একটি প্রস্ফুটিত গোলাপের পতন…
রবিউল ইসলাম :
শ্যামনগরের কাশিমাড়ীর প্রতিভাবান সবুজের অকাল মৃত্যুতে এলাকায় বিরাজ করছে শোকের মাতম! উপজেলার কাশিমাড়ীর ঘোলা গ্রামের পশু চিকিৎসক ডাঃ মিজানুর রহমানের একমাত্র পুত্র মাহবুব আলম সবুজ।
দীর্ঘ এক মাসেরও বেশী সময় ধরে ‘চিকুনগুনিয়ায়’ আক্রান্ত হয়ে সর্বশেষ ২৬ শে ডিসেম্বর মঙ্গলবার রাত ২ টার দিকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ঐ দিনই কাশিমাড়ীর আঁকাশ থেকে ঝরে পড়ে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র!
শুধু ব্যক্তি ‘সবুজের’ মৃত্যু হয়নি, মৃত্যু হয়েছে ওর মা-বাবা, ছোট ২ বোনের আশা-আকাংখা ও বেঁচে থাকার স্বপ্নের। যারা সারাজীবন সবুজ কে নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেছেন। যাদের বেঁচে থাকার ‘অক্সিজেন’ ছিল সবুজ।
সবুজের মৃত্যুতে তার পরিবারে চলছে শোকের মাতম। পুত্র হারা পিতা-মাতা পুত্র শোকে কাতর হয়ে পড়েছে। শোকে কাতর ছোট ২ বোন পারছে না স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে। মৃত্যুর এক সপ্তাহ পরেও তার পরিবারের সদস্যরা পারছেনা শোক কাটিয়ে উঠতে।
পরিবারের একমাত্র আশার প্রদীপ ‘চিকুনগুনিয়া’য় আক্রান্ত হয়ে সবার জীবনের প্রদীপ যেন নিভে দিয়ে গেছে। অসচ্ছল পরিবার থেকে উঠে আসা এবং সংগ্রামী দারিদ্র্য জীবনের মধ্যদিয়ে ধীরে ধীরে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলা এক ‘সবুজ’ যেন মরেও বেঁচে থাকবে হাজার মানুষের ভিতরে। হাজার হাজার যুবকের আদর্শের প্রতীক ছিলেন সবুজ।
শিক্ষা জীবনে অসংখ্য প্রতিকূলতার সম্মুখীন হওয়া এবং সে প্রত্যেকটি জীবন সংগ্রামে কঠিন ধৈর্য্য ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে সামনে দূর্বার গতিতে এগিয়ে চলা এক বাস্তবতার নাম ‘সবুজ’।
যার ফলে এনটিআরসির নিবন্ধন পরীক্ষায় সে বিনা টাকায় সম্মান জনক চাকরিতে যোগদানের সুযোগ পেয়েছিল এবং তার জীবনের যে স্বপ্ন সেটিকে সার্থক বা ফলপ্রসূ করার পথে সে অনেকটা এগিয়ে এসেছিল কিন্তু ভাগ্যের নির্মমতায় এবং পরাক্রমশালী মৃত্যুর যে নিষ্ঠুরতায় শেষ পর্যন্ত তাকে হার মানতে হল।
একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে দিসেহারা সবুজের অসুস্থ মা কাঁদতে কাঁদতে জানান, খোকা আমাকে কথা দিয়েছিল মা তুমি চিন্তা করোনা, আমি তোমাকে ভাল চিকিৎসার জন্য বড় ডাক্তার দেখাবো। তারপর না হয় বাবাকে আর তোমাকে আমি উন্নত চিকিৎসার জন্য পাসপোর্ট করে ভারতে নিয়ে যাব।
মাহবুব আলম সবুজের বাবা মিজানুর রহমান গুমরে গুমরে বার বার কেঁদে কেঁদে ওঠেন আর বলেন, আমার ছেলেটা আমাকে একেবারেই ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে। আমি যে একেবারেই নিঃশ্ব হয়ে গেলাম, আমার যে আর কিছুই নেই। আমার সোনা আমাকে এভাবে ফাঁকি দেবে তা বুঝে উঠতে পারিনি? অভাবের সংসারে ছেলেটা এখনও বিয়েও করেনি, যার জন্যে আমার বংশে বাতি দেওয়ার মত আর যে কেউ থাকল না।
তিনি আরও বলেন, বাবা আমি এখন নতুন চাকরি পেয়েছি। তোমাকে আর পরিশ্রম করতে দেবনা। জীবনে তুমি আমার জন্য অনেক কষ্ট করেছ। এবার থেকে আমি তোমাকে আর কোন কাজ করতে দেবোনা।
তার অবিবাহিত ছোট ২ বোন যারা লেখাপড়া শেষে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে, তাদের স্বপ্ন ছিল বড় ভাইয়ের সহযোগিতায় তারা তাদের জীবনের শেষ ঠিকানাটা খুঁজে পাবে। তারাও আজ ভাই হারা হয়েছে। পারছেনা নিজেদের কে সামলাতে।
“সবুজ” নামই যে সবুজ। মরণের ভিতরদিয়ে তার যে সবুজের বিন্দুমাত্র ঘাটতি হয়নি বরং সবুজ মরেও যেন চিরসবুজ রুপ ধারণ করেছে। সে তার বাবা-মা, বন্ধ-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন সবার কাছে সারাজীবন চিরসবুজ হয়ে থাকবে।
সবুজের বাবা এতটাই মুহ্যমান হয়ে পড়েছে যে “স্বাভাবিক” শব্দটি যেন তার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। সবুজের দেহের মৃত্যু হয়েছে কিন্তু সবুজের যে ভালবাসা, সবুজের সমারোহ তার কোন মৃত্যু হয়নি।এটি আর বেশি করে জাগ্রত হয়ে চির সবুজ রুপ ধারণ করেছে। সবুজ বেঁচে থাকবে অন্য যুবকদের মধ্যে প্রেরণার উৎস হিসেবে।
অনেক মানুষ মৃত্যবরণ করে কিন্তু সবুজের যে এলাকাবাসী ও বন্ধ-বান্ধবী, আত্মীয়-স্বজন, সহকর্মী যারা রয়েছে তাদের ভিতর যে আত্মচিৎকার যে আহাজারি হ্রদয়ের যে রক্তক্ষরণ সবাই প্রত্যক্ষ করেছে, এটা বিরল।
যারা হাজার হাজার লোক তার জানাযায় হাজির হয়েছিল সবাই তার প্রশংসা করেছিল। অসহায় এই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম চাকরীজীবি ছেলের মৃত্যুতে তাদের স্বপ্ন যেমন বিলীন হয়ে গিয়েছে, তেমনি তাদের কষ্টটা আর বেড়ে গেছে।
ঘোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ভর্তি হন কাশিমাড়ী আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজে, এখানে মাধ্যমিক শিক্ষা ও
শ্যামনগর সরকারী মহসীন কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ভর্তি হন খুলনা সরকারি বিএল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে। এখান থেকে সাফল্যের সাথে রসায়নে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভভ করেন।
তার স্বপ্ন এতটাই যে ভরণ করেছিল যে বন্ধুদের সাথে মাঠে খেলা করার জন্য নতুন ব্যাট, নতুন কেডস ও সরন্জাম কিনেছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার স্বপ্ন অবাস্তবে থেকে গেল।
মৃত্যুর ১১ দিন পরেও তার বাড়িতে কান্নার শব্দ থেমে নেই। পরিবারের বিরাজমান শোকের মাতম থামবে কবে? আজও পরিবারের একমাত্র পুত্র হারা পিতা-মাতার কান্নার আহাজারিতে চারিদিকের বাতাস যেন আরও ভারী হয়ে উঠেছে।