পুলিশের খাতায় ১৩ বছরের নাবালিকা,কাজীর খাতায় ২০ বছরের সাবালিকা, যাদুর-কাঠি কার হাতে ?

নিজস্ব প্রতিনিধি :

প্রেম-ভালোবাসা আসে স্বর্গ হতে। তাইতো বহুকাল যাবত এই পৃথিবীতে প্রেম-ভালোবাসার বৃত্তচক্র চলমান। বর্তমান জেনারেশনের ছেলে-মেয়েরা এই চক্রের বাইরে নয়। কিন্তু তাদের প্রেম-ভালোবাসার পরিধি একটু বেশি। প্রেম বয়স,জাতী,ধর্ম,বাধা কিছুই মানে না এমন উক্তিতে বিশ্বাসী এই জেনারেশন। তাইতো এই সময়ের প্রেমিক যুগল সাথী ও ইব্রাহিম প্রেমের হাওয়ায় দুলতে শুরু করে। এক সময় তাদের ভালোবাসার ঘর বাঁধার স্বপ্ন বুকে বাসা বাঁধে। কিন্তু তাদের এই স্বপ্ন পূরণে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় দেশের চলমান বিবাহ আইনের বয়সসীমা। কারণ সাথীর বয়স ১৩ বছর। “প্রেম মানে না কোন বাঁধা” উক্তিতে বিশ্বাসী যুগল পালিয়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী বাগেরহাটে সাথীর এক আত্মীয়ের বাড়িতে চলে যান এই প্রেমিক যুগল।

বলছিলাম কালিগঞ্জ উপজেলার রতনপুর ইউনিয়নের তেঘরিয়া গ্রামের মোঃ নুরুজ্জামাল গাজী(বাবু) এর অষ্টম শ্রেণী পড়ুয়া কন্যা মোছা: নাজমুন নাহার (সাথী) এবং একই উপজেলার ধলবাড়িয়া ইউনিয়নের উচ্ছেপাড়া গ্রামের মোঃ শামসুর রাহমানের পুত্র মোঃ ইব্রাহিমের কথা।

সার্থক এই প্রেমিক যুগলের স্বপ্নের জগতে ভিলেন চরিত্রে আবির্ভাব ঘটে সাথীর মায়ের। দেশের চলমান আইনে সাথীর মা গত ইং ০২-০৪-২০২১ তারিখ কালিগঞ্জ থানায় ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে তার ১৩ বছরের নাবালিকা মেয়েকে অপহরণের মামলা দায়ের করেন। শুরু হয় পুলিশের তৎপরতা। পুলিশ বাগেরহাট থেকে ভিকটিম সাথীকে উদ্ধারসহ আসামীদের গ্রেপ্তার-পূর্বক আদালতে প্রেরণ করেন। দীর্ঘদিন কারাভোগের পর জামিনে মুক্ত হয়ে ইব্রাহিমের ভালোবাসার অপর পিঠটাও উপলব্ধি করা হয়ে গেল।

“প্রথম ভালোবাসা যায়না ভোলা”, তাইতো ইব্রাহিম দেশের চলমান আইনের প্রতি সম্মান রেখে ভাবলো,সাথীর বয়স ১৮ বছর হলে দুই পরিবারের সম্মতিতেই তারা এক হবে। কিন্তু বিধি বাম, সাথীর পরিবারের কাছে সবই সম্ভব। দেশের আইন যেন তাদের হাতেই পরিবর্তিত হয়।মাত্র ৭ মাসের ব্যবধানে ১৩ বছরের নাবালিকা সাথী হয়ে গেল ২০ বছরের সাবালিকা যুবতী। সাথী এখন অন্যের ঘরের রমণী।

ইব্রাহিম ভাবতে ভাবতে পাগল প্রায়, একোন দেশে আছে সে, যে দেশের আইনের বয়সসীমার বেড়াজালে তার স্বপ্নের ভালোবাসার ঘর বাঁধা হলনা, অন্যদিকে সেই দেশেরই কিছু অসাধু ব্যক্তিদের যোগসাজশে তার স্বপ্নের কন্যা আজ অন্যের ঘরণী। কার কাছে জানাবে অভিযোগ, কোথায় পাবে বিচার। উন্মাদ ইব্রাহিম ছুটে যান সাথীর মা নুর নাহার বেগমের নিকট। প্রশ্ন করে,”কি হবে আমার স্বপ্নের,কি হবে আমার হয়রানি মূলক অপহরণ মামলার।”নুর নাহার বেগমের সহজ উত্তর,”এক লক্ষ টাকা দিলে মামলা উঠিয়ে নিবেন”। কোন উপায় না পেয়ে ইব্রাহিম সংবাদ মাধ্যমের দ্বারস্থ হয়।

সত্যতা যাচাই করতে যেয়ে দেখা যায়,গত ইং ০২-০৪-২০২১ তারিখে সাথীর মা নুরনাহার বেগম কালীগঞ্জ থানায় তার কন্যার বয়স ১৩ বছর দেখিয়ে, ইব্রাহিম সহ অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে তার কন্যার অপহরণের মামলা করেন। কিন্তু মাত্র সাত মাসের ব্যবধানে সাথীর জন্ম তারিখ ০৩-০৫-২০০১ অনুযায়ী বয়স ২০ বছর দেখিয়ে দেবহাটা উপজেলার চন্ডিপুর গ্রামের মোঃ সহিদ গাজীর পুত্র মোঃ রাকিব হোসেনর সাথে বিবাহ প্রদান করেন। কিন্তু সাথীর প্রকৃত জন্ম-নিবন্ধন অনুযায়ী তার জন্ম তারিখ ৩১-১২-২০০৭।

তবে সাথীর পরিবার,কাজী উপজেলার দেয়া গ্রামের মৃত মান্দার গাজীর পুত্র মাওলানা মোঃ করিম গাজী ও উপজেলার মৌতলা গ্রামের বিবাহ রেজিস্টার মোঃ আনোয়ারুল সাহাদাত সহ পরস্পরের যোগসাজশে ২১-১১-২০২১ তারিখ (বই নং -১৬০০,ভলিয়ম নং-৩৬, পৃষ্ঠা নং-৩৭) বিবাহ রেজিস্টার বইতে রাকিব ও সাথীর বিবাহ রেজিস্ট্রি করা হয়।

ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে জানতে চাইলে রেজিস্টার মোঃ আনোয়ারুল সাহাদাত বলেন,” আমি বাল্য বিয়ে রেজিস্ট্রি করি না।করিম আমার সীল সই নকল করে এইটা করতে পারে। আর আমি এখন বই দেখাতে পারব না।”

এবিষয়ে জানতে চাইলে মাও: মোঃ করিম বলেন,”আমি অল্প কিছু টাকার বিনিময়ে শুধু বিয়ে পড়াই।জন্ম নিবন্ধন অনেক সময় দেখা হয় না। অনেক আগে দু’একটা বাল্য বিয়ে পড়ানো হয়েছে।আর বাল্য বিয়ে পড়াবো না। সাথীর বিবাহ রেজিস্ট্রির সম্পর্কে তিনি বলেন,”আমি মৌতলার সাহাদাত ভাইয়ের কাছে তাদের নিয়ে গিয়েছিলাম, কিভাবে রেজিস্ট্রি করেছেন সেটা তিনিই জানেন। আমি সবজায়গাতেই বলতে পারব, আমি জানি ঐ বিয়ের রেজিস্ট্রি সাহাদাত ভায়ই করেছেন।

ঘটনার বিস্তারিত জানতে চাইলে সাথীর মা নুর নাহার বেগম বলেন,”অনেক খরচাপাতি করে মেয়ে বিয়ে দিছি। কমপক্ষে আমার খরচের অর্ধেক টাকা না দিলে আমি মামলা মিটাবো না। আমি অনেক কষ্টে আমার ছোট মেয়েটাকে বিয়ে দিছি।”

এবিষয়ে ইব্রাহিম বলেন,”এই ঘটনাটি আমার জীবন এলোমেলো করে দিয়েছে।বাল্য বিয়ে প্রতিরোধে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী এদের শাস্তি চাই। সেই সাথে আমি তাদের চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিতে পারব না,ফলে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা হয়রানি মূলক মামলা হতে রেহাই চাই।”

এদিকে স্থানিয় এক শালিশে সাথীর ভাই সবুজ গাজী মামলা মিটানোর জন্য ইব্রাহিমের পরিবারের কাছে ষাট হাজার টাকা দাবি করেন।
বাল্য বিবাহ প্রতিরোধের দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য এই ঘটনাটির সুষ্ঠু তদন্ত পূর্বক দোষীদের বিরুদ্ধে প্রোয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট জোর দাবী জানান সমাজের সচেতন মহল।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)