ-নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। আসন্ন নির্বাচনে তিনি ওই আসনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাবেন, তা প্রায় নিশ্চিত।
আবাহনীর পরিচালক ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন গত নির্বাচনে সংসদ সদস্য হয়েছেন কিশোরগঞ্জ-৬ আসন থেকে। একই আসন থেকে এবারও তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাবেন বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের দুই সাবেক সভাপতি আ হ ম মোস্তফা কামাল ও সাবের হোসেন চৌধুরী এবারও নিজ নিজ আসন থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাইবেন। পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল গত নির্বাচনে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন কুমিল্লা-১০ আসন থেকে। সাবের হোসেন চৌধুরী ঢাকা-৯ আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। শোনা যাচ্ছে তার আসন থেকে মনোনয়ন চাইবেন বিশিষ্ট ফুটবল সংগঠক মোজাফফর হোসেন পল্টু।
সাবেক ফুটবলার ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু কুষ্টিয়া-২ আসন থেকে গত নির্বাচনে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। একই আসন থেকে এবারও তিনি নিজ দল জাতীয় সমাজতাতিন্ত্রক দল (জাসদ) থেকে নির্বাচন করবেন তা এক প্রকার নিশ্চিত।
ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক পরিচালক গোলাম দস্তগীর গাজী গত নির্বাচনে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জ-১ থেকে। তিনি এবারও একই আসন থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সাবেক অ্যাথলেট মাহবুব আরা বেগম গিনি গাইবান্দা-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। একই আসন থেকে এবারও তিনি ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাইবেন।
জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক, বিসিবির পরিচালক নাঈমুর রহমান দুর্জয় গত নির্বাচনে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন মানিকগঞ্জ-১ আসন থেকে। এবারও একই আসন থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশি বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেট দলের প্রথম অধিনায়ক।
মানিকগঞ্জ-২ আসনে মনোনয়ন চাইবেন সাবেক ফুটবলার, বিসিবির সাবেক পরিচালক দেওয়ান সফিউল আরেফীন টুটুল। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগেরও সাবেক যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক। ওই আসনে মনোনয়ন দৌড়ে তার প্রতিদ্বন্দ্বী বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী মমতাজ।
জাতীয় সংসদের যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান জাহিদ আহসান রাসেল গাজীপুর-২ আসন থেকে গত নির্বাচনে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। একই আসন থেকে মনোনয়ন পাওয়ার দৌড়ে এগিয়ে আছেন তিনি।
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সহ-সভাপতি ও আবাহনীর ভারপ্রাপ্ত ডাইরেক্টর ইনচার্জ কাজী নাবিল আহমেদ যশোর-৩ আসনে সংসদ সদস্য। এবারও তিনি একই আসনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাইবেন।
বাফুফের সাবেক সদস্য ও চট্টগ্রাম আবাহনীর মহাপরিচালক শামসুল হক চৌধুরী সংসদ সদস্য চট্টগ্রাম-১২ আসনের। একই আসন থেকে এবারও তিনি নির্বাচন করতে চান। মনোনয়ন পাওয়ার দৌড়ে এগিয়েও আছেন বিশিষ্ট এ ফুটবল সংগঠক।
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সাবেক সহ-সভাপতি বীর বাহাদুর বান্দরবান থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এবারও তার একই আসন থেকে মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল বলে জানিয়ে বিভিন্ন সূত্র।
বিএনপির সিনিয়র নেতা, সাবেক ফুটবলার ও বাফুফের সাবেক সভাপতি মেজর হাফিজ উদ্দিন (অব.) ভোলা থেকে নির্বাচন করবেন বলে শোনা যাচ্ছে। বাফুফের আরেক সাবেক সভাপতি এসএ সুলতান একবার সংসদ সদস্য হয়েছিলেন চাঁদপুর-৩ আসন থেকে। এসএ সুলতান ওই আসন থেকে এবারও নির্বাচন করবেন বলে শোনা গেলেও তিনি নিজে অবশ্য জোর দিয়ে কিছু বলেননি।
সাবেক তারকা ফুটবলার কায়সার হামিদ জাকের পার্টির প্রার্থী দুইবার নির্বাচন করেছিলেন ঢাকা-৫ ও ১৪ থেকে। এবারও নিজ দল থেকে নির্বাচন করার ইচ্ছে প্রকাশ করে কায়সার হামিদ বলেছেন, ‘আমি এলাকায় কাজ করছি। মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। জানি না, আমার দল এককভাবে নাকি কোনো জোটের সঙ্গে নির্বাচনে অংশ নেবে।’
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সহ-সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ মহি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাইবেন ব্রাহ্মবাড়িয়া থেকে। বাংলাদেশ অ্যাথলেটিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রকীব মন্টু আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী সিলেট-৩ আসন থেকে।
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্য সাইদুর রহমান প্যাটেল মনোয়ন চাইবেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের। তিনি ঢাকা-৬ আসনে নির্বাচন করতে আগ্রহী বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ বাস্কেটবল ফেডারেশনের সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাইবেন পুরান ঢাকা থেকে।
সাবেক ফুটবলার একরামুল করিম চৌধুরী নোয়াখালী-৪ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য। তিনিও আওয়ামী লীগের ব্যানারে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।