রোমান সভ্যতা ও গ্ল্যাডিয়েটরদের রোমহর্ষক ইতিহাস

রোমান সভ্যতার কথা মাথায় এলেই জ্বলজ্বল করে উঠে প্রাচীন এক বৈভবময় সভ্যতার কথা। প্রাচীন কলোসিয়ামে যুদ্ধরত দুর্দান্ত সাহসী আর অকুতোভয় গ্ল্যাডিয়েটরদের কথা।

রোমান সভ্যতার কেন্দ্রভূমি ছিল রোম। যে নগরের ঐশ্বর্যের কোনো শেষ ছিলনা। যেন বড় বড় দালান আর সম্পদে পরিপূর্ণ এক স্বর্গরাজ্য। কিন্তু এ নগরীর সবাই ই কি ঐশ্বর্যশালী ছিল? দুঃখময় কোনো গল্প নেই সেই প্রাচীন নগরের? সভ্যতার সব বড় বড় সৃষ্টির পেছনের অন্ধকার গল্পগুলো সামনে খুব কম আসে। অত্যাচারিতদের বিষাদময় সে কথাগুলো চাপা পড়ে থাকে কালের ধূলোর নিচে। রোমের ইতিহাসকে সঠিকভাবে বুঝতে হলে এর শুরুর দিনগুলোর কথা জানতে হবে।

আজ থেকে প্রায় তিনহাজার বছর আগে, খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে রোম নগর স্থাপিত হয়েছিল। খুব সম্ভবত রোমানরা ছিল আর্যদের বংশধর।

খরস্রোতা টাইবার নদীর তীর ঘেষে দাঁড়িয়ে থাকা সাতটি পাহাড়ের আশেপাশে বিক্ষিপ্তভাবে এরা বসবাস করত। আস্তে আস্তে এই বাসস্থানগুলো মিলে একটা নগরী গড়ে উঠল। এই নগর রাষ্ট্রটি ক্রমেই বেড়ে চলল এবং বিস্তার লাভ করতে করতে পরিণত হলো এক বিশাল সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে। রোমানদের শাসন্যবস্থা শুরুর দিকে গ্রীক নগর রাষ্ট্রের মতোই ছিল, কিন্তু এরপর রোম আশেপাশের রাজ্যগুলোকে দখল করে রাজ্যবিস্তার করে চললো। এভাবে বাড়তে বাড়তে সমগ্র ইতালি রোম সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।

রোমান সভ্যতা ও গ্ল্যাডিয়েটরদের রোমহর্ষক ইতিহাস

রোম ছিল শাসনকেন্দ্র, সেখান থেকেই সমগ্র রাজ্য শাসন করা হতো। রোম নগরের শাসনব্যবস্থা খুব অদ্ভূত ছিল। সেখানে কোনো রাজা বা সম্রাট ছিলনা। অনেকটা প্রজাতন্ত্রের মতোই, সেখানে ধনী জমিদারদের প্রাধান্য ছিল। এই শাসনভার ছিল সিনেট সদস্যদের উপর। আর সিনেটের সদস্যরা কেবল অভিজাত বংশীয়দের ভেতর থেকেই হতে পারত। সমাজে ধনী আর দরিদ্রের পার্থক্য ছিল প্রকট। সমগ্র রোমান জাতি দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। একটি শ্রেণীকে বলা হতো প্যাট্রিসিয়ান, এরা ছিল অভিজাত ও ধনী জমিদার। আর অপর শ্রেণীর নাম ছিল প্লিবিয়ান, এরা সাধারণ নাগরিকের দল। প্যাট্রিসিয়ানরা খুব আরাম আয়েশের সাথে জীবনযাপন করতো। প্যাট্রিসিয়ানদের হাতেই ছিল ক্ষমতা। আর ক্ষমতার সাথে সাথে টাকা পয়সাও জমতে লাগলো তাদের সিন্দুকে।

সম্পদের পাহাড় জম উঠতে লাগলো এইসব অভিজাতদের। অন্যদিকে প্লিবিয়ানদের জীবন ছিল কষ্টময়। কোনোমতে কায়ক্লেশে জীবনধারণ করতে হতো তাদের। তারা ছিল নিঃস্ব আর অসহায়। তাদের না ছিল টাকাপয়সা, না ছিল ক্ষমতা। শুরুর কয়েকশ বছরের রোমান রাষ্ট্রের ইতিহাস এই দুই শ্রেণীর ভেতরের দ্বন্দ আর সংঘাতের ইতিহাস। ক্ষমতার জন্য প্লিবিয়ান আর প্যাট্রিসিয়ানদের মধ্যে মাঝে মাঝেই সংঘর্ষ বাধতো। তারফলে প্লিবিয়ান বা সাধারণ নাগরিকদের বিদ্রোহের আগুন দমিয়ে রাখার জন্য কিছু কিছু সুযোগ সুবিধে ছাড় দিতে বাধ্য হলো অভিজাতরা।

কিন্তু রোমের অন্ধকার আর দুঃখময় গল্প প্লিবিয়ান আর প্যাট্রিসিয়ানদের নিয়ে নয়। অভিজাত আর সাধারণ মানুষ ছাড়াও রোমে আরেক শ্রেণীর মানুষের বাস ছিল। তারা ছিল ক্রিতদাস। ক্রিতদাসের কোনো অধিকার ছিলনা। ভোট দেবার ক্ষমতাও ছিলনা। গরু ভেড়ার মতো এরা ছিল মনিবের সম্পত্তি। মনিবেরা যা ইচ্ছে করতে পারত এদের নিয়ে। ইচ্ছে হলে বিক্রিও করে দিত। সেই যুগে দাস ব্যবসা ছিল খুব লাভজনক। এই ঘৃণ্য ব্যবসায় মেতে উঠলো রোমের ব্যবসায়ীরা। এই ব্যবসায়ীরা দূর দেশ থেকে ধরে নিয়ে আসত মানুষদের, আর দাস বানিয়ে বিক্রি করে দিত। রোমের ঐশ্বর্যের মূলে ছিল এই দাস ব্যবসা।

কিন্তু এত ঐশ্বর্যেও অভিজাততন্ত্রের মানুষের কুলাতো না। আরো, আরো চাই তাদের। বিলাস, ভূষণ আর অপব্যয় করে বিপুল সম্পদ নষ্ট করতো তারা। বাড়তি অর্থ আদায়ের জন্য তারা কর বসালো সাধারণ মানুষের উপর। মানুষ এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে খেপে উঠলো। সাধারণ মানুষের ক্ষোভ কমানোর জন্য তাদের চিন্তাকে অন্যদিকে সরিয়ে দেবার জন্য শাসকশ্রেণী রোমে এক অদ্ভূত হিংস্র খেলার আয়োজন করলো। বন্দী ক্রিতদাসদের পাঠাতো রোমের কলোসিয়ামে (এক ধরণের ছাদখোলা উপবৃত্তাকার মঞ্চ)। একে অপরের সাথে যুদ্ধ করতে। যে অন্যকে হত্যা করতে পারবে সেই জয়ী হবে। এই যোদ্ধাদের বলা হতো গ্ল্যাডিয়েটর। এই বর্বর, নৃশংস খেলায় রোমের মানুষেরা মজে ছিল অনেক দিন। হত্যা আর রক্তের এই উন্মত্ত খেলার নেশায় তারা বুদ হয়ে ছিল। রোমের ঐশ্বর্যের গল্পের আড়ালে চাপা পড়ে থাকা এইসব হতভাগা ক্রিতদাসদের মর্মভেদী ইতিহাস আমাদের হৃদয়ে দুঃখের প্লাবন জাগায়। রোমের প্রশস্ত রাস্তায়, কলোসিয়ামের পাথরের আড়াল থেকে ভেসে আসে তাদের দুঃখময় দীর্ঘশ্বাসের শব্দ।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)