মহান মুক্তিযুদ্ধ ও আমার স্বামী ভাষা সৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমান সরদার

লেখক
-মোছাঃ কারিমুন নেছা

আমার নাম মোছাঃ কারিমুন নেছা, পিতা- শরিয়তুল্যাহ গাজী, মাতা- শামছুন্নাহার, গ্রাম- ধোপাডাঙ্গা, উপজেলা- দেবহাটা, জেলা-সাতক্ষীরা। আমার জন্মতারিখ ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৪২। সে মোতাবেক বর্তমানে আমার বয়স ৭৮ বছর। ইং ১৯৫৯ ও বাংলা ১৩৬৫ সালের ১৩ আষাঢ় আমার বিয়ে হয় দেবহাটার বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ভাষা সৈনিক লুৎফর রহমান সরদারের সাথে। বিয়ের পরই আমি জানতে পারি যে আমার স্বামী লুৎফর রহমান সরদার বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িত। তিনি মনি সিংয়ের দল করতেন। মনি সিংকে নিজের চোখেও দেখেছি আমাদের বাড়ীতে আসা যাওয়া করতে। পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী জ্যোতি বসুকেও দেখেছি আমাদের বাড়ীতে আসতে। সেসময়ে আমি জানতে পেরেছিলাম যে ভাষা আন্দোলনের সাথে জড়িত থাকার কারনে আমার স্বামীকে ১৯৫২ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। তখনকার ঢাকার একটি দৈনিক সংবাদ পত্রের জেনারেল ম্যানেজার মাহবুবুর রহমান খান থেকেই তিনি বাম রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন।

তৎকালীন নিষিদ্ধ ঘোষিত পুর্ব পাকিস্থান কমিউনিষ্ট পার্টির একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন আমার স্বামী লুৎফর রহমান সরদার। উনি তৎকালীন সি.পি.পি  নেতা কমরেড মনি সিং, কমরেড নেপাল নাগ, অজয় রায়, বারীন দত্ত, সংবাদপতের সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধূরী এবং আরো অনেকে। সেসময়ে আয়ুব খান সরকার আমার স্বামীসহ প্রত্যেকের জীবিত অথবা মৃত সন্ধান চেয়ে মাথাপিছু দশ হাজার টাকা করে পুরষ্কার ঘোষনা দিয়েছিলেন। সবাই বিভিন্ন নিজেদের পোষাক ও চেহারা পাল্টেই আমাদের বাড়ীতে যাতায়াত করতো। তখন মাঝেমধ্যেই এসকল নেতাদের উপস্থিতিতে আমাদের বাড়ীতে মিটিং হতো। আমি নিজে সকলকে রান্না করে খেতে দিতাম। সকলে আমাকে ভাবী সাহেবা বলেই সম্বোধন করতেন। ওনারা সকলেই সেসময়ে দেশের নামকরা কমিউনিষ্ট নেতা ছিলেন, তাই তাদেরকে সেবা করতে পেরে আমারও ভালো লাগতো। তাদের রাজনীতির উদ্দেশ্য ছিলো গরীবের দুই বেলা রুটি রুজির ব্যবস্থা করা এবং সেজন্যই তারা মিটিং করতেন। আমার স্বামী লুৎফর রহমান সরদার ১৯৭০ সালে কমিউনিষ্ট পার্টির পক্ষে সাতক্ষীরা কালীগঞ্জ থেকে এমপি ইলেকশন করেন। তিনি ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সক্রিয়ভাবে রাজনীতির সাখে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালে যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষনা আসে, তখণ তার পার্টিও বঙ্গবন্ধুর ওই আহ্বানে একাত্মতা ঘোষনা করে। সেজন্য পাকিস্থানী আর্মিরা আমার স্বামীকে টার্গেট করেন। সেসময়ে তিনি পালিয়ে ভারতের টাকীতে যেয়ে আশ্রয় নেন এবং জ্যোতিবসু ও তার দলের সাহায্যে টাকীতে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প তৈরী করেন। তাদের খাবার, অস্ত্র ও বস্ত্র দিয়ে সহযোগীতা করেন। তখন আমি খুলনা থেকে পায়ে হেটে আমার ছোট ছোট তিনটি সন্তানকে নিয়ে গ্রামের বাড়ী সখিপুরে আসি এবং তারপর ভারতের টাকীতে চলে যাই। আমাদের খুলনার বাড়ী পাকিস্থান হানাদার বাহিনীর সদস্যরা লুট করে নেয় এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। পরবর্তীতে টাকী ক্যাম্পের তত্বাবধানে ৯নং সেক্টর প্রতিষ্ঠিত হয়। ৯ নং সেক্টর গঠনের জন্য আপ্রান চেষ্টা করেন এন.এন.এ গফুর সাহেব, ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টার, ইপিআর সুবেদার আয়ুব হোসেন ও আমার স্বামী লুৎফর রহমান সরদার। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে আমার স্বামী কলকাতায় গিয়ে পার্টির কাছ থেকে অস্ত্র, কম্বল ও খাদ্য নিয়ে আসেন এবং সেগুলো ৯নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে ভাগ করে দেন। মাঝে মাঝে যখন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে খাবার না থাকতো, তখন আমি সেখানকার ২৬জন মুক্তিযোদ্ধাকে আমার বাড়ীতে খেতে দিতাম। যুদ্ধকালীন সময়ে নিরাপত্তার জন্য জ্যোতিবসুর ব্যাক্তিগত পিস্তলটিও আমার স্বামীকে দিয়ে দিয়েছিলেন। আমার পরিবার দেশের স্বাধীনতার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছি, কিন্তু বিনিময়ে রাষ্ট্রের কাছ থেকে আশানুরুপ তেমন কিছুই পাইনি। স্বাধীনতার পর প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আইভি রহমানের ভাই আজিজুর রহমান ও তৎকালীন জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট এল.আর সরকার আমার স্বামীকে এনিমি প্রোপার্টি দেয়ার অনেক চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু তিনি নেননি। ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হলে আমার স্বামী রাজনীতি থেকে সরে আসেন। দেবহাটার খানবাহাদুর আহছানউল্লা কলেজের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন এবং হাজী কেয়ামউদ্দীন মেমোরিয়াল মহিলা কলেজটি সম্পূর্ন নিজের চেষ্টায় গড়ে তোলেন। দক্ষিন সখিপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে টানা ১৭ বছর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। আমার ও আমার পরিবারের কাছে সবচেয়ে দুঃখের যে বিষয়টি সেটি হলো ‘দেশের জন্য এতটা অবদান রাখা স্বত্ত্বেও স্বীকৃতি স্বরূপ তার নামটি তেমন কোথায় স্মরণ করতে দেখা যায়না।’ মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার সামনেই পাকিস্থানী দালাল ইউনুসকে নিজের হাতে নৌকার মধ্যে গুলি করে হত্যা করেন আমার স্বামী। বাধ্যর্কের কারনে বর্তমানে আমি জীবনের শেষ দিকে পৌছে গেছি। বর্তমানে আমার শারিরীক অবস্থাও ভালো নয়। আমার শেষ ইচ্ছে যে, ‘ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদানের জন্য তাকে একুশে পদকে সম্মানিত করা হোক। তাহলে অন্তত মৃত্যুর পরে হলেও তিনি রাষ্ট্রের কাছ থেকে যথাযথ সম্মাননা পাবেন।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)