দেবহাটার ৫ শ্রেষ্ঠ জয়িতার সফলতার কাহীনি
দেবহাটা প্রতিনিধি :
দেবহাটার ৫ নারী শ্রেষ্ঠ জয়িতা কঠোর পরিশ্রম আর প্রচেষ্টায় তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করেছে। বর্তমানে তারা সুখে শান্তিতে পরিবারের সদস্যদের সাথে বসবাস করছে। কঠোর পরিশ্রম আর প্রচেষ্টায় নিজেদের উন্নয়ন ঘটানোর কথা জানিয়েছেন উপজেলার ৫ নারী।
অর্থনৈতিক ভাবে সফল জয়িতা নারী সাজু পারভীন: উপজেলার সখিপুর ইউনিয়নের সখিপুর গ্রামের আব্দুর রহমানের কন্যা সাজু পারভীন অর্থনৈতিক ভাবে সফল জয়িতা নির্বাচিত হয়েছে। জন্মের পূর্ব থেকে তার পিতার পরিবারে অভাবেরমাত্রা বেশি হওয়ায় ৮ম শ্রেণির পর আর লেখাপড়া করার সুযোগ হয়নি। এরপর তাকে বাল্য বিবাহে আবদ্ধ করা হয়। কিন্তু বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতেও দারিদ্রতা লেড়ে থাকা দেখার পরেও সংসার করার জন্য কাউকে কিছু না বলে স্বামীর বাড়িতে সংগ্রাম শুরু করে। শ্বশুর বাড়ির লোকেদের চাহিদা মত টাকা পয়সা দিতে না পারায় দিনে দিনে নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকে সাজুর উপর। এরমধ্যে বছর ঘুরতে না ঘুরতে ২ সন্তানের জননী হন সাজু পারভীন। নির্যাতন সয্য করে সাজু স্বামীর পরিবারে টিকে থাকায় গাত্রদাহ হতে থাকে সে পরিবারের সদস্যদের। এজন্য কেরোসিন ঢেলে দিয়ে আগুন লাগিয়ে দিয়ে মারার পরিকল্পনা করে তারা। কিন্তু সাজুর বুদ্ধিমত্তাই বেঁচে যায় সে। অসুস্থ অবস্থায় সাজুর বাবা মা তাকে নিয়ে আসে হাসপাতালে। দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে অনেকটা সুস্থ হয় সাজু। বাপের বাড়িতে ফিরে সে নিজের ভরণপোষণ ও বাচ্চাদের দেখা শোনার জন্য লোণ নিয়ে কাপড়ের ব্যবসা শুরু করে। অপরদিকে আমার স্বামী ২য় বিবাহ করে আমার সাথে সকল প্রকার যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এরপর গ্রামের গ্রামে গিয়ে কাপড় বিক্রয় করে সংসার পরিচালনা শুরু করি। কিছু দিন যেতে না যেতে ব্যবসায় লাভ হওয়ায় একজনকে নিয়োগ করে ভ্যানে করে কাপড়ের ব্যবসা করতে থাকে সাজু। বর্তমানে সে সখিপুর মোড়ে একটি কাপড়ের দোকান দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছে। সাথে সাথে সাজুর কন্যা শ্রেণিতে এবং পুত্র ৩য় শ্রেণিতে লেখাপড়া করছে। সাজুর সংসারে অভাব কেটে আলোর মুখ দেখেছে। সাজু নিজের মত অন্যদের ভাগ্য পরিবর্তনে কাজ করে যাচ্ছে।
শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী আফরোজা পারভীন: উপজেলার পারুলিয়া ইউনিয়নের পারুলিয়া গ্রামের তৌফিকুল ইসলামের স্ত্রী আফরোজা পারভীন উপজেলার শিক্ষা ও চাকুরীর ক্ষেত্রে সাফল্য জয়িতা নির্বাচিত হয়েছেন। সে এস,সি পাশের পর পিতা লেখাপড়ার খরচ যোগাতে না পেরে এক বেকার ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়। স্বামীর সংসারে ছিল খুব অভাব। স্বামী আমার ও পরিবারের কোন দায়িত্ব নিতে রাজি ছিল না। তখন আমি ঠিক করলো তাকে আরো শিক্ষিত হতে হবে। তাই তো সে এলাকার ছেলে-মেয়েদের প্রাইভেট পড়ানোর দায়িত্ব নিল। সেই খরচ দিয়ে সে আবারো লেখাপড়া শুরু করল। কঠোর পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে সে এইচ,এস,সি পাশ করে। এরপর নিজের দায়িত্বে ব্র্যাকের স্বাস্থ্য সেবা প্রকল্পে চাকুরী শুরু করে। সেখানের বেতন ভাতা দিয়ে সে সংসারের অভাব দুর করে পরিবারে শান্তি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে আফরোজা। সে এলাকার নারী ও শিশুদের লেখাপড়া ও পুষ্টিসহ বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। একই সাথে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সুখে সুখে শান্তিতে বসবাস করছে।
শ্রেষ্ঠ সফল জননী সুফিয়া : দেবহাটার রত্ন গর্ভা মা সুফিয়া খাতুন। সে উপজেলার আস্কারপুর গ্রামের রজব আলীর স্ত্রী। তিনি ছিলেন সমাজ সচেতন, শিক্ষানুরাগী এবং আত্মপ্রত্যায়ী। নিজে নিরক্ষর হয়েও শিক্ষার প্রতি ছিলেন অদ্যম অনুরাগী। কোন প্রতিকূলতায় তাকে হার মানাতে পারেনি। তার ছিল ২ ছেলে এক মেয়ে। স্বামী ছিলেন দিনমুজুর। ৩ সন্তান নিয়ে আভাবের সংসারে স্বামী তাকে রেখে ২য় বিবাহ করে। এতে সে দিশেহারা হয়ে পড়ে। পরিবারের হাল ধরতে এলাকায় প্রাইভেট পড়ানো এবং বাড়িতে হাঁস-মুরগি পালন শুরু করেন সুফিয়া খাতুন। এই উৎস থেকে উৎপাদিত অর্থ দিয়ে ছেলে-মেয়েদের খাতা-কলম কিনে দিতেন। একই বই পর্যায়ক্রমে সবাই পড়ত। তার সন্তানেরা স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করে উচ্চ শিক্ষায় সর্বোচ্চ মেধার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছে। যার মধ্যে বড় ছেলে শামিম হোসেন ঢাকার একটি ব্যাংকে অডিট অফিসার হিসেবে কর্মরত আছে। ছোট ছেলে সাতক্ষীরা সড়ক উন্নয়ন দপ্তরের সিনিয়র সার্ভেয়ার এবং মেয়ে রেহেনা আক্তার কালিগঞ্জ উপজেলার মাগুরালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে কর্মরত আছেন। বর্তমানে সে ৩ সন্তান নিয়ে সুখী সমৃদ্ধশালী জীবনযাপন করছেন তিনি।
নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে নতুন জীবন শুরু করেছেন নাসিমা: উপজেলার পারুলিয়া ইউনিয়নের এছাহাক আলী কন্যা নাসিমা খাতুন নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে নতুন উদ্দমে জীবন শুরু করেছেন। নাসিমার পিতা ছিলেন ভূমিহীন দিনমুজুর। ৮ বছর আগে তার বিয়ে হয় এক দিনমুজুর পরিবারের। নাসিমার পিতা বর পক্ষের চাহিদা মত যৌতুক দিতে না পারায় বেড়ে যায় নির্যাতনের মাত্রা। একবছর পরে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেয় সে। সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে সব নির্যাতন সয্য করতে থাকে। একপর্যায়ে সন্তান নিয়ে বাপের বাড়িতে চলে এসে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকে জানালে তিনি মিমাংশার জন্য উভয়পক্ষ কে ডাকে। স্বামী আমাকে নিয়ে সংসার করতে রাজি না হওয়ায় আমাকে ডিভোর্স দেয়। এসময় আমার পাশে দাঁড়ানোর মত কেউই ছিল না। আমারও তখন বিধান জীবন যাপন করছিল। তখন আমার নিজের চেষ্টায় মাকে নিয়ে হাঁস-মুরগী ও গাভী পালন শুরু করি। বর্তমানে আমাদের খামারে ৫৫টি হাঁস-মুরগী ও ৫টি উন্নতজাতের গরু রয়েছে। পূর্বের তুলনায় সংসারে অনেক উন্নয়ন হয়েছে তার। বেড়েছে সমাজের গ্রহণ যোগ্যতাও।
সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখা জয়িতা সুফিয়া: উপজেলার সদর ইউনিয়নের টাউনশ্রীপুর গ্রামের মৃত রিয়াজউদ্দীনের স্ত্রী সুফিয়া খাতুন। সংগ্রাম করে চলছে যার জীবন। ১৯৮০ সালে বিয়ে হওয়ার পর থেকে সমাজের বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থায় জীবন নির্বাহ করে চলেছে। ২০০০ সালে তার স্বামী মারা যায়। দারিদ্রের কারণে মেয়েকে লেখাপড়া করাতে না পারলেও ছেলেকে সাতক্ষীরা সরকারি কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ৪র্থ বর্ষে লেখাপড়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। সংসার পরিচালনা করতে তিনি ব্র্যাকের সহযোগিতায় টাউনশ্রীপুর পল্লী সমাজের সদস্য হিসেবে কাজ শুরু। একপর্যায়ে সমাজের নানাবিধি কুসংস্কার ও বাধা বিপত্তি দূরীকরণের জন্য এলাকায় নারীদের নিয়ে একটি সংগঠন গড়ে তোলে। ২০১১ সালে তার নাম দেওয়া হয় টাউনশ্রীপুর বহুমুখী পল্লী সমাজ ফাউন্ডেশন। ২০১২ সালে সংগঠনটি রেজিস্ট্রেশন প্রাপ্ত হয়। সেখানে ৮০জন মহিলা সদস্য রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি থেকে ২০১৬ সালে ৪টি এবং বর্তমান পর্যন্ত মোট ২৩টি বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছে। রয়েছে রক্তদান কর্মসূচি। চোরাচালান, মাদক, মানব পাচার প্রতিরোধ, জঙ্গি-সন্ত্রাসী মূকল কর্মকাণ্ড থেকে যুব সমাজকে সচেতনতা কর্মসূচি। এছাড়া শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে প্রশাসনের সাথে অতোপ্রতো ভাবে সংযুক্ত আছে প্রতিষ্ঠানটি।
গত, ৯ডিসেম্বর ২০১৭ বেগম রোকেয়া দিবসে উপজেলা পর্যয়ে শ্রেষ্ঠ এই ৫ জয়িতা নারীকে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর ও উপজেলা প্রশাসন যৌথভাবে সম্মাননা প্রদান করা হয়।