দেবহাটার খলিশাখালির হাজার বিঘা সরকারি খাস জমি থেকে ভূমিহীনদের উচ্ছেদ করতে ভূমিদস্যুদের হুমকি অব্যহত

রঘুনাথ খাঁ:

সাতক্ষীরার দেবহাটার খলিশাখালিতে ভূমিদস্যুরা ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসীদের দিয়ে ভূমিহীনদের উচ্ছেদের চেষ্টা চালিয়েছে। খবর পেয়ে মাইকিং করে দু’ হাজারের বেশি ভূমিহীন নারী ও পুরুষ একত্রিত হয়ে প্রতিহত করার ঘোষণা দিলে সন্ত্রাসীরা পিছু হটতে বাধ্য হয়।

এদিকে ভূমিহীনদের সরকারি খাস জমির অধিকার ফিরে পেতে জেলা প্রমাসক, ভূমি মন্ত্রী ও বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন জেলা ভূমিহীন সমিতির সভাপতি আব্দুস সাত্তার ও তার সংগঠণের নেতৃবৃন্দ।

সরেজমিনে শুক্রবার বিকেলে দেবহাটার ভূমিহীন জনপদ খলিষাখালিতে যেয়ে দেখা গেছে খুপড়ি খুপড়ি ঘর বেঁধে রাস্তার পাশে ও মাছের ঘেরের বেড়িবাঁধের উপর বসবাস করছে বেশ কিছু পরিবার। তবে ওইসব স্থান বসবাসের অনুপোযোগী। কোন কোন পরিবার রান্না করে খাচ্ছেন। আবার কোন কোন পরিবার অন্য জায়গা থেকে রান্না করা খাবার এনে বাসায় বসে খাচ্ছেন। সুপেয় পানির সঙ্কটের পাশাপাশি স্যানিটেশন ব্যবস্থার নাজুক অবস্থায়। ভূমিদস্যুদের প্রতিহত করতে রাতভর পাহারা দেওয়া ভূমিহীনদের চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ। ভূমিহীন জনপদে চলছে দফায় দফায় মিছিল।

জানতে চাইলে ভূমিহীনরা জানান, নোড়ার চকের ইউপি সদস্য মোকাররম শেখ, ন’ পাড়ার রেজাউল চেয়ারম্যানের ভাই রবিউল, কালীগঞ্জের কাশীবাটির মুরশিদ ভূমিহীনদের বিভাজন করে জমির মালিক দাবিদার নজরুল ডাক্তার, আতিকুর রহমান, গোলাম কাজী, আনারুল ইসলামসহ ভূমি দস্যুদের দালালি করে চলেছে। এমনকি ভূমিদস্যুদের সঙ্গে একত্রিত হয়ে ভূমিহীনদের কাছে চাঁদা দাবিসহ ভূমিদস্যুদের সঙ্গে বসে চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে খাস জমি ছেড়ে দিতে বাধ্য করার জন্য চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। তবে ১৯৯৮ সালে ২৭ জুলাই বাবুরাবাদে ভূমিহীন জাহেদার মৃত্যু ও ভূমিহীনদের আন্দোলনের কথা মাথায় রেখে প্রশাসনও যথেষ্ট দক্ষ ভূমিকা রাখায় সন্ত্রাসীরা দু’পা এগিয়ে গেলেও এক পা পিছিয়ে যাচ্ছে।

সাপমারা খালের খলিষাখালির চরভরাটি জায়গায় দীঘদিন ধরে বসবাসকারি মৃত আরশাদ মোল্লার স্ত্রী রাবেয়া খাতুন জানান, তার বয়স এখন তিন কুড়ি দশ। ডায়াবেটিকসসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। একমাত্র ছেলে প্রতিবন্ধি। এক বছর আগে সাপমারা খাল কাটার ফলে তাকেসহ এলঅকার বেশ কিছু ভূমিহীন পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়। সর্বশেষ তাদের আশ্রয় হয় রাস্তার উপর। অবর্ণণীয় কষ্টের মধ্যে বসবাসের একপর্যায়ে অন্যদের মতো তিনিও খলিষাখালির সরকারি খাস জমিতে গত ১১ সেপ্টেম্বর সকাল থেকে বসবাস শুরু করেছেন। সরকারি জমি ডিসিআর নেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদনও করেছেন। খলিষাখালিতে ডিসিআর পেলে সেখানেই ছোট মাছের ঘের বা সম্মিলিত মাছের ঘের করে শেষ জীবনটুকু পার করতে চান।
সাপমারা খালের চরভরাটি জমিতে বসবাস করতেন শফিকুল শেখের স্ত্রী হালিমা খাতুন। খাল কাটা শুরু হলে এক বছরের বেশি সময় ধরে রাস্তার উপর পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করতেন। উচ্চ আদালতের রায় জমির মালিক দাবিবারদের বিপক্ষে যাওয়ায় অন্য ১০ জনের মত তিনিও এক সপ্তাহ যাবৎ খলিষাখালির সরকারি জমিতে বাসা বানিয়ে বসবাস করছেন। আবেদন করেছেন ডিসিআর নেওয়ার। এখানে কমপক্ষে দু’ বিঘা জমি পেলে সেখানে চাষাবাদ করে সংসার চালাতে পারবেন বলে জানান হালিমা।

একইভাবে চারকুনি গ্রামের মৃত সুরমান বৈদ্যের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা আবু তালেব বৈদ্য (৭২) বলেন, সরকারি খাস জমি ভূমিহীন ও মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ডিসিআর বা বন্দোবস্ত দেওয়ার জন্য বর্তমাস সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভালো উদ্যোগ। এরই অংশ হিসেবে একজন দুস্ত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনিও খলিষাখালিতে বসবাস করছেন। চান ভূমিহীন হিসেবে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। একইসাথে যারা জমির মালিক সেজে কয়েক যুগ ধরে খলিষাখারিতে ১২ একর ৫৫ শতক সরকারি খাস খালে মাছ চাষ করে খেয়েছেন সেই ভূমিদস্যু নজরুল ডাক্তার, আতিকুর রহমান, আনোয়ারুল ইসলাম, গোলাম কাজীসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।

উত্তর পারুলিয়ার মুক্তিযোদ্ধা গোলাম বারী ও সামছুর রহমান বলেন, তারা অসহায় হিসেবে সরকারি ভাতা পাচ্ছেন। এরপরও নিজেদের মাথা গোঁজার জায়গা নেই বললেই চলে। তারাও খলিষাখালির খাস জমি ভূমিহীন ও অসহায় মুক্তিযোদ্ধাদের নামে বন্দোবস্ত দেওয়ার দাবি জানান।

ভূমিহীন নেত্রী মমতাজ মেগম ওরফে ভাদ্দুরি বেগম বলেন দেবহাটার নোড়ার চক, নোড়ার চারকুনি, ঢেবুখালি, বাবুরাবাদ, আশাশুনির ভাসার চক, কালীগঞ্জের চিংড়িখালি ও বৈরাগীর চক ভূমিহীনদের আন্দোলনের ফসল। ভূমিদস্যুদের গুলিতে নিহত হয় ভূমিহীন নেত্রী জায়েদা। এরপর যে আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল তা বিশ্ববাসীর ভুলে যাওয়ার কথা নয়। আবারো শুরু হয়েছে ভূমিদস্যুদের মিথ্যাচার ও ষড়যন্ত্র। গত ১২ সেপ্টেম্বর ভূমিদস্যু আতিকুর ও আনারুল ভূমিহীনদের নামে পৃথক দু’টি মামলা করেছেন। ভূমির মালিক দাবিদাররা সংবাদ মাধ্যমে একের পর এক অপপ্রচার করে যাচ্ছেন। মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও অপপ্রচার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিহত করা হবে। তিনি আরো জানান, যারা ভূমিদস্যুদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভূমিহীনদের কাছে চাঁদা দাবি ও উচ্ছেদের চেষ্টা চালাচ্ছে তাদের সম্পর্কে প্রশাসনকে অবহিত করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে সাতক্ষীরার সরকারি কৌশুলী (জিপি) অ্যাড. শম্ভুনাথ সিংহ বলেন, জেলা প্রশাসক মহোদয়, স্থানীয় সাংসদ, জনপ্রতিনিধিসহ বিচার বিভাগ ও আইনপ্রয়োগকারি সংস্থার কর্মকর্তারা যখন তার পরামর্শ জানতে চেয়েছেন তখন তিনি সুপ্রিম কোর্টের আদেশ, বর্তমান প্রেক্ষাপট ও ভূমিহীন জনপদের সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কে তাদেরকে অবহিত করেছেন। এরমধ্যে সাধারণ মানুষের জানমালের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। প্রশাসন আইনগত ভাবে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে।

এ ব্যাপারে দেবহাটা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার সাহা বলেন, খলিশাখালিসহ আশপাশের এলাকায় পুলিশের নজরদারি রয়েছে। অপ্রীতিকর ঘটনা প্রতিরোধে সজাগ দৃষ্টি রয়েছে।
প্রসঙ্গত, রাষ্ট্রপক্ষ মহমান্য হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালের ১৭ জুলাই মহামান্য সুপ্রিম কোর্টে ২৫৬৮/২০১৭ লিভ টু আপিল দাখিল করলে বিচারপতি মোঃ ইম্মান আলী, বিচারপতি মীর্জা হুসেন হায়দার ও বিচারপতি আবু বক্কর ছিদ্দিক যৌথভাবে গত ৪ ফেব্রুয়ারী সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসককে ওই জমি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য আদেশ দেন। এরপর গত ১৩ এপ্রিল ওই এক হাজার ৩২০ বিঘা জমি ভূমিহীনদের নামে স্থায়ী বন্দোবস্ত দেওয়ার জন্য রবিউল ইসলাম, গোলাপ ঢালী ও হাবিবুলÍাহ বাহার খুলনা বিভাগীয় কমিশনার ও সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)