করোনা চিকিৎসায় বহুল ব্যবহৃত ‘লোহার ফুসফুস’এর আদ্যোপান্ত

সারাবিশ্বেই করোনাভাইরাস মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতি মুহূর্তেই বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। সেই সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়ে চলেছে মৃত্যুর মিছিল। করোনাভাইরাস মানুষের ফুসফুস অকেজো করে দেয়। আক্রান্ত ব্যক্তি তীব্র শ্বাসকষ্টে ভোগেন।

এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিকে তাই কৃত্রিম অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়। কৃত্রিম অক্সিজেন সরবরাহ করে যে যন্ত্রটি সেটিকে বলা হয় ভেন্টিলেটর। করোনাভাইরাসের পাশাপাশি আরো যে শব্দগুলোর সঙ্গে মানুষ পরিচিত হয়েছে তার মধ্যে ভেন্টিলেটর অন্যতম।

ভেন্টিলেটর হচ্ছে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা। স্বাভাবিকভাবে মানুষ যখন শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারে না, তখন এই যন্ত্রের সাহায্যে অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়। কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র বা ভেন্টিলেটর অনেক জায়গায় রেস্পিরেটর নামেও পরিচিত। তবে আধুনিক হাসপাতাল এবং চিকিৎসা পরিভাষায় এই যন্ত্রকে কখনোই  রেস্পিরেটর হিসেবে উল্লেখ করা হয় না।

রোগীর মুখের ভেন্টিলেটর

রোগীর মুখের ভেন্টিলেটর

কারণ বর্তমানের চিকিৎসা ক্ষেত্রে রেস্পিরেটর শব্দটি দিয়ে শ্বাসমুখোশকে (শ্বাসবায়ু-শোধক মুখোশযন্ত্র) বোঝায়।চিকিৎসাবিজ্ঞানে অতিব জরুরি এই যন্ত্রটির প্রচলনের সুনর্দিষ্ট দিনক্ষণ জানা যায়নি। তবে ইতিহাসে এর বেশ কিছু ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। একসময় কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস দেয়ার জন্য যাঁতার মতো যন্ত্রের ব্যবহার ছিল।

অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগে রয়্যাল হিউম্যান সোসাইটি অব ইংল্যান্ড একে স্বীকৃতি দেয়। যদিও এই যাঁতা দিয়ে নিয়ন্ত্রিত উপায়ে শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করা সম্ভব ছিল না। তবে ভেন্টিলেটরের মূল কাজ অর্থাৎ শ্বাসতন্ত্রে বাতাস পৌঁছে দেয়ার কাজটা ঠিকভাবেই করা যেত। ১৮৩০ এর দশকে স্কটিশ চিকিৎসকরা প্রথম বায়ু চলাচল করতে পারে বা অক্সিজেন ধরে রাখতে পারে এমন একটি বাক্স তৈরি করেছিলেন।

এরপর ১৮৩২ সালে স্কটিশ চিকিৎসক জন ডালজিয়েল শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যা সমাধানে একধরনের নেগেটিভ-প্রেশার ভেন্টিলেটর তৈরি করেন। একটি বাক্সে রোগীর মাথা ছাড়া পুরো শরীর ঢুকিয়ে বাক্সের বায়ুর চাপ কমানো ছিল এই ভেন্টিলেটরের মূল কাজ। উনবিংশ শতাব্দীতে এসে একজন ভিয়েনেস চিকিৎসক একটি শিশু পুনঃসেসিটার বক্স তৈরি করেছিলেন। যা সফলভাবেই ব্যবহৃত হয়েছিল।

১৬ শতকের ভেন্টিলেটর

১৬ শতকের ভেন্টিলেটর

টেলিফোনের খ্যাতিমান উদ্ভাবক আলেকজান্ডার গ্রাহামবেলও কৃত্রিম শ্বাসকষ্টের সমস্যা সমাধানে কাজ করেছিলেন। শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত কারণে ছেলের মৃত্যুর পর তিনি একটি ভ্যাকুয়াম জ্যাকেট তৈরি করেছিলেন। এটি ছিল একধরনের কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস যন্ত্রের নকশা। যা বিংশ শতাব্দীতে বহুল ব্যবহৃত একটি ডিভাইস।

যেহেতু কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্রের ব্যর্থতা রোগীর মৃত্যুর কারণ হতে পারে। তাই যান্ত্রিক বায়ুচলাচল সিস্টেমগুলোকে জীবন-সংকটপূর্ণ ব্যবস্থা হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছিল। এছাড়াও হাসপাতালগুলোতে বৈদ্যুতিক ভেন্টিলেটরের পাশাপাশি হস্তচালিত শ্বাস-প্রশ্বাস সক্ষম করার জন্য তাদের ম্যানুয়াল ব্যাকআপ থাকত। যান্ত্রিক কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্রগুলোর ব্যর্থতার কারণে যেন কোনো রোগীর ক্ষতি না হয়।

আধুনিক ভেন্টিলেটরের প্রাথমিক রূপগুলোর একটি ছিল পালমোটর। ১৯০৭ সালে জার্মান উদ্ভাবক জোহান হেইনরিক ড্রাগার এবং তার ছেলে বার্নহার্ডের তৈরি এই যন্ত্র একটি ফেসমাস্কের সাহায্যে শ্বাসতন্ত্রে নির্দিষ্ট চাপে অক্সিজেন পৌঁছে দিতে পারত। রিদমিক ইনফ্লেশন অ্যাপারাটাস নামে এমন আরেকটি যন্ত্র কাছাকাছি সময়ে উদ্ভাবিত হয়েছিল।

ভেন্টিলেটরের আরেক সংযোজন

ভেন্টিলেটরের আরেক সংযোজন

যান্ত্রিক বায়ুচলাচলের এই যন্ত্রকে বলা হয় লোহার ফুসফুস। যা বিভিন্ন সংস্করণ দিয়ে শুরু হয়ে আজকের এই অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। ১৯২০এর দশকে আয়রন লাং নামে একধরনের নেগেটিভ প্রেশার ভেন্টিলেটরের খুব চল ছিল। বিশেষ করে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল এই যন্ত্রটি। যন্ত্রটি ফুসফুসের মধ্যে বায়ু প্রবাহিত করতে পারত।

সেসময় পোলিও আক্রান্ত শিশুদের এটি দিয়ে শ্বাসকষ্টের চিকিৎসা করা হত। ১৯৪৯ সালে, জন হ্যাভেন ইমারসন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যানেসথেসিয়া বিভাগের সহযোগিতায় অ্যানেসথেসিয়ার জন্য একটি যান্ত্রিক সহায়ক তৈরি করেছিলেন। অবশ্য ১৯৫০ এর দশকের শেষের দিকে এসে কিছু দেশে পোলিওর প্রতিষেধক আবিষ্কার হওয়ার পর এর ব্যবহার কিছুটা কমে যায়।

তবে এর ঠিক দুই বছর পর অর্থাৎ ১৯৫২ সালে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে তিন হাজারেরও বেশি শিশু মারা যায়। তখন আবার ফুসফুসে বাতাস সরবরাহ করতে আয়রন লাংয়ের ব্যবহার শুরু হয়। ১৯৬০ এর দশকে যুদ্ধ বিমানগুলোতে পাইলটদের জন্য ভেন্টিলেটর তৈরি করা হয়। অনেক সময় বেশি উচ্চতায় থাকাকালীন অনেকের শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা দেখা দিত।

আধুনিক ভেন্টিলেটর

আধুনিক ভেন্টিলেটর

মার্কিন সেনাবাহিনীর বৈমানিক ফরেস্ট বার্ড ১৯৫৮ সালে একধরনের ভেন্টিলেটর আবিষ্কার করেন। যার নাম দেয়া হয় বার্ড মার্ক ৭ রেস্পিরেটর। অনেকে এটিকে প্রথম আধুনিক ভেন্টিলেটর হিসেবে দাবি করে থাকেন। ১৯৭০ এর দশক থেকে চিকিৎসাক্ষেত্রের আধুনিকায়নের সঙ্গে ভেন্টিলেটরেরও আধুনিকায়ন ঘটে। তবে দিনে দিনে এর আকার এবং কার্যক্ষমতা উন্নত হচ্ছে।

ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক লার্নার কলেজ অব মেডিসিনের এমফিসিমা গবেষণা বিভাগের অধ্যাপক ড. জেমস স্টোলার বলেছেন, এটি এখন অবশ্যই যত্নের মান হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনভাইরাস থেকে এআরডিএস ভেন্টিলেটর ছাড়া রোগীদের চিকিৎসা দেয়া সম্ভব না।

সূত্র: টাইমডটকম

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)