কথার জাদুকর আব্দুস সবুর খান চৌধুরী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, হাওয়া খেলে পেট ভরে না কিন্তু আহারাদি হজম করতে হলে হাওয়া খাওয়া আবশ্যক। তেমনি চিন্তাশীল, মননশীল, সৃজনীশক্তি সম্পন্ন মানুষ হয়ে উঠতে হলে লেখাপড়ার পাশাপাশি সংস্কৃতি চর্চারও প্রয়োজন আছে। সংস্কৃতি চর্চা মানুষের মনকে হিংসা, বিদ্বেষ, লোভ, ক্ষোভ, অন্ধকার, অন্ধতা থেকে শুদ্ধ করে।’ বলা যায়, ‘সৃষ্টিশীলতা, মননশীলতা, ভালোলাগা- এসব মিলিয়ে মানুষকে পরিপূর্ণ করে তোলে সংস্কৃতি চর্চা। যারা পড়াশোনার পাশাপাশি সহ-শিক্ষা কার্যক্রম যেমন, খেলাধুলা, বিতর্ক, গান প্রভৃতির চর্চা করে তারা দেশ ও মানুষকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি ভাবেন। তারা এভাবেই ভালো মানুষ হয়ে ওঠেন।’
তেমনি একজন মানুষকে নিয়ে আলোচনা শুরুর আগে একটি কথা বলে নেওয়া দরকার যে সংস্কৃতি বলতে সাহিত্য, শিল্প, সংগীত, নৃত্য, নাটক ইত্যাদির ষোলকলাই বোঝায় না সেই সঙ্গে ব্যক্তি ও সমাজজীবনের বৈচিত্রময় বহুভঙ্গিম রূপের প্রকাশও বোঝায়। সংস্কৃতির যেমন রয়েছে বিনোদনের নানা দিক তেমনি সামাজিক অঙ্গীকার ও দায় পালনেরও বিশেষ দিক। লেখক-শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীর গরিষ্ঠ অংশ তাই সামাজিক দায়বদ্ধতায় বিশ্বাসী। এমন দুই বিপরীত দিক নিয়ে সংস্কৃতি চর্চার পথচলা।
সমাজ ও সংস্কৃতির পারস্পরিকতার কারণে মুক্ত সংস্কৃতির সুস্থ চর্চা সামাজিক অগ্রগতির সহায়ক। ঠিক বিপরীত বিবেচনায় সামাজিক রক্ষণশীলতার কট্টর প্রভাব প্রগতিশীল সংস্কৃতি চর্চার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তবে আত্মবিশ্বাসী ও যুক্তিবাদী লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, গণসংগীত শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস এর মতো কথা জাদুকর নামে খ্যাত আব্দুস সবুর খান চৌধুরীও এসব বাধা অগ্রাহ্য করে প্রগতিশীল সংস্কৃতি চর্চা অব্যাহত রেখেছেন।
প্রগতিশীল সংস্কৃতি চর্চা যদিও নির্দিষ্ট আদর্শভিত্তিক তবু এর মূল লক্ষ্য ছিল ফ্যাসিস্ট-বিরোধী, যুদ্ধবিরোধী, শান্তিবাদী ও উদার মানবিক চেতনার গণতন্ত্রীদের এক মঞ্চে সংঘবদ্ধ করা। এ লক্ষ্যে তারা সাময়িক সাফল্য অর্জন করেন। এ সাফল্য ছিল সাহিত্যে, সংগীতে, বিশেষভাবে গণসংগীতে ও মঞ্চ নাটকের মতো বিভিন্ন ধারায়। তাই তো লতিফা খান চৌধুরী পরিচালিত অগ্রদূত সংঘ এবং প্রগতিশীল নাট্য সংগঠন কল্লোল এর প্রতিনিধি হয়ে ষাট এর দশকে সংস্কৃতি চর্চায় এক অন্যান্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন তিনি। গ্রাম-গঞ্জের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি গণসঙ্গীতও পরিবেশন করতেন। সে ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে আজও বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন সহ বাংলাদেশ বেতার ও ঢাকা ৯৯ এফএম এ সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে সকল পাঠকের মনের ক্ষুধা নিবারণের চেষ্টা করছেন তিনি। পাশাপাশি পিআইবি, কন্ঠশীলন, কল্পরেখা, ছায়ানট সহ প্রায় অর্ধ শতাধিক সংগঠনে প্রশিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন কথা জাদুকর নামে খ্যাত আব্দুস সবুর খান চৌধুরী।
তাঁর শৈশব কেটেছে সাতক্ষীরায়, সেখান থেকেই গান গাওয়া শুরু। তাই সাতক্ষীরা থেকে সুনামগঞ্জ, কুতুবদিয়া থেকে তেঁতুলিয়া পেরিয়ে আত্মজার্তিক পরিমণ্ডলে জন মানুষের মনের গভীরে সহজেই প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছেন কথা জাদুকর আব্দুস সবুর খান চৌধুরী (পিনু)। যার ডাকনাম মাস্টার পিনু। তিনি একাধারে উপস্থাপক, সঙ্গীত শিল্পী, আবৃত্তিশিল্পী, পাণ্ডুলিপি প্রস্তুতকারক, প্রযোজক ও সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত রয়েছেন। তিনি প্রকৃতি প্রদত্ত শক্তির প্রভাবে ধীরে ধীরে সঙ্গীত রপ্ত করেছিলেন। তাই সঙ্গীত শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য কোন ওস্তাদের শরণাপন্ন হতে হয়নি কখনও।
স্কুল ও কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান পরিবেশনের মাধ্যমে সল্প সময়ে অধিকতর সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন তিনি। তাই সহপাঠী, শিক্ষক-শিক্ষিকা সহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ তাকে মাস্টার পিনু বলে ডেকে মজা পেতেন। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে তরুণ প্রজম্মের ছেলে-মেয়ে সেই নামের মানুষটিকে ভুলতে বসলেও এ লেখার মাধ্যমে সকলে জানতে পারবে।
সাতক্ষীরা কলেজ থেকে আইএসসি পরীক্ষা দিয়ে চট্টগ্রামে চলে যান কথা জাদুকর আব্দুস সবুর খান চৌধুরী। এবং সেখানে থাকাকালীন কিছুদিনের মধ্যেই পরীক্ষার রেজাল্ট দেয়। তিনি সফলতার সাথে পরীক্ষায় পাশ করেন। তারপর চট্টোগ্রাম সিটি কলেজে স্নাতক পড়াকালীন সমেয় নৈমিত্তিক ঘোষক হিসাবে ‘চট্টগ্রাম বেতারে’ নিয়োগ পেয়ে কর্ম জীবন শুরু করেন। অত:পর ১৯৭০ সালের মে মাসে চট্টগ্রাম বেতার এর ঘোষক হিসাবে নিয়োগ পেয়েছিলেন তিনি। ফজল ভাইয়ের প্রখর অভিভাবকত্ব আর আসাদের অসাধারণ প্রতিভা তাকে বেতারের প্রতি নেশাগ্রস্ত করেছিল। তাঁর একটু সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের নেশা থাকলেও পরে বাতাস অনুক’লে বাতাস পেয়ে তা যেন খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে, ডুবতে পর্যন্ত রাজি হয়ে গিয়েছিলেন এই টগবগে চট্টগ্রাম সিটি কলেজে পড়া তরুণ আব্দুস সবুর খান চৌধুরী।
তিনি চট্টগ্রাম সিটি কলেজে থেকে সফলতার সাথে স্নাতক পাশ করলেও স্নাতকোত্তর ভর্তি হতে পারেন নি। কারণ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল। সে সময় তাঁর বাবা-মা চট্টগ্রামে ছিল। তাই বাবা-মা এর সাথে সময় দেওয়ার জন্য খুলনা থেকে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়। এবং বাবা-মা এর সাথে খুলনায় পৌঁছায়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার প্রেক্ষাপট না হলেও তিনি মনে করেন সাতক্ষীরা থেকে অংশ গ্রহণ করবেন। তবে সাতক্ষীরা থেকে কলকাতায় রওনা হয়েও অংশগ্রহণ করতে না পারায় নীড়ে ফিরে এসে বসবাস করেছিল।
অত:পর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পূর্বের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলতে শুরু করলে কর্মস্থলে ফিরে যান। এবং স্নাতকোত্তর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। আর ঐ বছরই প্রথম ‘চট্টগ্রাম বেতার’ সফর করেন তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী। তার আগমনে ‘ চট্টগ্রাম বেতারে’ অনুষ্ঠানে আয়োজন করেছিল। কিন্তু ঐ অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র সঙ্গীত পরিবেশনের জন্য প্রবাল রায় চৌধুরীকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও বিশেষ কারণে না আসায় হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন আয়োজকবৃন্দ। তখন আয়োজকবৃন্দের অনুরোধে রবীন্দ্র সঙ্গীত পরিবেশন করেন ‘চট্টগ্রাম বেতার’ এর ঘোষক আব্দুস সবুর খান চৌধুরী। তাঁর গান শুনে তথ্যমন্ত্রী মুগ্ধ হয়ে উৎসাহিত করেছিলেন। অত:পর চট্টগ্রামের বিভিন্ন মঞ্চে গান পরিবেশন করে বেশ সুখ্যাতি অর্জন করেন। এবং কিছুদিন পরে তাকে খুলনা বেতারে বদলী করা হয়। তিনি খুলনা বেতারে যোগদান করেন।
আধুনিক মননশীলতার মধ্যে যে কয়জন শিল্পী চট্টগ্রাম ও খুলনা বেতারের ছিলেন তাঁর মধ্যে অন্যতম তিনি। তাই, হঠাৎ সৈয়দ নুরুল মুফতির পরিচালনায় খুলনা বেতারে প্রথম গান পরিবেশন করেছিলেন। তারপর থেকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করা যেন একটা নিয়ম হয়ে গেল। তিনি স্টাফ আর্টিস্ট এসোসিয়েশন, খুলনা’র সাবেক সভাপতি এবং রুপান্তর নাট্যগোষ্ঠী ও (Radio Announcers Club) এর প্রতিষ্ঠাতাও। আর গানের পাশাপাশি কবিতার মাধ্যমে ম্যাসেজ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে খুলনার শিল্পীদের নিয়ে দক্ষিণা দুয়ার নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। যার আহবায়ক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। সেই সংগঠনটি আবৃত্তি ও সঙ্গীত চর্চায় আজও অনবদ্য ভূমিকা রেখে চলেছে।
লেখক : মুনসুর রহমান