রাশিয়া বিশ্বকাপের ব্যর্থতার গল্প
ফিফা বিশ্বকাপ একটি আন্তর্জাতিক ফুটবল প্রতিযোগিতা যেখানে ফিফা সহযোগী দেশগুলোর পুরুষ জাতীয় ফুটবল দল অংশ নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ১৯৪২ ও ১৯৪৬ সালে এই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়নি। এছাড়া ১৯৩০ সালে এই প্রতিযোগিতা শুরু হয় এবং এখন পর্যন্ত চার বছর পর পর অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সর্বশেষ ২২তম আসর অনুষ্ঠিত হয়েছে রাশিয়ায়। অদ্ভুত এক প্রতিযোগিতা মূলক অনুষ্ঠান ফিফা বিশ্বকাপ। প্রতিযোগিতার বর্তমান ধরন অনুযায়ী ৩২টি জাতীয় দল চূড়ান্ত পর্বে অংশ নেয়। আয়োজক দেশে প্রায় একমাস ধরে এই চূড়ান্ত পর্বের প্রতিযোগিতা চলে। দর্শক সংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বকাপ মূল পর্ব বিশ্বের বৃহত্তম অনুষ্ঠান।
বিশ্বকাপ হলো তারকাদের নিজেদের প্রমাণ করার সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম। এখানে ভালো করে নিজের ভবিষ্যৎ আরও উজ্জ্বল করার তথা ইতিহাসে নিজের নাম লিপিবদ্ধ করার সুবর্ণ সুযোগ। কেউ সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজেকে উপরে তোলেন, আবার কেউবা প্রত্যাশামতো না খেলতে পেরে অবস্থান হারিয়ে ফেলেন। বিশ্বকাপ এমন একটি প্রতিযোগিতার মঞ্চ যেখানে প্রতিটি দল তাদের সেরা খেলোয়াড়দের উপর নির্ভরশীল। আর তাদের সেই সেরা খেলোয়াড় যদি হতাশ করে তাহলে তার থেকে খারাপ কিছু হতে পারে না। আর স্বভাবতই এবারের বিশ্বকাপেও এমন অনেক সেরা খেলোয়াড় তাদের স্বভাবসুলব খেলা খেলতে পারে নাই। দল হিসেবে রাশিয়া বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতার গল্পটি লিখেছে মনে হয় জার্মানি। অন্যতম ফেভারিট দল হিসাবেই রাশিয়ায় গিয়েছিল জার্মানরা। জোয়াকিম লোর অধীনে তাদের ‘পেন্টা’ জয়ের পথচলা থেমে যায় প্রথম রাউন্ডেই। গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচেই ধাক্কা খায় দলটি। প্রথম ম্যাচে মেক্সিকোর কাছে হেরে বসে ১-০ গোলে। দ্বিতীয় ম্যাচে সুইডেনের বিপক্ষে জিতলেও শেষ ম্যাচে দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে হেরে যায় ২-০ গোলে। আর এখানেই শেষ হয়ে যায় ২০১৪ সালের চ্যাম্পিয়নদের বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন। ৮২ বছর পর বিশ্বকাপের প্রথম পর্ব থেকে বিদায় নেয় প্রবল পরাক্রম জার্মানি।
‘টিকি টাকা’ ধারার ফুটবল খেলে স্পেন ফুটবল দিয়েই শাসন করেছে বিশ্ব। রাশিয়ার বিশ্বকাপেও সোনালি প্রজন্মের ফুটবলারদের নিয়ে আবার বিশ্বজয় করতে আসে দলটি। কিন্তু শেষ ষোলতে স্বাগতিক রাশিয়ার কাছে হেরে দেশে ফিরতে হয় স্প্যানিশদের।
খেলোয়াড়দের মধ্যেও হতাশ করেছে অনেকে। এদের মধ্যে রয়েছে জেরোম বোয়াটেং, রবার্ট লেভানডস্কি, অলিভিয়েঁ জিরুঁ, টমাস মুলার এর মতো তারকারা এর মধ্যে রয়েছে।
তবে রাশিয়া বিশ্বকাপে গোলকিপারদের মধ্যে সময়ের সেরা গোলকিপার খেতাব নিয়েই এসেছিলেন স্পেনের “ডেভিড ডি হেয়া”।
ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে দুর্দান্ত মৌসুম কাটিয়েছেন তিনি। ক্লাবের চেয়ে অপেক্ষাকৃত ভালো ডিফেন্ডার নিয়েই খেলতে এসেছিলেন বিশ্বকাপে। রামোস,পিকে নাচো আর কারভাহাল এর মতো খেলোয়াড় থাকা সত্ত্বেও হতাশ করেছেন স্প্যানিশদের। একের পর এক দুর্দান্ত সব সেভ তাকে বানিয়ে দিয়েছিলো বর্তমান ফুটবলের সেরা গোলরক্ষক। অথচ এইবারের বিশ্বকাপে এসে তিনি পারেননি একটি পেনাল্টিও ঠেকাতে। আর তাই তো বিশ্বকাপে স্পেনের সাথে তিনিও যে মাথা নিচু করে বিদায় নিলেন।
ফেবারিট তকমা না নিয়ে আসলেও এইবারের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার রক্ষনভাগ যার উপর ভরসা করে ছিল তার নাম “নিকোলাস অটামেন্ডি”।
ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে ম্যানচেস্টার সিটির রক্ষনভাগ সামলানোর মতো দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল নিকোলাস অটামেন্ডিকে। আইসল্যান্ড, ক্রোয়েশিয়া এবং ফ্রান্স এর বিপক্ষে গোল খাওয়ার পিছনে অটামেন্ডিও অনেকাংশে দায়ী। তিনি ভেসে চললেন ব্যার্থতার স্রোতে। যদিও নিকোলাস অটামেন্ডির কাছে এমন পারফরম্যান্স মোটেও কাম্য ছিলো না।
আর্জেন্টিনার আরেক ভরসার প্রতীক ছিলো “হাভিয়ের মাশ্চেরানো”।
বয়স তার ৩৪ এর কোঠায়। রাশিয়া বিশ্বকাপ ছিলো তার শেষ বিশ্বকাপ। গত বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ড এর আরিয়ান রোবেনের নিশ্চিত গোল থেকে দলকে বাঁচিয়েছিলেন। এই বিশ্বকাপেও যুদ্ধ করতে নেমেছিলেন। কিন্তু ফিরলেন আর্জেন্টিনার কালো স্মৃতি হয়ে। যদিও তিনি এই বিশ্বকাপে ব্যার্থ তবুও তিনি চেষ্টা করেছিলেন তার সর্বোচ্চটুকু দেবার।
“টমাস মুলার” জার্মানীর হয়ে গত দুই বিশ্বকাপ কাঁপানো খেলোয়াড়।
শেষ দুই বিশ্বকাপ জ্বলে ওঠা টমাস মুলারকে নিয়ে জার্মানীর অনেক আশা ছিলো। কিন্তু উল্টো তিনি সবার আশার প্রদীপ নিভিয়ে দিয়েছেন। গত দুই বিশ্বকাপে ১০ গোল করা মুলার পারেননি এই বিশ্বকাপে কোনো অ্যাসিস্ট করতে। গোল করা তো দূরের কথা।
হেক্সা মিশন পূরণ করতেই এইবার রাশিয়া এসেছিলো পাঁচবারের বিশ্বকাপ জয়ী ব্রাজিল। আর তাদের নাম্বার নাইন ছিলো “গ্যাব্রিয়েল জেসুস”।
লিগ এবং চ্যাম্পিয়নস লিগ মিলিয়ে ১৯ গোল করা গ্যাব্রিয়েল জেসুস ছিলেন মৌসুমের বেশ সময়টা ইনজুরির কারনে মাঠের বাইরে। শুধু কোচ তিতেই নয়, খোদ ব্রাজিলিয়ানসহ সকল ফুটবল প্রেমীরাই ভেবেছিলেন এই ইয়াংস্টার হয়ত এইবারের বিশ্বকাপে কোনো ভালো কিছু সময় উপহার দেবে। কিন্তু বিধিবাম তিনিও চললেন সময়ের স্রোতে। নেইমার কুতিনহোর বানানো একের পর এক সুযোগ তিনি নষ্ট করেছেন। ফিরমিনোর মতো গোলস্কোরারকে বেঞ্চে বসিয়ে তিতে বারবার সুযোগ দিয়েছিলেন গ্যাব্রিয়েল জেসুসকে। কিন্তু ৫ ম্যাচেই সুযোগ পাওয়া গ্যাব্রিয়েল জেসুস পারেননি সুযোগ কাজে লাগাতে। ৫ ম্যাচ সুযোগ পেয়ে জেসুস অ্যাসিস্ট করেছেন ১টি আর গোলের সংখ্যা ০। আর তাই তো রাশিয়া বিশ্বকাপে ফ্লপ স্ট্রাইকারদের তালিকায় তিনি অন্যতম।
বায়ার্ন মিউনিখের স্ট্রাইকার “রবার্ত লেভানডস্কিকে“ বিশ্বকাপের সবচেয়ে উদিয়মান তারকা ভাবা হচ্ছিলো, কিন্তু তিনি প্রত্যাশার ছিটেফোঁটাও দেখাতে পারেন নি। এবার তার চেয়ে বেশি হতাশাজনক বিশ্বকাপ মনে হয়না আর কারও কেটেছে।
অথচ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বের ১০ ম্যাচে ১৬ গোল করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন পোল্যান্ডের সেরা তারকা লেভানডস্কি। বাছাইপর্বে তার সমান গোলের দেখা পাননি মেসি, রোনালদো, কাভানি, সানচেজ কিংবা লুকাকুর মতো তারকারাও। বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে তার নামের পাশে দু’টি বড় আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে ২ গোলের রেকর্ড ছিল, বিশ্বকাপ শেষেও তার নামের পাশে ওই ২ গোলই রয়ে গেছে। সেনেগাল, কলম্বিয়া ও জাপানের বিপক্ষে কোন গোলের দেখা তো পাননি তিনি।
সবচেয়ে চিন্তার বিষয়, তাকে তার স্বাভাবিক খেলার ধারে কাছেও দেখা যায়নি। তিন ম্যাচে দলের জন্য গোলের তেমন কোন সুযোগও তৈরি করতে দেখা যায়নি তাকে। বিশ্বকাপের আগে তাকে দলে নিতে চেলসি ও রিয়াল মাদ্রিদের মতো ক্লাবের আগ্রহ ছিল দেখার মতো। কিন্তু বিশ্বকাপের ব্যর্থতা তার সেই সম্ভাবনা শেষ করে দিয়েছে বলেই মনে হচ্ছে।