গ্রাম থেকে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীন ঐতিহ্য খেলাধুলা
সাতক্ষীরা জেলার সকল এলাকা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীন খেলাধুলা। ঐতিহ্যবাহী গ্রামীন খেলা-ধুলা সরস প্রাণের জীবন্ত উৎস। বিনোদনের খোরাক তো বটেই! আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই আজ বিলুপ্তির পথে। তবে গ্রামীন জনপদে এখনও কিছু কিছু খেলা-ধুলা চোখে পড়লেও উৎসাহ-উদ্দীপনা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তাও বন্ধ হতে চলেছে। জেলার বিভিন্ন এলাকার গ্রামাঞ্চলে এক সময় প্রায় শতাধিক গ্রামীন খেলা-ধুলার প্রচলন ছিল। তার মধ্যে ছেলেরা খেলতো হা-ডু-ডু, ডাংগুলি, কাবাডি, গোল্লাছুট, খেটে খেলা, দৌড়-ঝাঁপ, গাদন, চিকে, কপালটোকা, কানামাছি ভোঁ ভোঁ, মালাম খেলা, কুস্তি, ডুব সাঁতার, নৌকাবাইচ, লাঠিখেলা, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগ লড়াই, হৈল বৈল, বস্তাদৌড়, লুকোচুরিসহ অনেক খেলা। আর মেয়েরা খেলত গোল্লাছুট, এক্কাদোক্কা, পাঁচগুটি, চোরপুলিশ, বৌচি, কিতর্কিত, কড়ি খেলা, বালিশ বদল, লুকোচুরি, পুতুল খেলা, রান্নাবাটিসহ অনেক খেলা।
এসমস্ত খেলাগুলোর অধিকাংশই এখন বিলুপ্তির পথে। তার মধ্যে এখনও হা-ডু-ডু, কাবাডি, লাঠিখেলাসহ হাতেগোনা কয়েকটি খেলার প্রচলন আছে। এখনও গ্রামাঞ্চলে পহেলা বৈশাখ ও গ্রামীণ মেলার সময় এসব খেলা অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। এসব ঐতিহ্যবাহী খেলা-ধুলার পরিবর্তে অনেক দিন আগেই এদেশে প্রচলন হয় ফুটবল খেলার। বর্তমানে উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতা ও খেলার মাঠের স্বল্পতার কারণে বিপন্ন অবস্থায়। ক্রিকেট খেলা আমাদের দেশীয় খেলা না হলেও অন্যান্য দেশের মত বর্তমানে আমাদের দেশে বর্তমানে প্রচলিত খেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম।
এক সময় রাখাল ছেলেরা মাঠে গরু চরাতে গিয়ে ও স্কুলপড়ুয়া ছেলে-মেয়েরা নানা ধরনের গ্রামীন খেলা-ধুলা নিয়ে মেতে থাকতো। বর্তমানে শহরাঞ্চলে তো বটেই গ্রামাঞ্চলেও খোলা জায়গা বা খেলার মাঠের স্বল্পতার কারণে অনেক গ্রামীন খেলার মৃত্যু ঘটেছে অনেক আগেই। ফলে বর্তমানে ভিডিও গেম, টেলিভিশন, মোবাইল ফোন ইত্যাদি গ্রামীন খেলা-ধুলার সে স্থান দখল করে নিয়েছে। ছেলেমেয়েরা একটু সময় পেলেই মেতে ওঠে এসব জিনিস নিয়ে। পড়াশুনা যেমন ছেলেমেয়েদের মানসিক বিকাশ ঘটায় তেমনি শারীরিক বিকাশ ঘটাতে খেলাধুলার কোন বিকল্প নেই। আগেকার দিনে গ্রামাঞ্চলে হা-ডু-ডু, কাবাডি ও লাঠিখেলার জন্য রীতিমত প্রতিযোগিতা চলত। বিভিন্ন গ্রামে এসব খেলার জমজমাট আয়োজন হতো। এ সমস্ত খেলা দেখার জন্য অনেক দুরদুরান্ত থেকে খেলা শুরুর অনেক আগে থেকেই মানুষ দলে দলে এসে উপস্থিত হতো খেলার মাঠে। অনেক খেলোয়াড় টাকার বিনিময়েও বিভিন্ন দলের হয়ে খেলতো। তাতে করে ভালো খেলে যেমন টাকাসহ নানারকম পুরস্কার মিলতো সেই সাথে ভালো খেলোয়াড় হিসেবে এলাকায় ছড়িয়ে পড়তো তার খ্যাতি। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ এসমস্ত খেলোয়াড়দেরকে অনেক সম্মান করতো।
আগেকার দিনে প্রতিবছর সব স্কুল কলেজ, মাদরাসাগুলোতে নানা ধরনের খেলাধুলার আয়োজন করা হতো। বর্তমানে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কোন খেলার মাঠও নেই। ফলে খেলাধুলা উপস্থিতি না থাকায় শিক্ষার্থীদের শারীরিক বিকাশ ঘটছে না। বর্তমানে আকাশ সংস্কৃতির অপগ্রাসের ফলে ছেলেমেয়েরা ক্রমশ: খেলা বিমুখ হয়ে পড়েছে। এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা গ্রামবাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য এসব গ্রামীন খেলাধুলা তো করেই না, এমনকি এসব খেলাধুলার নামও জানেনা। অথচ এক সময় এসমস্ত খেলাধুলাকে বাদ দিয়ে বাঙালি ঐতিহ্যের পূর্ণতাকে কল্পনাও করা যেত না। বর্তমানে এসব ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলার প্রচলন না থাকায় গ্রামীন জনপদ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে হাজার বছরের বাঙালী ঐতিহ্য।
এ অবস্থা চলতে থাকলে হয়ত অচিরেই গ্রামীন খেলা-ধুলা আমাদের সংস্কৃতি থেকে হারিয়ে যাবে। পরিণত হবে রূপকথার গল্পে। তবে এখনও সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ নিলে হারিয়ে যাওয়া খেলাগুলোর অনেকটাই টিকিয়ে রাখা সম্ভব। এ সমস্ত গ্রামীন খেলা-ধুলার সাথে রয়েছে আমাদের পূর্বপুরুষদের নাড়ীর সম্পর্ক। তাই তাদের স্মৃতি ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে আমাদের উচিত এ সমস্ত গ্রামীন খেলা-ধুলার আয়োজন করে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এর পরিচিতি ও তার সুফল লাভের জন্য আকৃষ্ট করা।
বেশ কয়েক বছর পূর্বে দেখা গিয়েছিল ফিংড়ী ইউনিয়নের জোড়দিয়া কৃষি কল্যাণ সংস্থা কর্তৃক আয়োজিত হাজারো দর্শকদের সমাগমে গাদনদাড়ী খেলা, যে খেলাটি দর্শকদের মন জয় করেছিল। বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন খেলাটি প্রচার করে ছিল। জোড়দিয়া মডার্ন স্পোটিং ক্লাব আয়োজন করেছিল লাঠি খেলা, যে খেলাটি দর্শকদের মনে আনন্দ সৃষ্টি করেছিল ব্যাপক। আজ সেই গ্রামীন খেলাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। তাই গ্রামীন খেলাগুলো আবারও ফিরে পেতে চায় খেলা প্রিয় দর্শকরা।