বাংলাদেশে হিজড়াদের মানবেতর জীবনের শেষ কোথায়?
তৃতীয় লিঙ্গের মানুষগুলোর যাপিত জীবন আসলেই মানবেতর। আমাদের সমাজে তাদের ডাকা হয় হিজড়া নামে। হিজড়া শব্দটি এসেছে আরবি হিজরত বা হিজরি শব্দ থেকে যার আভিধানিক অর্থ পরিবর্তন। শারীরিক লিঙ্গের ত্রুটির কারণে এদের সৃষ্টি। এদের প্রধান সমস্যা গুলো হল এদের লিঙ্গে নারী বা পুরুষের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য থাকে না। হিজড়াদের শারীরিক গঠন মূলত তিন প্রকার কারও নারীদের সকল বৈশিষ্ট্য থাকলেও নারী জননাঙ্গ থাকে না,পুরুষের সকল বৈশিষ্ট্য থাকলেও পুরুষ জননাঙ্গ থাকে না,আবার অনেকের মধ্যে উভয় বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকে। কারো কারো ক্ষেত্রে দেখা যায় লিঙ্গ নির্ধারক অঙ্গ থাকে না।কেন জন্ম হয় হিজড়া শিশুর বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মতামতে উঠে আসে,এক্স এক্স প্যাটার্ন ডিম্বাণুর সমন্বয়ে কন্যা শিশু আর এক্স ওয়াই প্যাটার্ন থেকে সৃষ্ট হয় ছেলে শিশু।ভ্রুণের পূর্ণতার স্তর গুলোতে ক্রোমোজোম প্যাটানেব্র্রর প্রভাবে ছেলে শিশুর মধ্যে অ-কোষ আর কন্যা শিশুর মধ্য ডিম্ব কোষ জন্ম নেয়। অ-কোষ থেকে নিঃসৃত হয় পুরুষ হরমোন এন্ড্রোজেন এবং ডিম্ব কোষ থেকে নিঃসৃত হয় এস্ট্রোজেন। ভ্রুণের বিকাশকালে নিষিক্ত করণ ও বিভাজনের ফলে বেশকিছু অস্বাভাবিক প্যাটার্নের সৃষ্টি হয় যেমন এক্স এক্স ওয়াই অথবা এক্স ওয়াই ওয়াই। এর ফলে বিভিন্ন গঠনের হিজড়া শিশুর জন্ম হয়। যার দোষ কোন হিজড়া শিশুর নয়।
হিজড়াদের ‘বিরক্তি’ বা ‘আতঙ্ক’ হিসেবে দেখেন না এমন মানুষ হয়তো খুঁজে পাওয়া মুস্কিল।সাধারণ মানুষের চলাচলের জায়গা যেমন – পার্ক, রাস্তা ও গণ পরিবহণে রয়েছে হিজড়াদের সরব উপস্থিতি। মুখের সামনে অতর্কিতে হাত বাড়িয়ে অথবা গায়ের উপরে প্রায় পড়ি-পড়ি হয়ে,আবার নতুন অতিথি পৃথিবীতে এলে বাড়ীতে এসে তারা টাকার আবদার ধরেন এছাড়া নারী-পুরুষ বা তরুণ-তরুণীকে একত্রে পেলেই তাদেরকে হিজড়ারা স্বামী-স্ত্রী বা প্রেমিক-প্রেমিকা ঠাওরে রসালো মন্তব্য ছোঁড়েন এবং জবরদস্তিমূলক টাকা আদায় করেন। আর টাকা না দিলে অশ্লীল-অশ্রাব্য ভাষায় চেঁচামেচির ঘটনাও নিত্য ঘটছে। চাঁদাবাজি নিয়ে হিজড়াদের হাতে নাজেহাল হওয়ার ঘটনা গণমাধ্যমেও বিভিন্ন সময়ে উঠেছে এসেছে।অতএব হিজড়ারা শহরে বা আরো বৃহদার্থে বললে, আমাদের এই সমাজে একটা বিড়ম্বনার নাম তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।কিন্তু কেন হিজড়ারা এমন জীবন কেন বেছে নেয়? সেটি কি কখনো আমরা ভেবেছি?পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের সবখানে তারা কেবল অপমান, উপহাস, তাচ্ছিল্য আর নিগ্রহের শিকার।
সম্মানজনক কোনো একটি কাজ করে জীবন কাটানোর মতন একটি সামাজিক বাস্তবতা আমরা কি তৈরি করতে পেরেছি? আমরা কি এই সমাজে নিশ্চিত করতে পেরেছি হিজড়াদের সমানাধিকার?হিজড়া পরিচয়ে কোনো শিশু কি আজো স্কুলে যেতে পারবে? কোনো পরিবার কি আজো তার সন্তানকে হিজড়া হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে পারে?এই যে লোকলজ্জার সংস্কৃতি এটি নিয়ে ভাবতে হবে। নিন্দা আর লজ্জা জারি রাখার সমাজ না পাল্টালে একটি হিজড়া কিশোর ভয়-লজ্জা-আড়ষ্টতা ও হীনমন্যতা নিয়ে বড় হবে। নিজেকে ছেলে বা মেয়ে বলে সমাজে একটা ছদ্ম পরিচয় দিয়ে সে যখন বেড়ে উঠবে তখন তার মনের মধ্যে জমা হবে ক্লেদ, দুঃখ ও ব না। ফলে, সে কিছুতেই নিজেকে মূল জনস্রোতের অংশ মনে করবে না।লোকলজ্জার ভয়ে একটা সময়ে পরিবারও হিজড়া সন্তানকে ‘দায়’ মনে করেন। অতএব আত্মনির্ভরশীল হয়ে বাঁচতে হিজড়ারা খুঁজে নেয় আলাদা সমাজ। নেয় গুরু মায়ের কাছে দীক্ষা। রপ্ত করতে থাকে হাতে তালি বাজিয়ে, কোমর দুলিয়ে, মুখে মেক আপ মেখে করতে থাকে নাচ-গানের তালিম। অর্থাৎ, বেঁচে থাকার তাগিদে অনেকটা বাধ্য হয়েই হিজড়ারা নামেন যৌনকর্ম ও চাঁদাবাজির পেশায়।
হিজড়াদেরকে বাংলাদেশ সরকার তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ঠিকই। কিন্তু হিজড়াদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কোনো বদল হয়নি।এই সমাজে তারা অচ্ছুৎ। তাদের কাগজে কিছু অধিকার আছে বটে। কিন্তু বাস্তবে স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় তারা অবহেলিত।অর্থাৎ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমাদের সম্মিলিত অনুদারতাই তাদেরকে অভিশপ্ত করে রেখেছে। তাই, হিজড়াদের দোষ ধরা শুধু নয়, এখন আমাদেরকে তাদের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। তাদের জন্য প্রস্তুত করতে হবে একটি মানবিক সমাজ। যে সমাজ লৈঙ্গিক পরিচয়ের কারণে কাউকে অচ্ছুৎ করে রাখবে না। যে সমাজ হিজড়াদেরকেও নারী ও পুরুষের মতনই সমান মর্যাদায় বুকে টেনে নেবে। শুধু ভিক্ষাবৃত্তি নয়, হিজড়াদেরও চাই কর্মে যুক্ত হবার মনোবৃত্তি।
পাকিস্তানের মতন কট্টর দেশে বৃহন্নলা সংবাদ পাঠক এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন মডেল কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন। প্রতিবেশী ভারতে একজন কিন্নর এমনকি জনপ্রতিনিধি হিসেবেও নির্বাচিত হয়েছেন।অর্থাৎ নিজের যদি খেটে খাবার মানসিকতা থাকে তাহলে হিজড়াদের পক্ষেও সম্মানজনক জীবিকা বেছে নেয়া সম্ভব। হয়তো শুরুতে পথচলাটা কঠিন ঠেকতে পারে।এক্ষেত্রে, বাংলাদেশে হিজড়াদের যে সব সংগঠন আছে সেগুলোর জোরালো ভূমিকা দরকার। কী করে যৌন পেশা ও চাঁদাবাজি থেকে বেরিয়ে এসে সম্মানজনক বৃত্তি বেছে নেয়া যায় সেই দিকে তাদের এখন সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিতে হবে।হিজড়াদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। হিজড়ারা যেনো ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারে সে জন্য তাদেরকে সহজে ব্যাংক-ঋণ পাবার ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে।সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হিজড়াদেরকে যোগ্যতা অনুযায়ী ড্রাইভার, পিয়ন, রাঁধুনি থেকে শুরু করে এক্সিকিউটিভ পদে নিয়োগ দিতে পারে। এইসব নিয়োগ সমাজে দৃষ্টান্ত তৈরি করবে। এর ফলে, অন্যরাও আরো উদ্বুদ্ধ হবে। এভাবেই একটি সামগ্রিক বদল আসবে।
কিন্তু তার আগে মানুষের ইচ্ছেকে আমাদের সম্মান জানাতে পারার সংস্কৃতি ও একটি উদার সমাজ নির্মাণ প্রয়োজন। যেখানে লিঙ্গ-বৈষম্যের শিকার হবে না নারী বা পুরুষ বা হিজড়া। যেখানে লিঙ্গ-পরিচয় ব্যতিরকেই একজন মানুষ পাবেন সুযোগ ও সম্মান।