সাতক্ষীরার গ্রাম-গঞ্জ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামিণ ঐতিহ্য ঢেঁকি
বউ ধান ভানোরে ঢেঁকিতে পাড় দিয়া, ঢেঁকি নাচে বউ নাচে হেলিয়া দুলিয়া, বউ ধান ভানোরে ’ গ্রাম বাংলার চিরায়িত সেই ঢেঁকি আর ঢেঁকির তালে সেই গান আজ সাতক্ষীরার গ্রাম গঞ্জ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। যেই নবান্নে ধান কাটার উৎসবের সাথে সাথে শীতের পিঠা বানানোর ধুম পড়তো সাতক্ষীরার ৭৮ টি ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামে গ্রামে।
ঢেঁকির তালের শব্দে চালে গুড়া করত মাঝরাত থেকে শুরু করে পরদিন ভোর পর্যন্ত, সেই ঢেঁকি আজ আধুনিকতার উৎকর্ষতার দাপটে গ্রামের নব বধুদের কাছে এখন শুধুই স্বপ্ন। যান্ত্রিকতার নির্মম আগ্রাসনে সেই ঢেঁকি এখন আর চোখে পড়ে না। আবহমান গ্রাম বাংলার প্রতিটি গ্রামের বাড়িতে এক সময় ঢেঁকির প্রচলন ছিল।
দিনান্তের কাজের মধ্যে বাড়ির নববধুসহ নারীদের ব্যস্ত সময় কাটাত ঢেঁকির সঙ্গে। ঢেঁকিতে ধান ভেনে চাল বের করে রাতসহ পরবর্তী দিনের খাবার যোগাতেন গৃহবধুরা। তাই প্রতিদিন বিকেল হলে গ্রামে গ্রামে শোনা যেত ঢেঁকির শব্দ, সেই সঙ্গে বাহারি রকমের আঞ্চলিক গান। ফলে শারিরিক দৈনন্দিন পরিশ্রমে নারীরা থাকতেন নি-রোগ, স্বাস্থ্যবান। গাঁয়ের এ পাড়া অ পাড়ায় এক সময় ঢেঁকি দিয়ে চাল তৈরি, চিড়া ভাঙ্গা, আটা, পায়েসের চালের গুড়ো, খির তৈরির চাল, কুমড়ো আর কলাই দিয়ে সুস্বাদু সেই ডালের বড়ি বানানোর সেই ঢেঁকি আজ অসহায় হয়ে পড়েছে ইঞ্জিন চালিত মেশিনের কাছে। ধান ভানা, চাউল গুড়ো করা, বড়ি তৈরি করা , আটা তৈরি চালের গুড়াসহ ঢেঁকির যাবতীয় কাজ করছে ইঞ্জিন চালিত মিশিনে।
৭০ দশকের সর্বপ্রথম দেশে রাইস মিল বা মেশিন দিয়ে ধান থেকে চাউল বের করার প্রচলন শুরু হয়, তখন থেকেই ঢেঁকির প্রয়োজনীতা দিন দিন হ্রাস পেতে থাকে। বছর জুড়ে সারা দেশে তের পার্বন পালিত হতো। এসময় গ্রাম- গঞ্জের কৃষাণ- কৃষাণীরাও নবান্ন উৎসব, হেমন্ত উৎসব, পৌষ উৎসব, বিয়ে উৎসব থেকে শুরু করে বিভিন্ন উৎসবে পিঠা তৈরীর ধুম পড়ে যেত। আধুনিকতার যান্ত্রিক কবলে গ্রাম-গঞ্জ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে এসব উৎসব আর ঢেঁকির ছন্দময় শব্দ।
আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাওয়া ঢেঁকির প্রসঙ্গে গ্রামের প্রবীন মা-বোনেরা বলেন, আমাদের সকল বান্ধবীরা একে অন্ন্যের বাড়িতে যেয়ে নবান্নের চাউল উৎসবে মেতে ঢেঁহিতে চাল গুড়ো করে নানা রকমের পিঠাপুলি বানাতাম আর একে অন্যের বাড়িতে যেয়ে খেতাম। এখন আর সেই দিন নাই ! সব যেন স্মৃতি হয়ে গেছে।
পাটকেলঘাটা থানার তৈলকুপি গ্রামের এক গৃহবধু রুকসানা বেগম এ প্রতিবেদক কে জানায়, এক সময়কার ঐতিহ্যবাহী কাঠের ঢেঁকি আজ কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে ও হারিছে ঢেঁকির ছন্দময় শব্দ। পৌষ-মাঘে তীব্র শীতে আমাদের মা-চাচীরা বিভিন্ন গানের তালে তালে ঢেঁকিতে চালের গুড়ো করে নানা রকমের পিঠা বানাতো। ঢেঁকির গুণ সম্পর্কে একটি প্রবাদ বাক্য আছে ‘ঢেঁকি স্বর্গ গেলেও ধান বানে’ এ প্রবাদ বাক্যটিও এখন খুব একটা শোনা যায়না। ঢেঁকি শিল্প গ্রাম বাংলার প্রাচীন গ্রামীণ ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
শ্যামনগর থানার কাশিমাড়ী গ্রামের বৃদ্ধা অঞ্জনা দাশ বলেন,আগে আমারা ১২ মাসই ঢেঁকিতে চাল কুটতাম । রাতের পরে রাত কেটে যেত ঢেঁকিতে ধান ভানতে ভানতে । সুন্দর সেই ঢেকির পাটের আওয়াজ শুনে কীভাবে যে রাত পার হয়ে ভোর হতো বুঝতে পারতাম না । আজ সেই ঢঁকি ও ঢেঁকির আওয়াজ হারিয়ে গেছে আমাদের মাঝ থেকে ।
আশাশুনির থানার বড়দাল গ্রামের শিক্ষক সত্যজিত মন্ডল এই প্রতিবেদকে বলেন , আধুনিকতার যান্ত্রিকের কবলে পড়ে হারিয়ে গেয়ে গ্রামের অনেক ঐতিহ্য । আর এর মধ্যে অন্যতম হলো ঢেঁকি ।
তিনি আরও বলেন ,ঢেঁকিতে যে চাল কুটা হতো তা অনেক পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যসম্মত ।
এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা জেলা বিসিকের উপ-ব্যবস্থাপক (ভারপ্রাপ্ত) সাকলাইন মোস্তাক বলেন,আধুনিকতার ছোয়ায় ঢেঁকি শিল্প আজ বিলুপ্তির পথে ।আধুনিক কালে মানুষ অল্প সময়ের মধ্যে অনেক কাজ করতে চাই ।
তিনি আরও বলেন ,ঢেঁকিতে কোটা চাউল সহ অন্য দ্রব্য পুষ্টিকর সমৃদ্ধ । সেকারণে পুষ্টির দিকে লক্ষ করলে বুঝাযায় ঢেঁকিতে কোটা দ্রব্য ব্যবহার করলে রোগ বালাই কম হয় ।
দৈনিক সাতক্ষীরা /জি.এম-কামরুজ্জামান