সাতক্ষীরা থেকে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে বাবুই পাখির বাসা
‘বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই, কুঁড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই! আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকার পরে, তুমি কত কষ্ট পাও রোদ বৃষ্টি ঝড়ে। পাকা হোক তবু ভাই পরের বাসা, নিচ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর খাসা।’ কবি রজনীকান্ত সেন এই কালজয়ী কবিতাটি এখনও অধিকাংশ মানুষের মুখে মুখে। দেশের এক সময়ের নজরকাড়া বাবুই পাখিকে নিয়ে কবির ‘স্বাধীনতার সুখ’ কবিতাটি আজো মানুষ উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করলেও হারিয়ে যেতে বসেছে বাবুই পাখি ও তার বাসা। বাবুই পাখির বাসা আজ অনেকটা স্মৃতির অন্তরালে বিলীন হতে চলেছে। অথচ আজ থেকে প্রায় ১৫/১৬ বছর আগেও গ্রাম-গঞ্জের মাঠে ঘাটের তাল গাছে দেখা যেত বাবুই পাখির নিপুণ কারু খচিত তৈরি বাসা সেটি আজ হারিয়ে যেতে বসেছে।
সাতক্ষীরা জেলার ৮টি উপজেলার আশপাশ এলাকার বিভিন্ন গ্রামে এখন আর আগের মত বাবুই পাখির নিপুণ কারুখচিত তৈরি করা নজরকাড়া বাসা চোখে পড়ে না। এসব বাসা শুধু শৈল্পিক নিদর্শনই ছিল না, মানুষের মনে চিন্তার খোরাক জাগ্রত করতো এবং স্বাবলম্বী হতে উৎসাহিত করত। সময়ের বিবর্তনে ও পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে আজ এ পাখিটি আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যেতে চলেছে।
দৃষ্টিকাড়া গাছের ঝুড়ির মতো চমৎকার বাসা বুনে বাস করায় এ পাখির পরিচিতি বিশ্ব জোড়া। নারিকেল গাছের কচি পাতা, খড়, তালপাতা, খেজুর গাছের পাতা দিয়ে উঁচু তালগাছে বাসা তৈরি করে এই বাবুই পাখি। প্রবল ঝড়েও তাদের বাসা ভেঙ্গে পড়ে না। বাবুই পাখির নিখুঁত বুননে এ বাসা টেনেও ছেঁড়া কষ্টকর। এ জন্য অনেকেই একে তাঁতি পাখি বলে ডেকে থাকে।
বাবুই পাখির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো রাতের বেলায় ঘর আলোকিত করতে জোনাকি পোকা ধরে নিয়ে বাসায় রাখে এবং সকাল হলে ছেড়ে দেয়। একটি বাসা তৈরি করার পর পুরুষ বাবুই সঙ্গীর খোঁজে নামে। সঙ্গী পছন্দ হলে স্ত্রী বাবুই পাখিকে সাঙ্গি বানানোর জন্য পুরুষ বাবুই নিজেকে আকর্ষণীয় করতে খাল, বিল ও ডোবায় পানিতে গোসল এবং গাছের ডালে ডালে নেচে নেচে বেড়ায়।
প্রজনন সময় ছাড়া অন্য সময় পুরুষ ও স্ত্রী বাবুই পাখির গায়ে পিঠে তামাটে কালো কালো বর্ণের দাগ হয়। নিচের দিকে কোন দাগ থাকে না। ঠোঁট পুরো মোসাকার ও লেজ চৌকা। তবে প্রজনন ঋতুতে পুরুষ পাখির রং হয় গাঢ় বাদামি। বুকের ওপরের দিকটা হয় ফ্যাকাসে; অন্য সময় পুরুষ ও স্ত্রী বাবুই পাখির পিঠের পালকের মতই বাদামি হয়।
এক সময় সাতক্ষীরা জেলার মথুরেশপুর,নিজদেবপুর,রায়পুর,দুদলী,বসন্তপুরসহ,বাশদহা ,বসুখালী ,আশাশুনি বিভিন্ন গ্রামের মাঠে মাঠে দেখা যেত শত শত বাবুই পাখির বাসা। বর্তমানে যেমন তালগাছসহ বিভিন্ন গাছ নির্বিচারে কেটে ফেলা হচ্ছে, তেমনি হারিয়ে যাচ্ছে বাবুই পাখি ও তার বাসা। বাবুই পাখির এ দৃষ্টি নন্দিত শৈল্পিক নিদর্শনকে টিকিয়ে রাখার জন্য সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার বলে জানিয়েছেন পরিবেশবিদরা।
সাতক্ষীরা কালিগঞ্জ উপজেলার মথুরেশপুর ইউনিয়নের নিত্যানন্দপুর ও নিজদেবপুর গ্রামের হারুন আর রশিদ ও মিজানুর রহমান জানান, আমাদের মাঠের জমিতে রয়েছে উঁচু তালগাছ। সেখানে ১৫/১৬ বছর আগে বাবুই পাখি বাসা বেঁধে থাকত। আমরা লাঙ্গল চষতে যেতাম আর দেখতাম ছোট ছোট পাখি তাল গাছের ঝুলন্ত পাতার সাথে নিখুঁতভাবে বাসা বুনে থাকত, যা দেখে খুব ভাল লাগতো। কিন্তু এখনও তালগাছ আছে কিন্তু নেই বাবুই পাখির সেই বাসা। বাবুই পাখি সাধারণত তাল, খেজুর, নারকেল ও আখ ক্ষেতে বাসা বাঁধে। ধান, চাল, গম ও পোকা-মাকড় ইত্যাদি এদের প্রধান খাবার।
এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা সরকারি মহিলা কলেজের সহকারি বাংলা প্রভাষক সিরাজুল ইসলাম বলেন,বসবাসের মতো উপযোগি পরিবেশ না হওয়ার কারণে ও আবহাওয়া অনুকুলে না থাকার কারণে আমারা বাবুই পাখির বাসা আমাদের মাঝ থেকে দিনদিন হারিয়ে যাচ্ছে । তিনি আরও বলেন ,মানুষ এখন নির্বিচারে গাছপালা কেটে বসবাসের স্থান তৈরি করছে । আর বাবুই পাখির বাসা হারিয়ে যাওয়ার এটা ও একটি অন্যতম কারণ ।
এ ব্যাপারে জেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা সমরেশ চন্দ্র দাশ বলেন,বাবুই পাখির বসবাসের মতো স্থান বা পরিবেশ না থাকার কারণে বাবুই পাখির বাসা আর চোখে মেলে না ।