সাতক্ষীরায় দেখা মিলছে না গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য বায়োস্কোপ
সারা বাংলাদেশের ন্যায় সাতক্ষীরায় ও হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য বায়োস্কোপ। কাঠের বাক্সে চোখ লাগিয়ে গানের তালে ছবি দেখার দৃশ্য গ্রামজীবনে আর চোখেই পড়ে না। খঞ্জনী আর গানের তালে বাক্সের ভেতর পাল্টে যায় ছবি। আর তা দেখে যেন গল্পের জগতে হারিয়ে যায় ছেলে, বুড়ো,কিশোর-কিশোরী সবাই।বর্তমান সময়ে গ্রাম বাংলায় বায়োস্কোপ এমনই বিরল যে, যাদুঘরে রেখে দেয়ার জন্যও অন্তত একটি বায়োস্কোপ কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিশেষ করে গ্রাম বাংলার জনপদে বেড়ে উঠা মানুষকেতো বটেই। তবে যারা শহরের চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি জীবন যাপন করে অভ্যস্থ কিংবা যাদের জন্ম এই মাত্র একযুগ আগে তাদের কাছে হয়তো হাস্যকর এক বোকা বাক্সো মনে হবে। কিন্তু বায়োস্কোপ মোটেও হাস্যকর কোন বস্ত ছিলো না, কিংবা ছিলো না কোন বোকা বাক্সোও!প্রকৃতপক্ষে বায়োস্কোপ গ্রাম বাংলার সিনেমা হল।
রঙ-বেরঙের কাপড় পরে, হাতে ঝুনঝুনি বাজিয়ে বিভিন্ন রকমের আলোচিত ধারা বর্ণনা করতে করতে ছুটে চলতো গ্রামের স্কুল কিংবা সরু রাস্তা ধরে। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো তার পেছন পেছন বিভোর স্বপ্ন নিয়ে দৌড়াতো গ্রামের ছেলে মেয়েরা। বায়োস্কোপওয়ালার এমন ছন্দময় ধারা বর্ণনায় আকর্ষিত হয়ে ঘর ছেড়ে গ্রামের নারী পুরুষ ছুটে আসতো বায়োস্কোপের কাছে। একসাথে সকলে ভিড় জমালেও তিন কি চার জনের বেশী একসাথে দেখতে না পারায় অপেক্ষা করতে হতো।সিনেমা হলের মতো এক শো এরপর আবার আর তিন বা চারজন নিয়ে শুরু হতো বায়োস্কোপ।বায়োস্কোপ দেখানো শুরু করলেই ‘কি চমৎকার দেখা গেলো’ বলে ফের শুরু হতো বায়োস্কোপওয়ালার ধারা বিবরণী। আর এই বায়োস্কোপ দেখানোর বিনিময়ে দু’মুঠো চাল কিংবা ২টাকা নিয়েই মহা খুশি হয়ে ফিরে যেতো একজন বায়োস্কোপওয়ালা।
কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে বাংলার সুস্থ বিনোদনের এই লোকজ মাধ্যমটি। টিভি আর আকাশ সংস্কৃতি স্যাটেলাইটের সহজলভ্যতার কারণে আপনা আপনিই উঠে গেছে বায়োস্কোপ। বায়োস্কোপ প্রদর্শনের বিষয় বস্তু সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবর্তন আনা হয়েছে। আগে বিভিন্ন প্রেম কাহিনী, তারপর যুদ্ধ, বিশ্বের দর্শনীয় স্থান, ধর্মীয় বিষয় ও রাষ্ট্রনায়কদের নিয়ে বায়োস্কোপ প্রদর্শন করা হয়। এ জন্য তাদেরকে অনেক বেশি জানতে হয়। তার পর সেটা প্রদর্শনের সময় এক এক করে ছন্দ মিলিয়ে বলতে হয়। তাহলেই দর্শক বায়োস্কোপ দেখতে আগ্রহী হয়। এক সঙ্গে ৩-৪ জন দর্শক বায়োস্কোপ দেখতে পারে।
ঘরে ঘরে টেলিভিশন ও হাতে মোবাইল ফোন চলে আসায় এখন আর আগের মতো এর প্রতি দর্শকদের চাহিদা নেই বললে চলে। তবে অনেকেই কৌতুহল নিয়ে এটি দেখতে এগিয়ে আসেন শহর থেকে বাড়ি আশা গ্রাম গঞ্জের কিশোর-কিশোরী ও যুবক যুবতিরা। একটা বাক্সো, তার বাহির দিয়ে মুড়ির টিনের মতোন একাধিক খুপড়ি; এইসব ছোট ছোট খুপড়ির ভেতর দিয়ে চোখ লাগিয়ে মানুষ যখন দেখতো কোন্ দূরের দিল্লী শহর, রাম-লক্ষণের যুদ্ধ, ক্ষুদিরামের ফাঁসি, আফগানদের যুদ্ধ, মক্কা নগরী, শেখ মুজিবের ছবিসহ সময়ের অসংখ্য আলোচিত ঘটনার রঙ্গিনসব ছবি, আর অজানা এক কারণে শিহরণ অনুভব করতো, প্রণোদিত হতো, আন্ন্দীত হতো তখনকার মানুষ। কারণ, বর্তমান সময়ের মতো মানুষের ঘরে ঘরে টিভি ছিলো না, হাতে হাতে মোবাইল ছিলো না, আকাশ সংস্কৃতি বলে কোনো বিষয়ও ছিলো না। গ্রামগঞ্জে সমানভাবে এক চেটিয়া বায়োস্কোপওয়ালাদের রাজ চলতো। তবু আধুনিক মাল্টি মিডিয়ার যুগে বায়োস্কোপ আগের মতো আর দর্শক টানতে পারছে না।
যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বায়োস্কোপেও ছবি পাল্টান, নতুনত্ব নেই। ‘কী চমৎকার দেখা গেলে এইবারেতে আইসা গেল, ঢাকার শহর দেখেন ভালো। কী চমৎকার দেখা গেল।’ এভাবেই বায়োস্কোপের কাঁচের জানালায় চোখ রাখলে ছবি আর বর্ণনায় জীবন্ত হয়ে উঠে অজানা পৃথিবী।
কালিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী তথ্য প্রযুক্তি লীগের সভাপতি মাসুদ পারভেজ ক্যাপ্টেন বলেন,বাঙ্গালী সংস্কৃতি ও বিনোদন মাধ্যমের একটি চিরচেনা বায়োস্কোপ নামের সঙ্গে পরিচয় থাকলেও এটিকে দেখার সুযোগ হয়ে উঠেনি। কারন আধুনিক প্রযুক্তির উত্তকর্ষ সাধনের ফলে বিনোদন মাধ্যম গুলো প্রত্যেকের হাতে মুঠোয় চলে আসায় বায়োস্কোপের কলাকোশলীরা এ পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্যসব পেশায় জড়িয়ে পড়েছেন।
এ বিষয়ে সাতক্ষীরা জেলার তথ্য অফিসার মোজাম্মের হক বলেন, ফিল্মের দুষ্মপ্রাপ্যর কারণে এগুলো হারিয়ে গেছে । তাছাড়া প্রজেক্টর আসার কারণে মানুষের কাছে বায়োস্কোপের গ্রহণ যোগ্যতা কমে গেছে । টিভি আর আকাশ সংস্কৃতি স্যাটেলাইটের সহজলভ্যতার কারণে মানুষ সব গুলো সহজ ভাবে পেয়ে যায় । এই কারণে বাইস্কোপের প্রতি তাদের যে টান ছিলো তা আজ আর অনুভব করছেনা ।