করোনায় উভয় সংকটে মধ্যবিত্তরা

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতিতে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন অনেকে। কেউ হারিয়েছেন চাকরি, কেউ রয়েছেন চাকরি হারানোর শঙ্কায়। আয়-রোজগার না থাকায় ঘরে খাবার নেই। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ভাড়া পরিশোধে বাড়ির মালিকের বাড়তি চাপ।

ফলে উভয় সংকটে দিন কাটছে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের। তারা না পারছে নিজেদের সামাজিক অবস্থান ধরে রাখতে, না পারছে কারো কাছে হাত পাততে। এই মানুষগুলোর কেউ কেউ ঢাকা ছেড়ে গ্রামের পথে পাড়ি জমাচ্ছে। রাজধানী ঘুরে জানা গেছে এমন তথ্য।

করোনায় এমন পরিস্থিতির শিকার মাঈনুল ইসলাম লাবু। পোশাকের প্রিন্টিং ও ডিজাইনের ছোট্ট কারখানা গড়ে তুলেছিলেন ১৪ বছর আগে। করোনার প্রভাবে কারখানাটি এখন বন্ধের পথে। শ্রমিকদের বেতন, বাড়িভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, পরিবারের খরচ- সব মেটাতে হিমশিম অবস্থা তার। তিলতিল করে সাজানো স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ায় তার চোখে মুখে এখন অন্ধকারের ছাপ।

মাঈনুল ইসলাম লাবু ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, আমার ১৪ বছরের স্বপ্ন তিন মাসে কেড়ে নিতে বসেছে করোনা। সেই সঙ্গে ভবিষ্যৎ কেড়ে নিলো কারখানায় কাজ করা শ্রমিকদের। এখন পথে বসা ছাড়া কোনো উপায় দেখছি না।

একই সঙ্গে দিশেহারা কারখানার শ্রমিকরাও। কর্মস্থল বন্ধ হলে পরিবার-পরিজন নিয়ে কোথায় যাবেন, কি খাবেন সব কিছুই অজানা তাদের।

পোশাক শ্রমিক কুলসুম বেগম বলেন, ঘর ভাড়া দিতে পারিনি তিন মাসের। কোনো রকম জীবন পার করছি পরিবার নিয়ে। এখন কারখানা বন্ধ হলে গ্রামে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। গ্রামে গিয়ে কি করে খাব সেটাও চিন্তা করছি।

পোশাক শ্রমিক মালা বেগম বলেন, ১০ বছর ধরে স্বামীকে নিয়ে গার্মেন্টস-এ চাকরি করে জীবন-জীবিকা পরিচালনা করে আসছেন। বেশ চলছিলো তাদের জীবন। সংসারে রয়েছে তাদের ৭ বছরের একটি ছেলে সন্তান। সম্প্রতি করোনার প্রাদুর্ভাবের পর থেকে গার্মেন্টেসে নেই তেমন কাজ। মাঝে সরকারের নির্দেশে বন্ধ ছিল গার্মেন্টস। বেতন-ভাতা না পেয়ে তিন বেলা পেটের ভাত জোগানোই এখন দুস্কর।

মালার স্বামী জসিম বলেন, তিন মাসের বাসা ভাড়া জমে গেছে। বাড়িওয়াল বাসা ছেড়ে দিতে বলেছেন সামনের মাসেই। এখন কি করবো বুঝতে পারছিনা। না খেয়ে মরতে হবে। গ্রামে গিয়ে কি করে খাবো- চিন্তা করছি।

এমন অনিশ্চিত জীবনযুদ্ধে দেশের হাজার হাজার মানুষ। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তরা আছে বেশি বিপাকে। ছোট ব্যবসায়ীদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আবার কারো চাকরি চলে যাচ্ছে, নয়তো বেতন কমছে। ঘরে খাবার সংকট, তার ওপর বাড়ি ভাড়া মেটানোর চাপ। এমন এক বাস্তবতার মুখোমুখি নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা। এ অবস্থায় সম্মান বাঁচাতে কষ্ট বুকে চেপে গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। আবার কেউ কেউ পরিবার-পরিজন পাঠিয়ে দিয়ে মেসে উঠছেন খরচ কমাতে।

যারা কিনা বহুদিন ধরে জীবনের প্রয়োজনে, জীবিকার প্রয়োজনে ঢাকায় বসবাস করছিলেন পরিবার-পরিজন নিয়ে, তারা এরইমধ্যে ঢাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার অলি-গলি আর বাসা-বাড়ির গেটগুলোতে ঝুলছে অনেক টু-লেট সাইনবোর্ড। অনেক বাড়িতেই ভাড়াটিয়া নেই বলে একাধিক ফ্ল্যাট খালি আছে। এতে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে বাড়ির মালিকরা।

করোনার কারণে নিম্নআয়ের মানুষ যতটা বিপদে পড়েছে, তার চেয়ে বেশি বিপদে ও বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে নিম্ন-মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। সরকারের করোনাকালীন নানা সহায়তা কর্মসূচির তালিকায় নিম্নআয়ের মানুষ নাম ওঠাতে পারলেও নিম্ন-মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত শ্রেণি তা পারছে না। তারা না পারছে নিজেদের সামাজিক অবস্থান ধরে রাখতে, না পারছে কারো কাছে হাত পাততে। তাদের অনেকেরই এখন ভেতরে ভেতরে গুমরে মরার দশা।

এদিকে, বিআইডিএসের গবেষণা বলছে, করোনার প্রভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ায় দেশের প্রায় ৯৫ শতাংশ পরিবারের উপার্জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কাজ হারিয়েছে ৩৬ শতাংশ মানুষ। আর নতুন করে দেশের ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের কাতারে যুক্ত হয়েছে।

অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ জানান, ক্ষুদ্রশিল্পের উদ্যোক্তাদের যেমন সহযোগিতা করতে হবে, তেমনি বড় উদ্যোক্তাদেরও সাপোর্ট লাগবে, যেন তারা তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রেখে শ্রমিকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারেন।

অন্যদিকে পরিসংখ্যান মতে, দেড় হাজার বর্গকিলোমিটারের এ নগরীতে প্রায় ২ কোটি মানুষ বসবাস করে, যাদের প্রায় ৮০ শতাংশই ভাড়া বাসার বাসিন্দা। কিন্তু গত মার্চে দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর খেয়ে-পরে বেঁচে থাকা নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্বপ্ন ভাঙতে শুরু করেছে।

সম্প্রতি ব্র্যাকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ৩৬ শতাংশ মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। তিন শতাংশের চাকরি থাকলেও বেতন পান না। দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে যারা কাজ করেন তাদের ৬২ শতাংশই কাজের সুযোগ হারিয়েছে। সেই সঙ্গে ঢাকা জেলার মানুষের আয় কমেছে ৬০ শতাংশ।

ব্যাচেলর ভাড়াটিয়াদের সংগঠন বাংলাদেশ মেস সংঘের মহাসচিব আয়াতুল্লাহ আখতার বলেন, একে তো ব্যাচেলরদের অর্থ সংকট সবসময় থাকে। করোনার এই পরিস্থিতিতে ব্যাচেলরদের দুর্বিষহ দিন কাটাতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়া উভয়কে বিবেকবোধ জাগ্রত করতে হবে।

করোনা মধ্যবিত্তকে নামাচ্ছে নিম্নবিত্তের কাতারে, আর নিম্নবিত্তদের নামাচ্ছে দরিদ্রের কাতারে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় এখনই দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা জরুরি বলে মনে করেছেন বিষেশজ্ঞরা।

ব্র্যাকের গবেষণা রিপোর্ট অনুযায়ী চাকরি হারানো ৩৬ শতাংশ ব্যক্তির বেশিরভাগই ঢাকার ভাড়া বাসা ছেড়ে দিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যেতে শুরু করেছেন। চলতি জুন মাসে গোটা রাজধানী জুড়ে ভাড়াটিয়াদের বাড়ি ছেড়ে দেয়ার দৃশ্য চোখে পড়ছে। পিকআপ, ভ্যানগাড়ি বা ট্রাকে করে মালামাল ভরে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছে এসব পরিবার।

করোনার এই পরিস্থিতিতে ভাড়াটিয়াদের অধিকার নিয়ে কাজ করছে এমন সংগঠন নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান শান্তা ফারজানা বলেন, করোনা ক্রান্তিলগ্নে দেশের মানুষ একদিকে যেমন মানবেতর অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে, অন্যদিকে বাড়ি ভাড়া মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)