জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সুন্দরবন নির্ভরশীল বাঘ বিধবাদের ট্রাজেডি
বাসন্তি, আলোমতি, দীপালি, সোনামনি, আন্দারিবালা একেকজন মানুষের নাম। এদের প্রায় সবাই খুব অল্প বয়সে স্বামীঘরে এসেছিলেন। কারও কারও বিবাহিত জীবন খুব কম সময়েই শেষ হয়েছে। কারও কারও কেটেছে একটু দীর্ঘ জীবন। কিন্তু এদের সবারই দাম্পত্য জীবনের ইতি ঘটেছে একইভাবে।
সুন্দরবনের মাছ, কাঠ, মধু সংগ্রহ নির্ভর জীবিকা অন্বেষী এদের সবারই মৃত্যু ঘটেছে সুন্দরবনের বাঘের হাতে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বামীর ছিন্নভিন্ন মৃতদেহের খোঁজ মেলেনি। যাদের সেই ভাগ্য হয়েছে, বাঘের হাতে ক্ষত-বিক্ষত-থেতলে যাওয়া স্বামীর চেহারার বীভৎসতার স্মৃতি মুছে যায়নি জীবন থেকে। এসব বাঘবিধবার কেউ কেউ দ্বিতীয়বার বিবাহ করেছেন। সেই স্বামী ও গেছে বাঘের পেটে। সমাজ তাদের ভাল চোখে দেখেনি। স্বামীর অপমৃত্যুর দায় চাপিয়েছে নিরীহ এই নারীদের ওপর। অপয়া, অলক্ষী, অসতী, উপাধি মিলেছে বালবিধবাদের। তাদের অনাথ সন্তানরা ও এই সামাজিক নিপীড়নের হাত থেকে বাঁচেনি। এক অসহনীয়, কষ্টকর, নিপীড়িত, বঞ্চিত, অভাবী দুষ্টচক্রের জীবন তাদের কাছে টানেনি, রাষ্ট্র তাদের খোঁজ নেয়নি, উন্নয়ন অংশী-জনরা তাদের দুর্গতির খবর জানলে ও তেমনি কিছু করতে পারেনি।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, বরগুনা, পিরোজপুর পাঁচ জেলার ১৭ উপজেলার ২২১ ইউনিয়নের প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক লোক সুন্দরবনের উপর নির্ভর করে বেঁেচ থাকে। প্রায় প্রতি বছর সুন্দরবনে বাঘের হাতে মারা পড়ে উল্লেখযোগ্যসংখ্যাক মানুষ। মাছ মারতে, কাঠ কাটতে, মধু সংগ্রহ করতে সুন্দরবন নির্ভর পেশাজীবীদের এই হতভাগ্য অংশটি নিহত হয় বাঘের হাতে। কখনো কখনো সুন্দরবন সংলগ্ন জনবসতি লোকালয়ে ঢুকে পড়ে বাঘ। সেই বাঘের হাতে ও ঘটে মানুষের মৃত্যু। সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, বুড়ি-গোয়ালিনী, মুন্সি-গঞ্জ, রমজান-নগর ইউনিয়ন সুন্দরবন সংলগ্ন। বন বিভাগ ও ইউনিয়ন পরিষদের তথ্য মতে ২০০০ থেকে ২০১০ এই দশ বছরে এই চার ইউনিয়নেই বাঘের হাতে মারা গেছে তিনশ’র বেশি মানুষ। বাঘের হাতে নিহত পুরুষদের স্ত্রীদের অভিহিত করা হয় বাঘবিধবা (ঞরমবৎ ডরফড়) বলে। এক পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছে গত এক দশকে সুন্দরবন এলাকাজুড়ে বাঘবিধবার সংখ্যা দাঁিড়য়েছে প্রায় তিন হাজার। জীবন জীবিকার প্রয়োজনে কাঠ কাটতে, মাছ ধরতে, মধু সংগ্রহ করতে স্বামীরা যখন বনে যায়, স্ত্রীর নানা রকম সংস্কার পালন করে। স্বামীরা বনে থাকা অবস্থায় স্ত্রীরা সাধারনত দিনে কাপড় ধোয় না, চুলে চিরুনি দেয় না, দিনের বেলায় চুলা ধরায় না, শুকনো মরিচ পোড়ায় না, আত্মীয়-বাড়ি যায় না, দিনের বেলায় ঘরদোর পরিষ্কার করে না। এসব সংস্কার চলে আসছে বহু বছর ধরে। ইদানিং এনজিও কর্মকাণ্ডের কারণে এসব কুসংস্কার ভাঙ্গতে নানা রকম প্রণোদনা চালালেও এর খুব একটা হেরফের হয়ে ওঠেছে বলে মনে হয় না। কখনো সংস্কার মেনে কখনো পরিবার ও সমাজের চাপে এসব আচার পালন করতে বাধ্য হয় স্ত্রীরা। এর ফলে স্বামী বনে গেলে সারারাত জেগে তারা ঘর গুছোয়, রান্না করে, ঘরের অন্যান্য সাংসারিক কাজ করে নির্ঘুম কাটে তাদের রাত। নারীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া এই সংস্কার সত্বের যখন বাঘের হাতে স্বামীহারা হন ‘বাঘবিধবা’ তখন সমাজ তাদের আর ও নিপীড়নের মুখে ঠেলে দেয়। ‘বাঘবিধবা’ সমাজে অপয়া, অলক্ষ্মী, অসতী হিসেবে চিহ্নিত হয়। স্বামীর মৃত্যুর জন্য বাঘের বদলে দায়ী হয় এই স্ত্রী সমাজ। সমাজের চোখে তারাই হয়ে উঠে বাঘের দোসর। দারিদ্র, অশিক্ষা-কুশিক্ষা আর অসচেতনতার বলি হয় বালবিধবারা। বাঘের হাতে স্বামীর মৃত্যুর পর অধিকাংশ ক্ষেত্রে এদের জায়গা হয় শ্বশুরগৃহে থেকে ফিরে আসতে হয় পিতৃগৃহে। কখনো কখনো এই দু’জায়গা থেকেই বিতাড়িত হয় তারা। সমাজের, পরিবারের নতুন ভার হয়ে নিজ সন্তানদের নিয়ে খাসজমিতে কিংবা অন্যের জমিতে কোনো রকমে বসতি গড়েন বাঘবিধবরা। এসব অঞ্চলে বাল্যবিবাহ চালু থাকায় অধিকাংশ বাঘবিধবরা খুব অল্পবয়সেই স্বামীহারা হন। এদিকে এক অনিশ্চিত অর্থনৈতিক টানাপড়েনের জীবনের সঙ্গী শুরু হয় তাদের নিয়ে কানাঘুষা, লোককথা। এক ধরনের সামাজিক নিপীড়নের সুযোগ নেয় কখনো কখনো সমাজের শক্তিমান অংশ। তবে, অধিকাংশ বাঘ-বিধবাকেই দায়িত্ব নিতে হয় সংসারের। আয়ের প্রধানতম মানুষ হয়ে উঠেন তিনি। বাধাবিঘ সব এড়িয়ে সন্তানদের মুখে খাবার জোটাতে এক নতুন শ্রমজীবি জীবন শুরু হয় তাদের। ধানের ক্ষেতে, মাছের ঘেরে শ্রমিকের কাজ আর নদীতে জাল ফেলে, বড়শি ফিলে মাছ ধরে নতুন আয়ের পথ তৈরি করেন তারা। একান্ত এই স্বল্প আয় কোনোরকমে খাদ্যের সংস্থান ঘটালেও সন্তানদের লেখাপড়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয় অধিকাংশ বাঘবিধবাই। ফলে বাবার পেশাতেই ফিরতে হয় পুরুষ সন্তানদের। শুরু হয় আবার সেই পৌনঃপুনিক জীবন। বাঘ বিধবাদের সন্তানরাও সমাজে অপয়া হিসাবে চিহ্নিত হয়। ফলে স্বাভাবিক পরিবেশে সমাজের অন্য শিশুদের সঙ্গে বেড়ে উঠার ক্ষেত্রে তারা ও পড়ে নতুন চাপের মুখে। খেলার মাঠে, স্কুলে সাথীদের নিপীড়নের শিকার হয় বাঘবিধবা পরিবারের সন্তানরাও। স্থানীয় এন জি ওরা বাঘ বিধবাদের সন্তানদের এসব সামাজিক সমস্যা নিয়ে কাজ শুরু করেছে। কোনো বিয়েতে, কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে একজন বাঘবিধবা যেমন অনাকাক্সিক্ষত, তাদের সন্তানরাও সেই অপয়াদৃষ্টির শিকার। কোনো শুভ কাজে এই কথিত অপয়া বাঘবিধবা কিংবা তাদের সন্তানদের তাই জায়গা হয় না। তারা অনাকাক্সিক্ষত, অনাদৃত হয়ে থাকেন। শিকার হন এক বৈষম্য ও নিপীড়নের।
সুখ-দু:খ, সাফল্য-ব্যর্থতা এসব নিয়েই আমাদের জীবন। আমাদের মাঝে কেউ কেউ আছে যারা জীবনের দু:খ গুলোকে সয়ে যেতে পারে সহজেই। জীবনের গতি পথে সাময়িক স্থবিরতা সৃষ্টি হলেও এক সময় স্বাভাবিক হয়ে যায় চলার পথ। এবার বাদা থেকে ফিরে ২খানা শাড়ী, ২টি ব্লাউজ পিচ আমি বৃহস্পতিবার বাজার থেকে কিনে দেব। আর জীবন নিয়ে ফেরা হল না আবু মোড়লের সময় ছিল ২০০৯ সালের জুন মাসের শেষের বুধবার সকাল ১০টার দিকে। স্বামীর স্বপ্ননের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো নূর জাহান বেগম। স্বামীর ভিটা ছেড়ে অন্যের বাড়িতে বাচ্ছা ৩টি আশ্রয় মিললেও করুণায় ভিক্ষা মিলেছে মাত্র। সার দিন হাড় ভাঙা পরিশ্রমে কোন প্রকার সন্তানের মুখে আহার যোগাতে পারত বটে। কিন্তু ছেলে মেয়েরা ৩ জন তারা বড় হয়ে গেলে আশ্রয় দাতার বাড়ি থেকে নদীর পাড়ে খাস জায়গায় এসে ঘর বেঁধে আশ্রয় নিতে হয়েছে। কি নিদারুণ পরিণতি বড় ছেলে আজিজুরের বিবাহ হলে সে মাকে ছেড়ে আলাদা হয়ে যায়। ছোট ছেলে রেজাউল সে ঢাকায় থাকে, মেয়ে ফাতেমা খাতুন তাকে সকলের সহযোগিতায় বিবাহ দেওয়া হয়েছে বনজীবির সাথে। কীভাবে চলছে তার সংসার এ প্রশ্নের জবাবে আবারও কান্নায় ভেঙে পড়লো নূজাহান বেগম। ভারাক্রান্ত কণ্ঠে জানান আমার মত অপয়া অলক্ষ্মীকে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার দরকার নেই।