মীর জাফর ও তার সঙ্গীদের শেষ পরিণতি
বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা তার বিশ্বস্তজনদের হাতে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করেন। তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত ছিলেন মীরজাফর। যে নাম আজও বাংলায় বিশ্বাস ঘাতকতার গালি হিসেবে প্রচলিত। এই বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর ও তার সঙ্গীদের যে নির্মম পরিণতি হয়েছিল তা শুনলে যে কারো গায়ে কাঁটা দিবে! বাংলাকে পরাধীন করা সেই বিশ্বাস ঘাতকদের শেষ পরিণতি সম্পর্কে আজ বলব।
নবাব আলীবর্দী খান ছিলেন সিরাজউদ্দৌলার নানা। তিনি সিরাজকে অস্ত্র বিদ্যার কলা-কৌশলই শুধু নয় রাজ্য পরিচালনার বিষয়েও প্রয়োজনীয় শিক্ষা দান করেছিলেন। সিরাজ যেন তার অনুপস্থিতিতে রাজ্য পরিচালনা করতে পারেন। বর্গী হামলার বিরুদ্ধে নানার সঙ্গে থেকে সিরাজ তাদের আক্রমণ স্থগিত করে রাজ্যের মানুষের জীবনে সুখ শান্তি এনে দিয়েছিলেন। আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পর সিরাজকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করার জন্য ইংরেজদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত ঘটান মীর জাফর। আর সেই ষড়যন্ত্রে যথারীতি শামিল ছিলো সিরাজের কয়েকজন আত্মীয়-স্বজন।
মীর জাফর পুত্র মীরনের বাড়িতে বসে ষড়যন্ত্রকারীরা ১৯৫৭ সালে একটি চুক্তিনামা সম্পাদন করে। এমন কি চুক্তিনামায় উল্লেখ করা হয় সিরাজকে হত্যা করে সিংহাসন ছিনিয়ে নেয়া হবে যুদ্ধের মাধ্যমে। সে যুদ্ধে ইংরেজদের বিরুদ্ধে মীর জাফর কোন যুদ্ধ করবে না। তাদের সৈন্য সামন্ত ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবে। সিরাজের পতনের পর মসনদের নবাব হবে মীর জাফর। সিপাহসালার পদ দেয়া হবে রায়দূর্লভকে। জগঠ শেঠ পাবেন অনেক অর্থ। উমিঁ চাদকে দেয়া হবে ২০ লাখ টাকা। অন্যান্য যারা আছেন তাদের মধ্যে ইয়ার লতিব খাঁ, নন্দ কুমারকে দেয়া হবে অন্যান্য সুযোগ সুবিধা। আর ক্লাইভ পাবেন একটি গ্রামের জমিদারিসহ রাজকোষের কোটি টাকা। ইংরেজ বেনিয়াদের নেতা ওয়াটসন, ওয়াটস, হলওয়েলস অন্যরা পাবে নানা জাতীয় সুবিধা। মীর জাফর পুত্র মীরন হবেন নবাব পুত্র।
ঘসেটি বেগম আপন খালা স্বত্তেও সিরাজের অপসারণ এমন কি হত্যা করার ষড়যন্ত্রে বরাবরই লিপ্ত ছিলেন। সিরাজউদ্দৌলার সিংহাসনে বসার মাত্র এক বছর পর মীর জাফরের নেতৃত্বে তাকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র করা হয়। এ জন্য পলাশীর আমবাগানে ২৩ জুন ১৭৫৭ সালে ষড়যন্ত্রের যুদ্ধ সংগঠিত হয়। এ যুদ্ধে সিরাজ বাহিনীর পক্ষে ৫৩ হাজার সৈনিক ও বিপুল অস্ত্র ছিল। আর ইংরেজ বাহিনীর ছিল মাত্র তিন হাজার সিপাহি। মীর জাফরের নেতৃত্বে সিরাজ বাহিনীর কামান ও বন্ধুক থেকে কোন গুলি বের হল না। মোহন লাল, মীর মদন, বন্দে আলী, সাফ্রেসহ মাত্র কয়েক জন নিম্ন পদস্থ সেনাপতি প্রাণপণে যুদ্ধ করেন।
ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে মাত্র দু’দিনের যুদ্ধে সিরাজ বাহিনী মীর জাফর গংদের বেঈমানির ফলে পরাজিত হল। ১৯৫৭ সালের ২ জুলাই সিরাজকে কারাগারে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব চলে গেল ঐ নিষ্ঠুর ইংরেজদের হাতে। তবে আল্লাহ তালার পক্ষ থকে দুনিয়াতে সব সময় বেঈমানদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়। তার প্রমান আজকে এই বেঈমানদের শেষ পরিনতির কথা শুনলেই বুঝতে পারবেন।
যেভাবে বিশ্বাসঘাতকদের মৃত্যু হয়ঃ. সিরাজকে হত্যার পর ইংরেজরা মীর জাফরকে সিংহাসনে বসায়। তবে তা ছিল তাদের অধীনস্ত কর্মচারির মতো। ইতিহাসে তাদের বলা হয় ‘ক্লাইভের গাধা’। চার বছর তাকে নবাব পদে রাখা হয়েছিল। আবার দুর্নীতির জন্য দুই বছর বহিষ্কার করা হয়। কুষ্ঠ রোগে আক্রন্ত হয়ে মীর জাফরের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। তার শরীরে অসংখ্য ঘাঁ ও ফোড়া হয়ে রক্ত ও পুজ পড়ে এবং দুর্গন্ধ বের হয়। এ অবস্থায় পরিবারের লোকজন তাকে লোকালয়হীন জঙ্গলে রেখে আসে। বাঁচানোর আশায় রাজা নন্দ কুমার কিরিটেশ্বরী দেবীর পা ধোঁয়া পানি ঔষুধ হিসেবে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করে। তবুও আরোগ্য লাভ না করে মৃত্যু জ্বালায় ধুঁকতে ধুঁকতে প্রাণ যায় মীর জাফরের।
বাংলার মানুষ বেঈমান বলতে মীর জাফর নামকে যুগ যুগ ধরে ব্যবহার করে আসছে। মীর জাফরের পুত্র মীরন সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যার থেকে শুরু করে বহু অপকর্মের নায়ক। ঐতিহাসিকরা বলেন, তিনি বজ্রাঘাতে মৃত্যুবরণ করেন। আবার কেউ কেউ বলেন জনৈক ইংরেজ সেনাপতি তার বাড়াবাড়ি দেখে গুলি করে হত্যা করেছে। জগঠ শেঠকে দূর্গের চূড়া থেকে গঙ্গায় নিক্ষেপ করা হয়। রায় দূর্লভ কে যুদ্ধের পর কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। ওই কারাগারেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। উমি চাঁদ যুদ্ধের পর ক্লাইভ কর্তৃক প্রতারিত হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে মারা যান।
রাজা রাজ বল্লভ পদ্মায় ডুবে আকস্মিক মৃত্যুবরণ করেন। মীর জাফরকে ক্ষমতাচ্যুত করে মীর কাসেম ক্ষমতা দখল করেন। পরে ইংরেজদের সঙ্গে তার বিরোধের জের ধরে বক্সারের যুদ্ধে পরাজিত হন। এরপর তিনি পালিয়ে বেড়ান। অজ্ঞাতনামা অনুসারে দিল্লিতে তার করুন মৃত্যু হয়। তার মাথার কাছে পড়ে থাকা একটি ব্যাগে পাওয়া যায় নবাব মীর জাফর কর্তৃক ব্যবহৃত চাফগান। ইয়ার লতিফ খাঁন যুদ্ধের পর হঠাৎ করে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। ধারণা করা হয়, তাকে যুদ্ধের পর মেরে ফেলা হয়েছিল। নন্দ কুমার বিভিন্ন অপকর্মের জন্য ফাসিঁ কাষ্ঠে মৃত্যুবরণ করেন। সিরাজউদ্দৌলার খালা ঘসেটি বেগমকে মীরনের নির্দেশে নৌকা ডুবিয়ে হত্যা করা হয়। সিরাজের হত্যাকারী মোহাম্মাদী বেগ মাথা খারাপ অবস্থায় বিনা কারনে কূপে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। তাই বলা হয়ে থাকে, বিশ্বাসঘাতকতার পরিনাম কখনও শুভ হয় না। এর পরিনাম করুন ও মর্মান্তিক হয়।